ডেস্ক নিউজ:
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার লালপুরের সেই ব্রাজিল বাড়ির মালিক জয়নাল আবেদীন টুটুলের বিরুদ্ধে তেল চুরি করে কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আর তাই টুটুলকে নিয়ে এলাকার সকল মহলে আলোচনা চলছে। শুধু আলোচনাই নয় রীতিমত সবাই ধিক্কার দিচ্ছে। যমুনা ডিপোর একজন সামান্য কর্মচারী হয়ে কীভাবে কোটি টাকার মালিক হলেন টুটুল। আর কী ধরনের আলাউদ্দিনের চেরাগ পেলো তা নিয়ে গোটা নারায়ণগঞ্জে চলছে আলোচনা। বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্রাজিলকে হাইলাইট করে নারায়ণগঞ্জসহ দেশে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছিলেন টুটুল। কিন্তু এখন তার সম্পর্কে তেল চুরির কাহিনী লজ্জাজনত অবস্থায় নিয়ে গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ফতুল্লার লালপুরের বাজ্রিল বাড়ির ভেতরে প্রবেশ মুখে রয়েছে কঠোর নিরাপত্তা। আশেপাশের লোকজন টুটুলের তেল চুরির খবর জানলেও ইচ্ছে করেই ব্যাপারটি ধামাচাপা দিয়ে এসেছেন অনেকেই। অযথা ঝামেলা এড়াতে মুখ খুলতেও দ্বিধাবোধ করেন কেউ কেউ। কিন্তু মিডিয়ায় ফলাও করে তার কর্মকাণ্ড প্রচারের পর ধীরে ধীরে মুখ খুলতে শুরু করেছেন এলাকাবাসী।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফতুল্লার লালপুরে ব্রাজিল বাড়ির মালিক জয়নাল আবেদীন টুটুল। তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের কুতুবপুর ইউনিয়নের আব্দুল্লাহপুর মজুরটেক। গ্রামের স্কুলে ফাইভ পর্যন্ত লেখাপড়া করে নারায়ণগঞ্জে চলে আসে। তার বাবা রফিক মিয়া ছিলেন নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার পঞ্চবটিতে অবস্থিত রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি যমুনা অয়েল কোম্পানির সিকিউরিটি গার্ড। বাবার মৃত্যুর পর যমুনা অয়েল কোম্পানিতে চাকরি পায় টুটুল। নো ওয়ার্ক নো পে পদ্ধতিতে যমুনা অয়েল কোম্পানির ক্যান্টিনে দৈনিক ৫৫ টাকায় বেতন ছিল টুটুলের। পরবর্তীতে যমুনা অয়েল কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ করা তিনজন কর্মকর্তা ও দুইজন সিবিএ নেতার কল্যাণে টুটুল অপারেটরের পদ চাকারি পান। ভাগ্য খুলে যায় টুটুলের। কারণ প্রতিদিন বিভিন্ন তেলবাহী গাড়িতে তেল চুরির মূল হোতা হলো ওই অপারেটর। একপর্যায়ে চাকরি নেন গ্রেজারের। গ্রেজার মূলত বড় বড় তেল মাপায় জড়িত।

যমুনা অয়েল কোম্পানির সংশ্লিষ্টদের মতে, একজন গ্রেজারের দৈনিক আয় কমপক্ষে ১ লাখ টাকা। কখনো কখনো মাসে এ টাকার অংক ছাড়িয়ে যায় কোটিতে। মূলত তেল চুরির টাকা দিয়ে ফতুল্লার লালপুরে আলিশান ব্রাজিল বাড়ি গড়ে তুলেন টুটুল।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে যাদের নামে মাত্র ১৫ শতাংশ জমি রয়েছে তাদেরই এখন ফতুল্লার লালপুরে ব্রাজিল বাড়ির পাশাপাশি প্রচুর জমিরও মালিক তারা। নারায়ণগঞ্জের ইউসিবি ব্যাংক থেকে ১০ বছর মেয়াদে ২০ লাখ টাকা লোন নিলেও মাত্র দেড় বছরের ব্যবধানে পরিশোধ করা হয় টাকা। টুটুলের এসব কাহিনী ব্রাজিল বাড়ির বদৌলতে সকলে পজেটিভ বিষয় জানলেও ইতোমধ্যে দুর্নীতির অভিযোগে তাকে একবার বদলিও করা হয়েছে। দুদকে জমা পড়েছে দুর্নীতির অভিযোগ।

তবে ইউসিবিএল ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৩ মার্চ টুটুল ১০ বছর মেয়াদে ২০ লাখ টাকা লোন নেয়। কিন্তু মাত্র দেড় বছরের মাথায় ২০১৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পুরো লোন পরিশোধ করে টুটুল। প্রশ্ন উঠে মাত্র দেড় বছরে ২০ লাখ টাকা টুটুল পেল কোথায়? এছাড়াও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফতুল্লার পিলকুনি মৌজায় ৪ শতাংশ জমি, সম্প্রতি ব্রাজিল বাড়ির সন্নিকটে আরও ৮ শতাংশ জমি কিনেছেন টুটুল। অথচ টুটুলের বেতন ২৫ হাজার ৪৬২ টাকা। এই বেতনের একজন কর্মচারী রাতারাতি এতো টাকার মালিক বনে যাওয়ার বিষয়টি আলাউদ্দিনের চেরাগের মতো লাগছে এলাকাবাসীর কাছে। এক পর্যায়ের টুটুলের বিরুদ্ধে যমুনা ওয়েল কোম্পানির একজন দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ দেন। দুদকের শুনানীতে টুটুলকে ডাকাও হয়েছিল।

তবে টুটুলের দাবি, আত্মীয় স্বজন ও পারিবারিক সূত্র ধরেই টাকা-পয়সার মালিক হয়েছেন, বাড়ি করেছেন। তিনি জানান, গ্রামের স্কুলে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণিতে এবং নারায়ণগঞ্জে ৫ম ও ৬ষ্ঠ লেখাপড়ার কথা বলে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যান। তবে বিপুল অর্থ-বিত্ত ও ব্রাজিল বাড়ি নির্মাণের বিষয়ে বলেন, বাবার পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমি বিক্রি, বোনদের সহায়তা, ব্যাংক লোন নিয়ে এই বাড়ি করেছেন। আর তার বিরুদ্ধে অহেতুক অপপ্রচার করা হচ্ছে। তার আরও দাবি, ব্রাজিল বাড়ি করার কারণে হিংসা থেকে কেউ তার বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে।

যমুনা ডিপোর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২০০৫ সালে জয়নাল আবেদীন টুটুলের চাকরি স্থায়ী হয়। পরে তদবীর ও টাকা পয়সা খরচ করে কৌশলে সে তার পদবী পরিবর্তন করে অপারেটর (তেল মাপা) পদে পদায়ন হয়। আর অপারেটর হওয়া মানে তেলের ভেতর ঢুকে যাওয়া। মোটকথা সে যেদিন অপারেটর হয়ে গেল সেদিন থেকে তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। তবে অপারেটর হওয়ার পর তার আবার সাধনা হলো সে গ্রেজার হবে। গ্রেজার হলো তেল মাপা, মানে যেখানে বড় মাপের তেল মাপা হয়। মাপের হেরফেরের মাধ্যমে দৈনিক লাখ লাখ টাকা ইনকাম হয়। মাসে কোটি টাকা। ধীরে ধীরে তার ভাগ্যের চাকা খুলে যায়। অল্প দিনের মধ্যে তেল চুরির বিদ্যা রপ্ত করেন তিনি

যমুনা অয়েল কোম্পানির সংশ্লিষ্টদের মতে, একজন গ্রেজারের দৈনিক আয় কমপক্ষে ১ লাখ টাকা। কখনও কখনও মাসে এ টাকার অংক কোটিও ছাড়িয়ে যায়। প্রতিদিন হাজার হাজার লিটার তেল চুরির সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন টুটুল। যমুনা অয়েল কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ করা তিনজন কর্মকর্তা ও দুইজন সিবিএ নেতার সমন্বয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠা। ওই সিন্ডিকেটের ইশারায় পদায়ন, পদোন্নতি, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য হয়। এক সময় টুটুলের অপকর্ম দৃষ্টিগোচর হলে তাকে বদলি করা হয় যুমনা ডিপোর সুনামগঞ্জ জেলায় সাজনা বাজার শাখায়। কিন্তু সে বেশি দিন সেখানে থাকেনি। ফতুল্লায় চলে আসে।

দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে এই ডিপোতে কাজ করা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী জানান, ধরেন ১৫ লাখ লিটার তেল জাহাজে এসেছে। ১৫ লাখ লিটার ট্যাংকিতে উঠেছে কাগজে কলমে। কিন্তু এই ১৫ লাখ লিটার তেল যে বিক্রি করা হচ্ছে তাতে গাড়িওয়ালাদের কম দিয়ে নিজেরা ওই তেল একসেস করে। যেমন একটি গাড়ি পাবে ১ হাজার মিলি। কিন্তু দুই থেকে তিন মিলি কম দেয়া হচ্ছে। তাহলে তিন মিলিতে ৯ লিটার কম, ২ মিলিতে ৬ লিটার কম। এই তেলটা তারা বাহিরে বিক্রি করে দেয়। ট্যাংকির ভেতর ১৩ লাখ তেলের সঙ্গে ২ লাখ লিটার পানি থাকার কথা। সেখানে পাওয়া গেছে ৪ লাখ। এ ঘটনায় ঝামেলা তৈরি হলে টুটুলকে এই ডিপো থেকে বদলী করা হয় সুনামগঞ্জ জেলায় সাজনা বাজার শাখায়।

বাংলাদেশ পেট্টোলিয়াম কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান মো. আকরাম আল হোসেন জানান, কোনো কর্মচারী, কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তেল চুরি বা পাচার এবং অন্য কোনো অনিয়মের বিষয়ে যখন আমাদের কাছে কোনো তথ্য উপস্থাপিত হচ্ছে আমরা সঙ্গে সঙ্গে এটার কার্যকরী ব্যবস্থা নিচ্ছি। আর জয়নাল আবেদীন টুটুল রাশিয়ায় বিশ্বকাপ খেলা দেখতে গিয়েছিল, পারমিশন নিয়েছে কিনা তা আমরা খতিয়ে দেখবো।