কে এম জাহিদুজ্জামান

বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু ও নবজাতকের মৃত্যুর অন্যতম একটি কারন হলো বাড়ীতে অদক্ষ দাই বা ধাত্রী দ্বারা বাচ্চা ডেলিভারী করানো। এখনও প্রায় ৫৩% ডেলিভারী বাড়ীতে হয়ে থাকে (সূত্র: বাংলাদেশ মেটারনাল মর্টালিটি এন্ড হেলথ্ কেয়ার সার্ভে ২০১৬)। ফলে মা ও নবজাতকের মৃত্যুর ঝুঁকির পাশাপাশি নানান ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হয়, এর মধ্যে মায়েদের ‘প্রসবজনিত ফিস্টুলা’ অন্যতম। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৭১,০০০ ফিস্টুলা রোগী বিদ্যমান, যাদের জরুরী ভিত্তিতে ফিস্টুলা সার্জারী করা প্রয়োজন। অন্যদিকে প্রতিবছর প্রায় ২,০০০ জন মা নতুন করে প্রসবজনিত ফিস্টুলা’র শিকার হচ্ছেন (তথ্য: ইউএনএফপিএ রিপোর্ট ২০১০)।

প্রসবজনিত ফিস্টুলা কি ও কেন হয়: অদক্ষ দাই বা ধাত্রী দ্বারা বাচ্চা ডেলিভারী করালে কিংবা প্রসব ব্যথা ১২ ঘন্টার বেশী স্থায়ী হলে বাধাগ্রস্থ প্রসবের কারণে ফিস্টুলা হতে পারে। বাচ্চা প্রসবে বাধাগ্রস্থ হলে এবং দীর্ঘ সময় প্রসব ব্যথা চলতে থাকলে মায়েদের প্রস্রাব ও মল থলিতে অতিরিক্ত চাপ পড়ে। ফলে চাপ পড়া স্থানের দেয়াল ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং ছিদ্র হয়ে যায়। এরপর থেকে প্রসবের রাস্তা দিয়ে অনবরত প্রস্রাব এবং মল অথবা এর যে কোন একটি ঝরতে থাকে, এটাই হলো ফিস্টুলা অর্থাৎ ফিস্টুলা হলে মাসিকের রাস্তা দিয়ে অনবরত প্রস্রাব ও পায়খানা ঝরে বা এর যে কোন একটি ঝরতেই থাকবে।

প্রসবজনিত ফিস্টুলায় আক্রান্তের পরিনতি: ফিস্টুলায় আক্রান্ত মায়েদের শরীর থেকে সারাক্ষন দূর্গন্ধ ছড়ায়। ফলশ্রূতিতে পারিবরিক জীবনে অশান্তির পাশাপাশি তাদের সংসার ভেঙ্গে যায়, সামাজিকভাবে তাদেরকে অবমূল্যায়ন করা হয়, এমনকি তাদেরকে এক ঘরে করে দেয়া হয়। সহায় সম্বলহীন হয়ে অনেকে ভিক্ষাবৃত্তির পথ বেছে নেয় আবার কখনও কখনও তারা মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগতে থাকে।

প্রসবজনিত ফিস্টুলা বিষয়ে কিছু কুসংস্কার: বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলের মানুষ এখনও এই রোগটির কারণ ও প্রতিকার জানেনা বলে এটিকে কেউ কেউ ‘অভিশাপ’ মনে করে। আসলে এটি নিতান্তই প্রসবজনিত জটিলতার ফল। প্রসবজনিত ফিস্টুলা শুধুমাত্র প্রসবজনিত জটিলতার কারনেই হয়ে থাকে।

প্রসবজনিত ফিস্টুলা চিকিৎসা ও পূর্নবাসন: হোপ হসপিটাল অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বিশেষজ্ঞ চিকিসকের মাধ্যমে বিনামূল্যে ফিস্টুলা’র চিকিৎসা সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। হোপ হসপিটালটি মুলত: ‘হোপ ফাউন্ডেশন ফর উইমেন এন্ড চিলড্রেন অব বাংলাদেশ’ এর একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৯ সাল থেকে হোপ হসপিটালটি কক্সবাজারের রামু উপজেলার চেইন্দা মিঠাছড়ি নামক স্থানে কাজ শুরু করেছে। ৪০ শষ্যাবিশিষ্ট হসপিটালটি ২০১১ সাল থেকে যথেষ্ট সুনামের সহিত সম্পূর্ন বিনামূল্যে ৩৯৬ জন মায়েদের প্রসবজনিত ফিস্টুলা সেবা প্রদান করেছে (তথ্য: হোপ হসপিটাল, মে ২০১৮)। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৮০ জন ফিস্টুলা রোগী হোপ হসপিটাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ জীবন যাপন করছে। দিন দিন এই সংখ্যা বেড়েই চলছে। খুব শীগ্রই হোপ ফাউন্ডেশন ফিস্টুলা ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় ৭৫ শষ্যাবিশিষ্ট ‘হোপ মেটার্নিটি এন্ড ফিস্টুলা সেন্টার’ চালু করতে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশে ফিস্টুলা’র অত্যাধুনিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। ইতিমধ্যে যারা এই হসপিটাল থেকে ফিস্টুলা চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ্যভাবে জীবন-যাপন করছেন তাদের মধ্যে প্রায় ১০ জনকে হোপ হসপিটাল কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাদের সামাজিক মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়েছে।

ফিস্টুলা প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন: ‘‘আসুন আমরা সবাই মিলে প্রসবজনিত ফিস্টুলা প্রতিরোধ করি, মায়েদের সুস্থ জীবন যাপন নিশ্চিত করি”- এই শ্লোগানকে সামনে রেখে হোপ ফাউন্ডেশন ইতিমধ্যেই ফিস্টুলা’র চিকিৎসা ও পূর্নবাসনে ব্যাপক কর্মসূচী হাতে নিয়েছে এবং প্রতিটি হেলথ্ কার্যক্রমের সাথেই ফিস্টুলা প্রতিরোধ ও চিকিৎসা বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে প্রচার-প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছে। কক্সবাজার জেলাকে ফিস্টুলা মুক্ত করা ও প্রসবজনিত ফিস্টুলা বিষয়ে সকলকে সচেতন না করা পর্যন্ত হোপ ফাউন্ডেশন কর্তৃক গৃহীত কার্যক্রমসমুহ চলতেই থাকবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট ড: ইফতিখার মাহমুদ। তিনি এই কর্মসুচীর সফল বাস্তবায়নে সমাজের সর্বস্তরের জনগন, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রশাসন এবং সংবাদপত্র-মিডিয়ার সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করেন। তবে ফিস্টুলা প্রতিরোধের এই সামাজিক আন্দোলনে ইতিমধ্যেই কক্সবাজারের শীর্যস্থানীয় সংবাদপত্রের সম্মানীত সম্পাদকমন্ডলী একাত্মতা প্রকাশ করেছেন এবং তারা জনস্বার্থেই ফিস্টুলা বিষয়ক তথ্য তাদের সংবাদপত্রের মাধমে প্রচার করে যাচ্ছেন।

{সার-সংক্ষেপ: যদি কোন প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগীর খোঁজ পান বা সন্ধান পান তবে তাকে দ্রূত হোপ হসপিটাল, চেইন্দা, দক্ষিন মিঠাছড়ি, রামু, কক্সবাজার পাঠিয়ে দিন অথবা রোগীর নাম, ঠিকানা ও যোগাযোগ নং সহ খবর দিলে হোপ ফাউন্ডেশন তার নিজস্ব যানবাহনে বিনা খরচায় হসপিটালে নিয়ে আসবে। হোপ ফাউন্ডেশন সম্পূর্ন বিনামূল্যে ফিস্টুলার চিকিৎসা সেবা প্রদান করছে। যোগাযোগ করুন: ০১৮১৮-৯২৮৪৯৩, ০১৮১৯-৯০৯৩১৮। বিস্তারিত জানতে চাইলে লিখুন: coohopef@gmail.com}