কয়েক দশক ধরে চলা পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি’র (পিপিপি) আধিপত্যকে হারিয়ে এবার ক্ষমতা দখল করেছে ইমরান খানের পিটিআই। ৭০ বছরের ইতিহাসে অর্ধেকেরও বেশি সময় পাকিস্তানকে শাসন করেছে দেশটির সেনাবাহিনী।

দেশটিতে গত বুধবার (২৫ জুলাই) অনুষ্ঠিত ১১তম সাধারণ নির্বাচনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কাতার ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরা। এতে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ভোটের প্রক্রিয়া শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কী এর নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিল পাক সেনাবাহিনী? ভোট জালিয়াতি কী হয়েছে? এবং ইমরান খান কী দেশটির দীর্ঘদিনের অস্থিতিশীলতা কাটিয়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারবেন? পাঠকদের জন্য পাকিস্তানের এবারের নির্বাচনের সাতকাহন তুলে ধরা হলো-

১. দেশব্যাপী ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ

ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। এককভাবে সরকার গঠন করতে ১৩৭ টি আসনে জয়ী হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু ইমরানের দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে মাত্র অল্প দূরে আছে। আর ছোট ছোট দল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কমপক্ষে ৪৫টি আসনে জয়ী হয়েছে। তাই ছোট দল আর স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে জোট গঠন করে ইমরানের প্রধানমন্ত্রী হতে কোনো কষ্টই হবে না।

পিটিআই’র সরকার গঠনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দু’টি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রথমত, পাঞ্জাবের উত্তর এবং দক্ষিণ অংশে পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের সাথে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেছে পিটিআই। রাজনৈতিকভাবে দেশটির পাঞ্জাব প্রদেশ নওয়াজের মুসলিম লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত।

দ্বিতীয়ত, দেশটির খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের বেশিরভাগ আসন দখল করেছে ইমরানের দল। ঐতিহাসিকভাবে ওই প্রদেশে সবসময়ই ক্ষমতাসীন দল জয়ী হয়েছে। কিন্তু এবার ওই রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে পিটিআই।

২. নির্বাচন কী অবাধ-নিরপেক্ষ ছিল?

ইমরানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান মুসলিম লীগ এবং অন্যান্য দলগুলো নির্বাচনে কারচুপি এবং পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছে। কয়েকটি দল অবশ্য নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে পুনরায় ভোট গণনা করার আহ্বান জানিয়েছে নির্বাচন কমশিনকে। কিন্তু পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, যদি নির্বাচন নিয়ে কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে উপযুক্ত প্রমাণের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করতে হবে।

বিরোধীদলগুলোর ভোট গণনা প্রক্রিয়া নিয়ে অভিযোগ তুলেছে। কমপক্ষে ৬টি রাজনৈতিক দল অভিযোগ করছে ভোট গণনা করার সময় তাদের প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকতে দেয়া হয়নি। কিন্তু আইন বলছে, প্রত্যেকটি দলের প্রতিনিধির সামনে ভোট গণনা করতে হবে। এছাড়াও চূড়ান্ত ভোট গণনার কাগজপত্র সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন তারা।

ফাফেন নামের পাকিস্তানের একটি স্বাধীন নির্বাচন পর্যবেক্ষক নেটওয়ার্ক কমপক্ষে ৩৫টি সংসদীয় আসনে জয়ী হওয়ার জন্য যত ভোট লেগেছে তা নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বাতিল ঘোষণা করা ভোটের চেয়ে কম। যা কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে সুযোগ তৈরি করে দেয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। ২০১৩ সালেও ঠিক একই ধরনের ঘটনা ঘটে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল বলছে, এই নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানে একটা ইতিবাচক পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গেলেও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করা এবং সবাইকে সমানভাবে নির্বাচনী প্রচারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত ইত্যাদি ঘটনা নির্বাচনকে ম্লান করে দিয়েছে।

২০১৩ সালের নির্বাচনে ব্যাপক জুলুমের অভিযোগ আনা পিটিআই’র প্রধান ইমরান খান বলেছেন, তার দল নির্বাচন প্রক্রিয়ার যেকোনো বিষয়ের অনুসন্ধানে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে।

৩. করাচির নির্বাচনী ইতিহাস ভেঙেছে তেহরিক-ই-ইনসাফ

পাকিস্তানের জাতিভিত্তিক দল মুত্তাহিদা কাওমি আন্দোলন (এমকিউএম) গত ৩৫ বছর এককভাবে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শহর করাচি শাসন করে আসছে। দলটির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে ২০১৩ সালের শেষের দিক থেকে আধা-সামরিক বাহিনীর এক অভিযান পরিচালনা করে। দলের বেশ কিছু নেতা-কর্মীকে জেলে ঢোকানো হয়। এই অভিযানে দলটিতে চুড়ান্ত ভাঙ্গনের শুরু হয়। দলটির প্রধান লন্ডনপ্রবাসী আলতাফ হুসাইনও দলের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।

যার ফলে ২০১৮ সালের নির্বাচনে গত কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবার করাচি শহরে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। আর এর ফলাফল খুব পরিষ্কার। এতদিন ধরে এককভাবে আধিপত্য জারি রাখা মুত্তাহিদা কাওমি আন্দোলনকে পেছনে ফেলে শহরটির ২১টি আসনের ১৪টিতেই জিতেছে ইমরানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ। ইমরানের দল পার্শ্ববর্তী লয়ারি শহরে পাকিস্তান পিপলস পার্টির ঐতিহাসিক ঘাঁটিতে দলটির প্রধান বিলওয়াল ভুট্টো জারদারিকে হারিয়ে দিয়েছে।

৪. নির্বাচনে বিক্ল্প ধারার দলগুলোর মিশ্র প্রভাব

এই নির্বাচনে পাকিস্তানের বিক্ল্পধারার দলগুলো মিশ্র ফল পেয়েছে। নতুনভাবে উত্থান হওয়া তেহরিক-ই-লাব্বাইক (টিএলপি) নিজেকে বরেলভি সুন্নি দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। কিন্তু বাকি দলগুলো কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি এবারের নির্বাচনে।

তেহরিক-ই-লাব্বাইক সিন্ধ প্রদেশের দু’টি সংসদীয় আসনে জয়লাভ করেছে। কিন্তু উল্লেখ করার মতো ব্যাপার হলো এবারের নির্বাচনে জাতীয় সংসদে আসা দলগুলোর মধ্যে দলটি তৃতীয় অবস্থানে আছে। নিয়মিতভাবে এটি ১০ হাজারের মতো ভোট পেয়েছে এবং বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে কিছু এলাকায় ৪২ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছে।

লস্কর-ই-জাংভি নামের একটি জঙ্গি সংগঠনের রাজনৈতিক শরিক হিসেবে অভিযুক্ত আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত এবং লস্কর-ই-তৈয়বা নামের একটি সশস্ত্র দলের শরিক হিসেবে অভিযুক্ত মিল্লি মুসলিম লীগ এবারের জাতীয় এবং প্রাদেশিক উভয় নির্বাচনেই ভালো করতে পারেনি।

৫. নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় সেনাবাহিনী

২০১৮ সালের এই নির্বাচনে রেকর্ড সংখ্যক প্রায় ৪ লাখের মতো সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। যা আগের যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে সর্বোচ্চ এবং যার ফলাফল দেখা গেছে নির্বাচনে। দেশের ৮৫ হাজার নির্বাচনী কেন্দ্রে সেনা সদস্য, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং নির্বাচনী কর্তৃপক্ষ কিছু কিছু ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

নির্বাচন শুরু হওয়ার আগেই কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। বেশ কিছু জায়গায় গণমাধ্যমকর্মীদের ভেতরে প্রবেশে বাধা দেয়া হয়। যদিও এ ব্যাপারে সামরিক বাহিনীর অনুমতি ছিলো।

কিন্তু সেনাবাহিনী বলছে, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় তারা প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা পালন করেনি। শুধু ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তা দিয়েছে এবং ভোটদান প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেছে। কিন্তু বিরোধী দলগুলো বলছে, সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষভাবে ভোট গণনা প্রক্রিয়ার সঙ্গে ছিল।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। কিন্তু তারা বলছে, ভোট গণনার সময় নিরাপত্তা কর্মীরা ফলাফল রেকর্ড করা এবং ফলাফল প্রেরণের ক্ষেত্রে টেবুলেশন তৈরিতে জোরারোপ করেছে।

৬. এই নির্বাচনে প্রকৃতপক্ষে হারলো কারা?

এই নির্বাচনে প্রকৃতপক্ষে কারা হেরেছে এটা নির্ভর করেছে আপনি কীভাবে দেখছেন। ১৯৭০ সালে গঠিত এবং চারবার পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবারের নির্বাচনে মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এখন তারা পাকিস্তানের তৃতীয় অবস্থানে থাকা দল। নিজেদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত সিন্ধ প্রদেশে দলটি জয়ী হয়েছে এবং পাঞ্জাব প্রদশের দক্ষিণাঞ্চল এবং আশপাশে কিছু আসন পেয়েছে।

ধর্মীয় অধিকারের বিষয়ে পরিচিত বেশ কিছু দল যেমন- জামিয়াত ওলেমা ইসলাম-ফজল (জেইউআই-এফ), জামায়াত-ই-ইসলাম (জেআই) এবং আরো কিছু দল নির্বাচনে ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তারা দেশব্যাপী মাত্র ১৩টি আসনে জয়ী হয়েছে। মুত্তাহিদা কাওমি আন্দোলন করাচিতে তাদের আধিপত্য খুইয়েছে। এছাড়াও পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় এই শহরে পাক সার জমিন পার্টি (পিএসপি) একটি আসনেও জয়ী হতে পারে নাই।

শেষ পর্যন্ত, খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় পশতুন জাতীয়তাবাদী দল আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি (এএনপি) মাত্র একটি আসনে জয়ী হয়েছে। দলটি ২০০৮-১৩ সাল পর্যন্ত ওই এলাকায় ক্ষমতায় ছিল।

৭. এই নির্বাচন কী পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দিতে পারবে?

তবে এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র জামিয়াত ওলেমা ইসলাম-ফজল এই ফলাফলের বিপক্ষে ব্যাপক প্রতিবাদ জানিয়েছে। এছাড়াও পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ আগে যাওয়ার পথ তৈরি করছে। বিলাওয়ালের পাকিস্তান পিপলস পার্টি এই ফলাফল মেনে নিয়েছে।

ইমরানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ সরকার গঠন করতে পরিষ্কার ম্যান্ডেট পেয়েছে। এখন জোট গঠন করার জন্য তারা আলোচনা শুরু করে দিয়েছে। দলটি খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশেও সরকার গঠন করবে। সিন্ধ প্রদেশে পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রাদেশিক সরকার গঠন করবে। এদিকে, বেলুচিস্তান প্রদেশে সরকার গঠন করবে বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (বিএপি) ।

পাকিস্তানকে স্থিতিশীল রাখার চাবিকাঠি হলো পাঞ্জাবে যে দল প্রাদেশিক সরকার গঠন করবে। কেননা পাঞ্জাব হলো পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ। আর এই পাঞ্জাব প্রদেশে প্রায় কাছাকাছি অবস্থানে আছে পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ এবং পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ। মুসলিম লীগ পেয়েছে ১২৭টি আসন আর তেহরিক-ই-ইনসাফ ১২৩টি আসন। তারা উভয়ই পাঞ্জাবে সরকার গঠনের চেষ্টা করছে।

বিগত এক যুগ ধরে ক্ষমতায় থাকা এই প্রদেশে মুসলিম লীগ যদি সরকার গঠন করতে পারে তাহলে দলটি কেন্দ্রে সরকার গঠন করতে যাওয়া পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের চরম রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হবে।