বিদেশ ডেস্ক:
রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে গঠিত আনান কমিশন গত মাসে নতুন করে দেওয়া এক প্রতিবেদনে রাখাইন পরিস্থিতি তুলে ধরেছে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত ওই কমিশন গত ৮ জুন ‘সঞ্চিত অভিজ্ঞতা’ (Lessons Learned) শীর্ষক ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। নতুন প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, রাখাইন পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয়নি, বরং তা আরও খারাপ হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কমিশনের চূড়ান্ত সুপারিশগুলো মিয়ানমারের সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে দেশটির সরকার ও তাদের আন্তর্জাতিক সহযোগীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ রূপরেখায় পরিণত হয়েছে। মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতির এক প্রতিবেদন থেকে এসব কথা জানা গেছে।

রাখাইন সংকট সমাধানের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আনান কমিশনের এক বছরের কার্যকাল শুরুর পর পরই রোহিঙ্গা পরিস্থিতি বাজে রূপ ধারণ করে। ২০১৬ সালের অক্টোবর ও ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনে ব্যাপকভাবে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ইরাবতি বলছে, দুই সময়েই নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রাণঘাতী হামলার পরেই এই সহিংসতা ছড়িয়েছে। এই হামলার পরই রাখাইনে সেনাবাহিনীর শুরু করা ক্লিয়ারেন্স অপারেশনে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়। আর এই কারণে প্রাণ হারায় হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক। বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা। রাখাইন সংকট নিয়ে ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়ে মিয়ানমার সরকার ও এর ডি ফ্যাক্টো নেতা অং সান সু চি। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্র জাতিগত নিধনযজ্ঞের অভিযোগ করলেও তারা তা অস্বীকার করছে।

আনান কমিশনের নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে ডি ফ্যাক্টো সরকারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বগ্রহণের সময়ই অং সান সু চি জানতেন রাখাইন তার জন্য বড় রাজনৈতিক বাধা হয়ে উঠবে। আর সেকারণে তিনি এই ইস্যুটি সামলাতে সাহায্য প্রার্থনার সিদ্ধান্ত নেন। দায়িত্ব নেওয়ার দ্বিতীয় মাসেই সু চি নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। রাখাইন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সুপারিশ তৈরির জন্য একটি কমিশনের নেতৃত্ব দিতে তিনি আনানকে অনুরোধ জানান। ২০১৬ সালের জুনে মিয়ানমারে সফর করে কফি আনান ফাউন্ডেশন। সেসময় সু চি’র অনুরোধে সাড়া দেন আনান। গত বছরের ২৪ আগস্ট কমিশনের কার্যকাল শেষে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ৮ জুন প্রকাশিত নতুন প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, তাদের পরামর্শ ও সুপারিশ সত্ত্বেও উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইনের পরিস্থিতির ক্রমঃঅবনতি ঘটেছে। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে পরিস্থিতির এই অধঃগতি কমিশনের কাজের গুরুত্বকে সামনে এনেছে। গত বছরের ২৪ আগস্ট কমিশনের তরফ থেকে প্রতিবেদন প্রকাশ না করা হলে পরিস্থিতি এর চেয়েও খারাপ হতে পারতো।

ইরাবতির প্রতিবেদনে বলা হয়, আনান কমিশন তাদের গত বছরের রিপোর্টে ৮৮টি সুপারিশ করেছিল, এর প্রত্যেকটিকে সমর্থন দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে মিয়ানমার মন্ত্রী পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করে। বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাক্ষর করে প্রত্যাবাসন চুক্তি। শরণার্থীদের নিরাপদ ও স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সহায়তা নিতেও সম্মত হয় মিয়ানমার। কমিশন জানায়, গত বছরের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সামনে চূড়ান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়েছিল। পরিষদের ১৫ সদস্য রাষ্ট্র কমিশনের ওই অনুসন্ধানকে স্বাগত জানিয়েছিল। নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘যখন মিয়ানমার ও তাদের আন্তর্জাতিক সহযোগীদের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটছে, তখন পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমঝোতার জন্য কমিশনের সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন অদ্বিতীয় প্ল্যাটফর্ম বলে বিবেচিত হবে।’

সম্প্রতি মিয়ানমারে নতুন বিশেষ দূত হিসেবে ক্রিস্টিন শ্রেনার বার্গেনারকে নিয়োগ দিয়েছে জাতিসংঘ। গত মাসের প্রথম দিকে তিনি দেশটিতে প্রথম সরকারি সফরে যান। ওই সফরে তিনি মিয়ানমার সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে গত ৬ জুন জাতিসংঘের দুই সংস্থার সঙ্গে দেশটির সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরকে ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেছেন। আনান কমিশনের সুপারিশের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নসহ বর্তমান প্রচেষ্টাগুলো রোহিঙ্গা সংকটের মুর কারণ শনাক্তে ভূমিকা রাখবে বলেও আশা প্রকাশ করেন জাতিসংঘের নতুন বিশেষ দূত।

কমিশনের নতুন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে রাখাইনে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় এক লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর থেকে সেখানকার পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে উ থেইন সেইনের মন্ত্রিসভা রাখাইনে বিপুল সময় বিনিয়োগ ও প্রচেষ্টা চালাতে বাধ্য হয়। তবে পরিস্থিতি সামলাতে তারা সফল হয়নি বললেই চলে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বদলে বেশ কিছু ব্যবস্থামূলক পদক্ষেপ নেয় তারা। উ থেইন সেইনের মূল পদক্ষেপগুলোর মধ্যে ছিল- ২০১৩ সালে রাখাইন কমিশন গঠন আর ২০১৪ সালের জন্য রাখাইন স্টেট অ্যাকশন প্ল্যান গঠন। এসব পদক্ষেপ যেমন সমস্যার সমাধান করতে পারেনি তেমনি আন্তর্জাতিক সমালোচনাও প্রশমিত করতে পারেনি।

প্রতিবেদনে বলা হয়ে, সু চি আসলে ভেবেছিলেন কমিশনে আনান ছাড়া বাকি যে বিশেষজ্ঞরা থাকবেন, তারা সবাই মিয়ানমারের নাগরিক হবেন। তবে কফি আনান আর তার ফাউন্ডেশনের তরফ থেকে ওই কমিশনে আরও দুইজন বিদেশি রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়। যাতে করে কমিশনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সদস্যদের ভারসাম্য রক্ষা করা যায়। পরবর্তীতে ছয়জন দেশি আর তিনজন বিদেশি বিশেষজ্ঞ সদস্যকে নিয়ে ওই কমিশন গঠিত হয়। আন্তর্জাতিক কমিশনারদের মধ্যে আফ্রিকা, ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষজ্ঞরা ছিলেন। মিয়ানমারের দেশি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দুইজন জাতিগত রাখাইন ও দুই জন মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্য রাখা হলেও কোনও রোহিঙ্গাকে রাখা হয়নি। এর মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় প্রথমবারের মতো বিদেশি বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করে মিয়ানমার। আনান কমিশন বলছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সদস্যদের সমন্বয় ঘটানোটা কমিশনের জন্য বিরাট শক্তির জায়গা ছিল। এতে সংঘাতের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে।

প্রসঙ্গত, পর্যায়ক্রমে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব নিশ্চিত করাকেই রাখাইন সংকট সমাধানের পথ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনে। তবে রয়টার্সের এক বিশেষ অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, মিয়ানমার আনান কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশ বাস্তবায়নে রাজি থাকলেও সহসা নাগরিকত্ব নিশ্চিতের পদক্ষেপ শুরু করছে না। নাগরিকত্ব নিশ্চিতের পথে ১৯৮২ সালে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনকে বাধা হিসেবে শনাক্ত করেছিল আনান কমিশন। আইনটি সংশোধনের আবশ্যিকতা তুলে ধরা হয়েছিল কমিশনের প্রতিবেদেন। তবে রয়টার্সের বিশেষ অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, গত ৮ জুন ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে মিয়ানমারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী উয়িন মিয়াত পশ্চিমা কূটনীতিকদের জানিয়ে দিয়েছেন, সহসা নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের কোনও পরিকল্পনা তাদের নেই।