ডেস্ক নিউজ:
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারজাতীয় সংসদের ১১তম সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন টানা দুই মেয়াদের সরকার শেষ ডিসি (জেলা প্রশাসক) সম্মেলনে কিছু বিশেষ দায়িত্ব দিতে চায় ডিসিদের। কারণ দেশের ৬৪ জেলায় কর্মরত বর্তমান ডিসিরাই নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে, পরামর্শে ও দিক নির্দেশনায় আগামী নির্বাচন পরিচালনায় কাজ করবে।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সংবিধান অনুযায়ী প্রশাসন পরিচালিত হবে নির্বাচন কমিশনের পরামর্শে। সেক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন স্বল্প পরিসরের সরকার দৈনন্দিন রুটিন ওয়ার্ক করবে। ডিসিদের সঙ্গে বর্তমান সরকারের এটিই শেষ মতবিনিময়।

নির্বাচনের সময় ডিসিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সে কারণে এবারের ডিসি সম্মেলনে ডিসিদের প্রতি বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। আগামী ২৪ জুলাই ঢাকায় শুরু হবে তিন দিনের এই ডিসি সম্মেলন। শেষ হবে ২৬ জুলাই। ঢাকায় ডিসি সম্মেলন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জানা গেছে, মাঠ প্রশাসনকে চাঙ্গা রাখতে ডিসিদের পরামর্শ দেবে সরকার। একই সঙ্গে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে গতিশীলতা বাড়ানোর ওপরও জোর দেওয়া হবে। তৃণমূল পর্যায়ে সরকারের নীতি ও দর্শনের বাস্তবায়ন ও তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হবে ডিসিদের। তাই এসব কাজের বাস্তবায়নে সরকারের নীতিনির্ধারক ও জেলা প্রশাসকদের মধ্যে সরাসরি মতবিনিময় এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতেই প্রতি বছরের ন্যায় এবারও জেলা প্রশাসক সম্মেলনের আয়োজন করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডিসিরা মাঠ পর্যায়ে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা। তাই বিভিন্ন প্রয়োজনে বছরে অন্তত একবার সরকার ডিসিদের সঙ্গে মতবিনিময় করে। এক্ষেত্রে সরকার যেমন দিক নির্দেশনা দেয়, তেমনি ডিসি সাহেবরাও মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাদের সুবিধা অসুবিধার কথা সরকরারকে জানান। এভাবেই সরকার ও প্রশাসনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের সেতুবন্ধন তৈরি হয়। এবারও তাই হচ্ছে। এটি নতুন কিছু নয়।’

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, অতীতের ন্যায় এবারের ডিসি সম্মেলনেও সরকারের পক্ষ থেকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস নির্মূলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, গ্রামের মুরুব্বি, নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ী, নারী সংগঠক, আনসার-ভিডিপি, গ্রাম পুলিশ, এনজিও কর্মীসহ সমাজের সবাইকে সম্পৃক্ত করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হতে পারে। সরকারি সেবা গ্রহণে সাধারণ মানুষ যাতে কোনোভাবেই হয়রানি বা বঞ্চনার শিকার না হন সেদিকে লক্ষ্য রাখা, তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করা, গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার পরামর্শ দেওয়া হতে পারে। যাতে মানুষ শহরমুখী না হয়। ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য কমানো যায়। এ সময় সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হবে। বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিতের নির্দেশনাও থাকবে। জঙ্গিবাদ,সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা দূর করে সমাজ জীবনের সবখানে শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আরও সতর্কতার সঙ্গে এবং কঠোরভাবে দায়িত্ব পালনেরও নির্দেশ দেওয়া হতে পারে এবারের ডিসি সম্মেলনে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের এই শীর্ষ কর্মকর্তারা সবচেয়ে বেশি আলোচিত, সমালোচিত হন এবং বেশি পরিশ্রম ও সময় ব্যয় করেন ভূমি ব্যবস্থাপনা কাজে। সরকারের ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটালাইজড করার উদ্যোগ শতভাগ সফল হয়নি নানা কারণে। তাই ভূমি ব্যবস্থাপনা ও এ সংক্রান্ত কাজে গতি আনার পরামর্শ দেবেন সরেকারের নীতিনির্ধারকরা। ভূমি প্রশাসন ও ভূমি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়ানো এবং সরকারি ভূমি রক্ষায় আরও সচেষ্ট হওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হবে। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সার-বীজ-বিদ্যুৎ-জ্বালানি ইত্যাদির সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া, পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থাপনাকে জনপ্রিয় করতে উদ্যোগী হওয়া, ভেজাল খাদ্যদ্রব্য বাজারজাতকরণ প্রতিরোধে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করে এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড কঠোর হস্তে দমন করারও নির্দেশনা থাকবে বলে জানা গেছে।

সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সমাজের প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কল্যাণে সরকারের নেওয়া বিশেষ পদক্ষেপগুলো কতোটুক বাস্তবায়ন হলো বা হচ্ছে তা তদারকির প্রতি বিশেষ নির্দেশনা থাকবে। থাকবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ ১০ উদ্যোগের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন।

জানা গেছে, সাধারণ মানুষকে সহজে সুবিচার দিতে ও আদালতে মামলার জট কমাতে গ্রাম আদালতগুলোকে কার্যকর করার পরামর্শ থাকলেও তা শতভাগ বস্তবায়ন করা যায়নি। তবে স্থানীয় সরকার কাঠামোতে বিদ্যমান সংস্থাগুলোর তত্বাবধানে পারিবারিক কিছু সমস্যা সামাধান করা হচ্ছে। গ্রাম আদালতগুলোকে শতভাগ কার্যকর করার মাধ্যমে ছোটখাটো বিষয় নিষ্পত্তির জন্য আদালতের ওপর চাপ কমানোর পরামর্শ দেওয়া হবে। জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছাতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিকাশে নেতৃত্ব দিতে হবে, শিক্ষার সর্বস্তরে নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগগুলোর বিষয় জনগণকে অবহিত করতে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা থাকবে।

কোনও নিরপরাধ যেন শাস্তি না পায়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার নর্দেশনা থাকবে সরকারের।

পার্বত্য জেলাসমূহের উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণের পাশাপাশি এ অঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে হবে। পর্যটনশিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং ঐতিহ্যবাহী কুটিরশিল্পের বিকাশে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার পরামর্শ দেওয়া হবে অতীতের ন্যায়। সারাদেশে বর্তমান সময়ের মতো শান্তিপূর্ণ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ধরে রাখতে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) নির্দেশ দেওয়া হবে ডিসি সম্মেলনে। ডিসিদের নিজ নিজ এলাকায় এ শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ধরে রাখার ওপর জোর দেওয়া হবে।

ডিসিদের অভিযোগ, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ পাওয়া যায় না। এটা একটা বড় সমস্যা। এবারও হয়তো একই অভিযোগ থাকবে। এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে। ডিসিদের চাহিদা অনুযায়ী পুলিশ এবং আনসার সদস্য দেওয়া হবে – ডিসির জন্য এমন আশ্বাসও থাকবে। তবে মামলা নিষ্পত্তিতে মোবাইল কোট পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ নির্দেশনা থাকবে।

উল্লেখ্য, বছরের শেষ দিকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে এখান থেকে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানের নির্দেশনা নিয়ে মাঠে যাবেন ডিসিরা। এজন্য এবারের সম্মেলন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। মঙ্গলবার ঢাকায় ডিসি সম্মেলন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম এতে সভাপতিত্ব করবেন। এরই মধ্যে সারাদেশের ডিসিরা তাদের প্রস্তাবনা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঠ প্রশাসন সমন্বয় অধিশাখা থেকে সব মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও বিভাগীয় কমিশনারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এই সম্মেলনে বিভাগীয় কমিশনাররাও অংশ নেবেন। ২৪ থেকে ২৬ জুলাই ঢাকায় তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলন (ডিসি সম্মেলন) অনুষ্ঠিত হবে। এর প্রস্তুতি চলছে।

২০১৭ সালের ডিসি সম্মেলনে মোট ২২টি অধিবেশন হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ অংশগ্রহণকারী ৫২টি মন্ত্রণালয়ের ১৮টি কার্য অধিবেশন হয়। ২০১৭ সালের সম্মেলনে জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে ৫২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সম্পর্কিত ৩৪৯টি প্রস্তাব এসেছিল। এর মধ্যে ১৫০টি স্বল্পমেয়াদি, ১৩২টি মধ্যমেয়াদি এবং ১৪৭টি দীর্ঘমেয়াদি মোট ৪২৯টি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নির্বাচনের সময় ডিসিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সে কারণে তাদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।