আতিকুর রহমান মানিক
সকাল সকাল এয়ারপোর্টে এসে চেক ইন করল কেরামত আলী। পাসপোর্ট-ভিসা-বিমানের টিকেট ইত্যাদি যথাস্হানে প্রদর্শন করার পর বোর্ডিং পাস হাতে পেল সে। এরপর রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় এয়ার লাইন্স “এ্যারোফ্লোট” এর সুপরিসর বিমানে উঠে আসন গ্রহন করল। গন্তব্য রাশিয়ার রাজধানী মস্কো। সেখানে পৌঁছার পর অন্য সবকিছু। ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল খেলা দেখার আমন্ত্রন পেয়েছে সে। ফাইনাল খেলার এখনো কিছুদিন বাকী থাকলেও ফিফা প্রেসিডেন্টের ব্যাক্তিগত আমন্ত্রন পেয়ে একটু আগে-ভাগেই রওয়ানা হয়েছে কেরামত। কিছুক্ষন পর বিমান টেক অফ করে মেঘের রাজ্যে ঢুকে পড়ল।
বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হওয়ার পর দেশে অনেক উম্মাদনাই দেখেছে। পছন্দের টীমের দেশের মাইলতক লম্বা পতাকা বানানো, জার্সি গায়ে চাপানো, পতাকা টাঙ্গানো ইত্যাদি ইত্যাদি। মহল্লার দর্জি কেন্দু মিয়া আগে কেরামতকে দেখলেই সালাম করত। সেদিন দেখেও না দেখার ভান করে হনহন করে হেঁটে গেল। কেন্দু এখন নাকি ভীষন ব্যস্ত। দর্জিগিরি ইঞ্চি-ফুট-গজ পেরিয়ে এখন নাকি মাইল-কিলোমিটারে গিয়ে ঠেকেছে ! বিভিন্ন দেশের মাইলতক পতাকা তৈরীর অর্ডারে নাকি কেন্দুর দম ফেলারও ফুরসত নেই।
মাঝরাতে হঠাৎ একদিন বউয়ের ত্রাহি চিৎকারে ঘুম ভাঙ্গল কেরামত আলীর। মহল্লায় শোরগোল শুনে চোর ডাকাত পড়েছে মনে করে দরজা খুলে বের হল সে তার পিছনে বউ মলকা বানুও বের হল। কিন্তু পাশের বাসার নসরত আলী বলল, বিশ্বকাপ ফুটবলে কোন দেশের টীম নাকি গোল করেছে তাই, সমর্থকরা এভাবে চিল্লাচ্ছে। আর এখন প্রায় প্রতিরাতে হাজারো কন্ঠের মিলিত শ্লোগান ও কোরাস শুনে হতবাক হয় সে। ফেভারিট দেশের সাপোর্টাররা নাকি রাজপথে রীতিমত মিছিল বের করে। মিছিলে হেঁড়ে গলার শ্লোগান, ঢোল তবলা, বাঁশি, সানাই ও রকমারী বাদ্যযন্ত্রের বিকট তালে পাড়া প্রতিবেশীর ঘুৃম হারাম হওয়ার দশা।
তার ক্লাসমেট আবুল ও মকবুল। তাদের মধ্যে বাল্যকাল থেকেই গলায় গলায় ভাব, যেটা এখনো বহাল আছে। সেদিন মহল্লার টি-ষ্টলে আবুলের সাথে বসে চা খাচ্ছিল কেরামত। মকবুল রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কেরামতকে দেখে “দোস্ত কেমন আছিস” বলে এগিয়ে এল। কিন্তু পরক্ষনে আবুলকে দেখেই মুখ গোমড়া করে অন্যদিকে চলে গেল। অনুসন্ধিৎসু কেরামত জানতে পারল, কয়েকদিন আগে নাকি বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আবুল-মকবুলের মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়েছিল। তাই এখন মুখ দেখাদেখি বন্ধ।
গত সপ্তাহে গ্রামের বাড়ী গিয়েছিল কেরামত। সেখানে নাকি কিছুদিন ধরেই বিভিন্ন গৃহস্ত বাড়ীর খোঁয়াড় থেকে মুরগী চুরি হচ্ছিল। তো একরাত্রে কয়েকজন মিলে পাহারা বসাল। মাঝরাতে মুরগী চুরি করতে এসে ধরা পড়ল কয়েক চোর। টর্চের আলো ফেলে দেখা গেল, সবাই গ্রামেরই ছেলে। তাদের মধ্যে আবার গৃহকর্তার এক সন্তানও আছে।
বিশ্বকাপ ফুটবল খেলায় ফেভারিট টীম জেতা না জেতা নিয়ে মুরগী বাজি ধরার জেরেই নাকি এ চুরি !
সাত সমুদ্র তের নদীর ও পাড়ে কোথায় কোন দেশে খেলা হচ্ছে আর এ নিয়ে বাংলাদেশে এত মাতামাতির কারন বুঝতে পারেনা কেরামত। এসব অনর্থক হুজুগেপনা, আদিখ্যেতা, আহামরি কান্ড, উম্মাদনা, লাফালাফি, মাতামাতি ও পাগলামি আর কোথাও অন্যকোন দেশে হয় কিনা কে জানে ?
উড়ন্ত বিমানের সিটে বসে এসবই চিন্তা করছিল কেরামত আলী। কিছুক্ষন পর বিমান ল্যান্ডিং এর ঘোষনা এলে সবাইকে সীটবেল্ট বাঁধতে বলা হল। সীটবেল্ট বাঁধতে গিয়েই বিপত্তিতে পড়ল কেরামত। কোনমতেই যেন সীটবেল্ট জায়গামত লাগাতে পারছিলনা।
“এই কি হয়েছে তোমার, খাটের বেডশীটটা এরকম প্যাঁচাচ্ছ কেন”?
হঠাৎ বউয়ের ঝাঁড়ি শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল তার। আসলে এতক্ষন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল কেরামত। চোখ খুলে দেখল ডানহাতে বিছানার বেডশীট পেঁচিয়ে কোমরের কাছে জড়ো করে ফেলেছে।
কোথায় বিমানের সীটবেল্ট, আর কোথায় বেডশীট। মনে মনে বলল ঘুমভাঙ্গা কেরামত আলী।