রিয়াজুল হক

ছোটবেলায় জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই দেখতাম, মা সব সময় মাছের মাথা কিংবা দুটি ডিম একসঙ্গে ভাজি করে আব্বুর প্লেটে দিচ্ছেন। আব্বু সেখান থেকে আমাদের প্লেটে একটু একটু দিতেন। আমরা তাতেই খুব খুশি ছিলাম। আব্বুর সামনে আমরা তো দূরের কথা, ছোট চাচা, ফুফু, মা কেউ উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতেন না। এর মানে এই না যে আব্বু খুব গম্ভীর ছিলেন বা আমাদের সঙ্গে মজা করতেন না। তবে ছোটবেলা থেকেই একটা বিষয় বুঝে গিয়েছিলাম আব্বুর সামনে কোনো বেয়াদবি করা যাবে না। তিনি ঘরের সব থেকে সম্মানীয় ব্যক্তি। আবার যখন বাসায় দাদা থাকতেন তখন দেখতাম মাছের মাথা দাদার প্লেটে চলে গেছে। অর্থাৎ একটা চেইন অব কমান্ড এখানে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পরিবারে মুরব্বিরা সব সময় বেশি সম্মানীয় হবেন। কিন্তু সময় এখন পাল্টে গেছে। সংসারের ছোট সদস্যটি হবে সবচেয়ে আদরের। কিন্তু তাকে আমরা ভুল করে বেশি সম্মানীয় করে ফেলেছি। পরিবারের চেইন অব কমান্ড আমরা নষ্ট করে ফেলেছি। সন্তানকে সোনার টুকরা, রুপার টুকরা, হীরার টুকরা বলতে বলতে তাকে নৈতিকতা, সৌজন্যবোধ, ভদ্রতা—এসব শিক্ষা দিচ্ছি না। তাকে ছোটবেলা থেকেই অতিরিক্ত মাত্রায় প্রশ্রয় দিতে দিতে শাসনের কথাও ভুলে যাচ্ছি। সারা দিন প্রাইভেট ফার্মের বিক্রয় বিভাগে চাকরি করার পর যেকোনো কারণবশত ছেলের খেলনা কিনে দিতে দেরি হওয়ায় মা যখন ছেলের সামনেই বাবাকে বলে ওঠেন, ছেলের জন্যই যদি সময় করে উঠতে না পারো, তবে তোমার চাকরি করে কী হবে? মনে রাখবেন, এতে সন্তানকে এক ধাপ বিপথে ঠেলে দিলেন। এরপর হয়তো সন্তানই তার বাবাকে বলে উঠবে, ‘তুমি আমার জন্য কী দায়িত্ব পালন করেছ? তোমার তো সামান্য খেলনা কেনারই সময় ছিল না।’

পরিবারে জবাবদিহি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছোট থাকতে খেয়াল করতাম, দাদি কোথাও যেতে চাইলে দাদার অনুমতি নিতেন। অনুমতি বলতে জানিয়ে যেতেন। দাদা না থাকলে আব্বুকে বলে যেতেন। মায়ের ক্ষেত্রেও তা-ই দেখতাম। বিকেলে আমরা যখন খেলতে যেতাম, তার আগে আব্বার অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। আব্বা বাসায় না থাকলে কিংবা ঘুমিয়ে থাকলে মায়ের কাছে অনুমতি নিতাম। খেলতে যাওয়ার আগেই মা জানিয়ে দিতেন, মাগরিবের আজানের আগেই যেন বাসায় চলে আসি। স্কুলে পড়ার সময়ে সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরেছি বলে মনে পড়ে না।

আপনার সন্তান মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ে। প্রাইভেট পড়তে যাবে। এখন তার বায়না মোটরবাইক কিনে দিতে হবে। এতে তার প্রাইভেট পড়তে যেতে সুবিধা হবে। কী সুন্দর মন-ভোলানো কথা! এই চাহিদা পূরণ করে আপনি আপনার সন্তানকে অহেতুক ভোগবিলাসের পথে ঠেলে দিচ্ছেন। বিভিন্ন বেয়াড়া ছেলের সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় বাইক চালিয়ে ঘুরে বেড়াবে। সন্তান বেয়াড়া হওয়ার প্রাথমিক শিক্ষা আসলে পরিবার থেকেই পেয়ে যাচ্ছে। ছেলেকে বাইক কিনে না দিলে সে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেয়, সঙ্গে মা খাওয়া বন্ধ করে দেন। বাবার সঙ্গে ছেলে ও মা কেউ কথা বলেন না। এটা এখন অনেক জায়গায় পারিবারিক ঐতিহ্য হয়ে গেছে। তবে আপনার সন্তান কী শিখবে?

আমাদের মায়েরা এখন শিক্ষিত। তবে সন্তানদের ক্ষেত্রে তাঁরা ভুলগুলো একটু বেশি করে থাকেন। মায়েরা চাকরি করেন। হাতে টাকা আছে। সন্তান যদি এক বেলা না খেয়ে আইফোন কিনে দেওয়ার জেদ ধরে, মায়েরা কিনে দিচ্ছেন। এতে কি সন্তানের মঙ্গল হচ্ছে? আসলে অমঙ্গল ডেকে আনা হচ্ছে। এরপর মোবাইল ফোনের মডেল পরিবর্তনের বায়না ধরবে। আসলে আপনি যদি আপনার সন্তানের প্রয়োজন এবং আপনার সামর্থ্য তাকে বোঝাতে না পারেন, তবে আপনি কোনো কিছু কিনে দিয়ে সন্তানের মন দীর্ঘ মেয়াদে জয় করতে পারবেন না। মা-বাবা সন্তানকে ভালোবাসবেন, এটাই স্বাভাবিক। প্রত্যেক মা-বাবার কাছে সন্তান অনেক আরাধ্য। সন্তানের জন্যই মা-বাবা সব ধরনের কষ্ট করে থাকেন। তবে সন্তানের জন্য অহেতুক ব্যয় করা থেকে বিরত হোন। যার কোনো প্রয়োজনই নেই, আপনার সন্তান যদি খুব ছোট বয়সেই সেসব জিনিস পেয়ে যায়, তবে সে বাস্তবতাবিবর্জিত হয়ে বেড়ে উঠবে। তার মধ্যে লোভ তৈরি হয়ে যাবে। এটা তার জন্য কল্যাণকর হবে না।

অনেকেই বাচ্চাকে শান্ত রাখার জন্য টেলিভিশনের সামনে বসিয়ে রাখেন। এতে আপনার সন্তান সাময়িক সময়ের জন্য শান্ত থাকছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এর ফল অতিশয় খারাপ। কারণ খুব ছোট বয়সে টেলিভিশনের প্রভাব তার ওপর পড়ে যায়। আপনার সন্তান মাদকসেবী। আপনার দিনরাতের ঘুম হারাম। অথচ এক দিনে আপনার সন্তান এই বিপথে পা বাড়ায়নি। যখন দিনের পর দিন বাইরে থেকেছে তখন তার কোনো খোঁজ নেননি। যখন আসক্তির শেষ পর্যায়ে তখন আপনার টনক নড়েছে। আমরা সন্তানদের ছোট থাকতে নৈতিকতার শিক্ষা দিই না। ভালো-খারাপের পার্থক্য বোঝাই না।

সন্তানদের কথা বিবেচনা করেই কিছু বিষয় মেনে চলা উচিত।

এখন অনেকের কাছেই শোনা যায়, সন্ধ্যায় বাবা অফিস থেকে ঘরে ঢুকলে আদরের সন্তান বাবার মুখের দিকে তাকায় না, হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী এনেছে তা দেখার জন্য। এটা মা-বাবাদের ভুল। বেশি ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে সন্তানের সর্বনাশ ডেকে আনছি। সন্তানকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সহায়তা করুন। এখন অনেক ধনী পরিবারের স্কুলের ছেলেরা বিভিন্ন গ্যাং তৈরি করছে। পরিবারের মধ্যে খেয়াল করারও কেউ নেই। ১০-১২ বছরের ছেলেরা বিভিন্ন আজব স্টাইলে চুল কাটছে, পরিবারের কেউ কিছু বলছে না। স্কুলের শিক্ষার্থী রাত ১০টার পর বাসায় ফিরছে, বলার কেউ নেই। বাবা কিছু বললে মা রেগে সন্তানের পক্ষ নিচ্ছেন কিংবা মা কিছু বললে বাবা সন্তানের পক্ষে চলে যাচ্ছেন। এতে সন্তান প্রশ্রয় পাচ্ছে।

মা-বাবা যদি সন্তানকে প্রথম থেকেই বুঝিয়ে দিতেন, এভাবে চুল কাটা যাবে না কিংবা এভাবে রাত করে ঘরে ফেরা যাবে না। তাহলে সন্তান বুঝে যেত, এটা তার ভুল হয়েছে। ছোট ছোট ভুল যদি সংশোধন করে না দেন, তবে পরবর্তী সময়ে বড় ধরনের অন্যায় সংশোধন করার মতো ক্ষমতা আপনার হাতে আর থাকবে না। সন্তান বেপরোয়া হবেই। এখন সমাধান আপনার হাতে, কিভাবে সন্তান মানুষ করবেন। তবে পরিবারের চেইন অব কমান্ড খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি প্রতিটি পরিবারেই থাকা উচিত। নিজেদের জন্য না হোক, সন্তানের জন্য বজায় রাখুন।

লেখক : উপপরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক
সূত্র : কালের কন্ঠ