মরহুম আব্দুল কুদ্দুছ কুতুবীর ৮ম মৃত্যুবার্ষিকীর স্মরণে

মো: আকতার হোছাইন কুতুবী :

কেমন আছ তুমি? কোথায় আছ তুমি? শুনেছি মানুষ মারা গেলে তারা হয়ে যায় কিন্তু তুমি-তো তারা হওনি। যদি তারা হতে তবুও তোমায় দেখতে পেতাম কিন্তু তোমাকে-তো আমি দেখতে পাইনা। বলতে পারিনা তোমার জন্য আমার বুকের গহীনটায় কেমন পুড়ে দিবারাত্রি। আচ্ছা, তুমি কি আমায় দেখতে পাও?
এই মাসে তুমি শুধু আমাদেরকেই নয় সমন্ত পৃথিবীকেই বিদায় জানিয়েছ। সকল মায়াজাল ছিন্ন করেছ। আচ্ছা সত্যিই কি তুমি আমাদের ছেড়ে যেতে চেয়েছিলে? মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও কি আমাদের চেহারা ভেসে উঠেছিল? তুমি মারা যাবার আগে কি যেন বলতে চেয়েছিলে বাবা? তা বুঝতে পারেনি। তখনও কি তুমি আমাদের নাম ধরে ডাকছিলে শেষ দেখা দেখার জন্য? মৃত্যু যন্ত্রনা কি খুব বেশি? খুব জানতে ইচ্ছা করে।
তুমি সেদিন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলে তাই অনেক কিছুই দেখতে পাওনি।
তুমি দেখতে পাওনি তোমার জানাযার আগেই মায়ের পড়া ধবধবে সাদা শাড়ির সৌন্দর্যতা। জীবনে এই প্রথম দেখেছি সাদা শাড়ি পড়া নিথর মাকে। হাতে চুড়ি নেই, কানে দুল নেই–এ যেন আমার মা নয়!!! সেই সাদা শাড়ি আজ পর্যন্ত পড়ে চলেছে মা। মার জন্য কোন রঙ্গীন শাড়ি কিনলে পড়ে না। বলে, “এসব আমার জন্য নয়।” কথার মাঝেও যে কতটুকু ব্যাথা জড়িয়ে আছে যদি তুমি শুনতে!!
বাবা, আজ তোমায় অনেক বেশি মনে পড়ছে। মনে পড়ছে পড়ালেখা রেখে খেলার জন্য যে মার দিতে, আদর করে যখন বাবা বলে ডাকতে, গোসল করিয়ে দিতে। তুমি কোথাও গেলে আমাকে নিয়ে যেতে। বাবা তোমার হাতে অনেকদিন কোন মার খাইনা, খুব ইচ্ছা হচ্ছে মার খেতে।
স্কুলে পড়াকালীন সময়ে বেতন দেবার যেদিন শেষদিন সেদিন তুমি আমায় স্কুলে পাঠিয়ে বলতে আমি এসে বেতন দেব। কিন্তু বলতে না আমার কাছে টাকা নেই। আমি ভয়ে থাকতাম যদি টাকা না জোগাড় করতে পার। অবশেষে ঠিকই এসে বেতন দিতে তুমি। আমি সেদিন ঠিকই বুঝতাম তোমার হাতে টাকা নেই বলে স্কুলে এসে বেতন দিতে কিন্তু কিছুই বলিনি।
আমি খুব বেশি খেলাধুলা করতাম। তাই তুমি অনেক রাগ করতে। বাবা, তুমি যখন মা-এর জন্য কোন শাড়ি কিনে এনে দিয়ে বলতে, “জীবনে-তো কোন কিছুই কিনে এনে দিতে পারিনি এই শাড়িটাই নাও।” তখন মা-এর মুখের হাসিটাই ছিলো অন্য সব দিনের থেকে আলাদা। সেইদিন তোমাদের কাউকেই বলতে পারিনি এমনি করে চোখের সামনে থেকো সারাজীবন। জানি বাবা তুমি আর ফিরে আসবে না। অকারণে তবু কেন তোমাকে কাছে ডাকি। তুমি নেই আমাদের মাঝে অনুভব করতেই খুবই কষ্ট লাগে।
বলা যায়, লিখতে পারছিনা। লিখতে বসলেই অজস্র স্মৃতির ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছি আমি। মাথার ভিতর তোলপাড় করছে ঘটনা প্রবাহ। কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখব ভেবে পাচ্ছিনা। তাই বোধহয় এই লেখাটিতে তোমায় কোন সম্ভাষণ জানাতে পারলাম না। কারণ, তোমাকে কোন সম্ভাষণে সম্ভাষিত করবো আমি বুঝতে পারছিনা। যাই করি না কেন তা তোমার জন্য অতি নগন্য হয়ে যাবে।
জানো বাবা, তোমাকে নিয়ে বেঁচে থাকতে এভাবে তো লিখিনি তাই হাতটা কাঁপছে। ঠিকমত লিখতে পারছিনা।
এতদিন তোমাকে নিয়ে লিখিনি। কারণ আমি মনে করি আমার ভিতরেই তো বাবা আছে, আমিইতো বাবা। তাই বাবার কথা আলাদা করে লিখার কিংবা বলার দরকার পড়েনা। তবে জানো আজ তোমাকে নিয়ে খুব লিখতে ইচ্ছে করছে। প্রত্যেকটা সন্তানই বোধ হয় জীবনের একটা পর্যায়ে বাবাকে খুব মিস করে।
বাবার কথা খুব ভাবে। মনে হয় বাবা নামক সেই মানুষটা যদি এই মুহূর্তে আমার মাথায় তার অকৃত্রিম স্নেহের হাতটা বুলিয়ে দিতো সব সমস্যা যেন দূর হয়ে যেত। এখন আমি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছি বাবা। নিজের স্বপ্নের সাথে বাস্তবতার অনেক অমিল তা এখন বুঝতে পারছি। চারদিকে অজ¯্র মিথ্যার ভিড়ে একটা সত্যের পিছনে ছুটছি নিরন্তর। পৃথিবীতে এত মানুষ কিন্তু একজন মানুষই মিলেনা অকৃত্রিম ভালবাসা উপহার দেবার। আর ঠিক তক্ষুনি আমার মনে হয় তোমার কথা। অনেক আনন্দের মুহূর্তে যে মানুষটা অবিচল থেকে আমাকে স্মরণ করে দিয়েছে ভবিষ্যতের কথা। মাঝেমধ্যে তুমি যখন আমার উপর রেগে যেতে তখন বুঝতে পারতাম না বাবা, যে তোমার ঐ কঠিন মাথার ভিতরেও যে পরিমাণ ভালবাসা লুকায়িত ছিলো পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা জড়ো করলেও তার সমতুল্য হতে পারেনা। কিন্তু সেই ভালোবাসা বুঝেছিলাম যেদিন আমি কলেজে ভর্তি হবার জন্য বাড়ি ছেড়ে আসছিলাম সেদিন। বিদায়ের বেলায় আমাকে বলা বারবার যেনো তোমার গলায় কথাগুলো আটকে যাচ্ছিলো। অনেক কষ্টে ভেজা গলায় আমাকে তুমি বলেছিলে ভালো থেকো। তোমার চোখ ছলছল করে উঠছিলো।
তুমি জানোনা বাবা সেদিন সারাক্ষণ তোমার কথা মনে পড়ছিলো। কতবার মনের কান্নায় চোখের কোণ ভিজে গিয়েছিলো তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারবনা। শুধু এতটুকু জানি সেদিন মনে মনে বোধহয় খুব করে বলেছিলাম- বাবা, তোমাকে খুব ভালোবাসি, বাবা। খুব ভালোবাসি তোমাকে। তোমাকে হয়তো মুখ ফুটে কখনো বলা হয় নি কিন্তু তোমাকে খুব ভালোবাসি বাবা। তোমার নিশ্চয় মনে আছে বাবা, আমি খুব দুষ্ট ছিলাম। ছোটবেলায় আমাকে যখন পড়া শেখাতে বসতে তখনতো আমায় খুব মারতে। একটা ভুল হলেই আর রক্ষা নেই। আর তোমার মার থেকে আমাকে আগলে রাখতে গিয়ে মাকে যে কি পরিমাণ বকা খেতে হয়েছে তাতো তুমি জানো। একটা জিনিসকে বারবার অনুশীলনের মাধ্যমে তুমি আমাকে যেভাবে স্বচ্ছ আর দক্ষ করে গড়ে তুলেছিলে তা এখন খুব মনে পড়ে।
এখনতো মনে হয় বাবা তুমি আমাকে আরো বেশি মারলেনা কেনো? তাহলে হয়তো আমার জীবনটা আরো অনেকখানি সুন্দর হতে পারতো। আমার খুব মনে পড়লে বাবা, আমাকে মারার পর প্রতিবারেই তুমি মাকে বলতে দেখ আমার ছেলে নিশ্চয় পারবে। আমার বিশ্বাস আছে ওর প্রতি। পাশের বিছানায় আমার যে তখনো পুরোপুরি ঘুম আসেনি তা তোমরা জানতে না, বাবা। কতদিন তোমাদের কথা শুনে কান্নায় আমি বালিশ ভিজিয়েছি তা তুমি জানো না, বাবা। একটা জিনিস ভেবে এখন খুব মুগ্ধ হই বাবা। ম্যাচের ডাইনিংয়ে ভালো তরকারির নাম করে আণুবীক্ষণিক সাইজের প্রোটিন আর হাত ধোয়া পানির সমতুল্য ডাল দিয়ে খেতে খেতে পাকস্থলী যখন পঁচে যাবার যোগার তখন তোমার কথা খুব মনে পড়ে, বাবা। বাহিরে কোন খাওয়া দাওয়ার আয়োজনে গেলে সেই খাবারের প্যাকেট তুমি বাসায় নিয়ে আসতে।
মাঝে মাঝে এমনও হতো, তোমার হয়তো কোথাও দাওয়াত পড়ে গেছে। তুমি সেখানে যাওয়ার আগে যে করেই হোক ভালো একটা তরকারি মাকে এনে দিতে। তারপর দাওয়াতে যেতে। কারণ, তুমি মনে করতে আমিতো দাওয়াতের বাড়িতে ভালোই খাবো কিন্তু আমার সন্তানদের জন্যও তো ভালো কিছু করা দরকার। আমি দেখতাম আমরা চার ভাইয়ের কেউ অসুস্থ হলে বাসায় ভালো কোনো তরকারি রান্না হতোনা। তুমি বলতে ছেলেটা অসুস্থ আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে না। বাবা, তুমি এতো ভালো কেনো? কতবার যে বড়াই করে ভেবেছি তোমার কাছ থেকে আর একটা পয়সাও নিবোনা। নিজে যেভাবে হোক চলবো। তবু তোমার কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে তার জন্য এতো কথা শুনতে পারবোনা। কিন্তু আমি পারিনি, বাবা। রাগ কেটে যাবার পরই আবার আমাকে নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখেছো তো।
স্বপ্ন বিলাসী মন নিয়ে হেঁটে চলেছি একা স্বপ্ন আধো ঘুম-জাগরণে আমার করে দেখা সারা শরীর জুড়ে স্বপ্নরা নিশ্চুপ হেঁটে বেড়ায় ছুঁতে গেলে স্বপ্ন নিকষ কালো আঁধারে হারায়। প্রতিটি রাত-ই আমার কাটে গভীর ঘুমে ঘুমে স্বপ্ন তখন হামলে পড়ে আমার জ্বলন্ত মোমে কখনো নিভুনিভু আলোয় এসে হাতটি ধরে আবার ঝাঁঝা রোদের তেজ নিয়ে আসে।
আজ আমার বাবার ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১১ সালের ঠিক এমন একটি দিনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যান। বাবাকে হারিয়ে আমি পাথর হয়ে গেছিলাম। আজ বাবার সাথে পথ চলার সময়গুলকে অনুভব করছি, চলার জীবনে বাবার ছায়াতেই বড় হয়েছি, বাবার ভালোবাসা, বাবার স্নেহ, বাবার আদর আজও আমার স্মৃতিতে সতেজ হয়ে ভাসে। আমার বাবা ছিলেন আমার আর্দশ। আজ বাবাকে আমার খুব প্রয়োজন ছিলো বাবার সাথে আমার অনেক কথা বলার ছিলো আমি বলতে পারিনি তাই মনের লুকানো কথাগুলো আজও কারো সাথে ভাগাবাগি করতে পারিনি। বাবার আর্দশ, বাবার সততা, বাবার নৈতিকতা আমার কাছে অতুলনীয়। যাদের বাবা আছে তারা জানেনা বাবার ছায়াটা কতটা তার সন্তানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ । বাবাহীন পৃথিবীটা বেশ অদ্ভুত! যাদের বাবা নেই তারা কেবল জানেন বাবার অনুপুস্থিতিটা কেমন। এক সময় বাবার বুদ্ধিছাড়া কোন কাজেই সফল হওয়া যেতো না, আর আজ বাবাকে ছাড়া চলতে হচ্ছে প্রতিটা মুহূর্ত। বুদ্ধিহীন অবস্থায় চলতে হচ্ছে এই অচেনা জীবন শহরতলীতে। কিন্তু বাবার সেই স্মৃতি বাবার সেই উপদেশমূলক কথাগুলো আজও আমার অন্তরকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে যায়! যার আদর্শ আমাকে মানুষ হতে সাহায্য করছে। বেশ কিছু আশা, স্বপ্ন, কাজ অপূর্ণ থেকে গেল আমার। পরিশেষে আমার বাবার জন্য সবাই দোয়া করবেন। আল্লাহপাক যেন জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে আমার বাবাকে স্থান করে দেন।
এই কামনায়।

 

 

 

 

 

 

 

 

মরহুম মো. আব্দুল কুদ্দুছ কুতুবী বড় ছেলে
মো. আকতার হোছাইন কুতুবী, সহ-সম্পাদক, জাতীয় দৈনিক আমার ও দি গুড মর্নিং।
প্রধান সম্পাদক-জাতীয় ম্যাগাজিন জনতার কণ্ঠ এবং উপদেষ্টা সম্পাদক-জাতির আলো, ঢাকা।