ডেস্ক নিউজ:

ভয়ঙ্কর কিশোর প্রজন্ম!
ব্যাংক কর্মকর্তা হত্যায় জড়িত প্রতীক মজুমদার (১৬), জিকু রায় (১৭) ও জয় বড়ুয়া (১৯)

ভয়ঙ্কর সব অপরাধে কিশোরদের সম্পৃক্ততা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। দেশজুড়ে হত্যা, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, চাঁদাবাজিসহ ছোটখাটো নানা অপরাধে জড়াচ্ছে উঠতি বয়সীরা। গত ছয় মাসে চট্টগ্রামে চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের চারটি ঘটে ভয়ঙ্কর এ কিশোর প্রজন্মের হাত ধরে।

কিশোর অপরাধের নৃশংসতার মাত্রা তাদের মূল্যবোধ ও মানবিকতাবোধকে নতুন করে প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে।

jagonews24

এক হিসাব অনুযায়ী, দেশের দুই কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ খুনের মামলায় অভিযুক্ত। ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার আসামি। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলাগুলোর বেশির ভাগই ধর্ষণের অভিযোগে করা।

সম্প্রতি চট্টগ্রামে ব্যাংক কর্মকর্তা খুনের ঘটনায় তিন কিশোরকে গ্রেফতার করা হয়। গত ১ জুন তারা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. আল-ইমরান খানের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তাদের জবানবন্দিতে চাঞ্চল্যকর ও নৃশংস তথ্য ওঠে আসে। কিশোরদের মুখে নির্মম ওই বর্ণনা শুনে যে কারো মনে প্রশ্ন জন্ম নিতেই পারে কতটা ভয়ঙ্কর পথে হাঁটছে আমাদের কিশোর প্রজন্ম!

ব্যাংক কর্মকর্তা হত্যার তদন্ত করা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক (মেট্রো) সদীপ কুমার দাশ জানান, ঘটনার দিন (২৭ মে) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে প্রতীক, জয় ও জিকু নামের তিন কিশোর ওই বাসায় যায়। বাসায় প্রবেশের পরপরই পরিকল্পিতভাবে সাইকেলের বিষয় নিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তা সজলের সঙ্গে কথা কাটাকাটি শুরু করে প্রতীক। তখন জিকু সজলের মাথায় তালা দিয়ে আঘাত করে। সজল চিৎকার দিলে প্রতীক তার মুখ চেপে ধরে। জিকু ও জয় মিলে গামছা দিয়ে সজলের পা বেঁধে ফেলে। এরপর জয় ছোরা দিয়ে সজলকে গলা কেটে হত্যা করে।

‘এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ উল্লেখ করে সদীপ কুমার দাশ বলেন, ‘নিহত ব্যাংক কর্মকর্তা সজল নন্দীর ছেলে সৈকত নন্দী ও প্রতীক মজুমদার একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়ে। সে সুবাদে তারা পরস্পর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সম্প্রতি সজল নন্দী গৃহনির্মাণ বাবদ ব্যাংক থেকে ২৯ লাখ টাকা ঋণ পান। সৈকত একদিন কথাচ্ছলে বিষয়টি প্রতীককে জানায়। সৈকতের কাছ থেকে টাকার বিষয়টি জানার পর সেই টাকা হাতিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করে প্রতীক। প্রথমে সে বিষয়টি তার অপর দুই বন্ধু জয় ও জিকুকে জানায়। তারপর তিনজন মিলে সেই ২৯ লাখ টাকা লুটের পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা নতুন ছুরিও কেনে।’

এর আগে ২১ মে, সোমবার জিমনেসিয়ামের গেট খোলা নিয়ে বিরোধের জেরে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার মোহরা রাস্তার মাথা এলাকায় সমবয়সী বন্ধুর ছুরিকাঘাতে নিহত হয় আরাফাত (১৭) নামে এক কিশোর। ২৬ মে ঘাতক আরমান চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আল ইমরান খানের খাস খামরায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেয়।

আরমান আদালতকে জানায়, জিমের কর্তৃত্ব নিয়ে আরাফাতের সঙ্গে বিরোধ শুরু। পরে আরাফাতকে শায়েস্তা করতে আরমান ও তার বন্ধু বাপ্পী, আসিফ এবং অজ্ঞাত আরও কয়েকজন মিলে আরাফাতকে খুনের পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মতো ২১ মে আরাফাত ব্যায়াম শেষে চলে যাওয়ার সময় মোহরা রাস্তার মাথা এলাকায় আরমান উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে খুন করে আরাফাতকে।

এরও আগে ২ মে নগরীর পতেঙ্গা সৈকত থেকে সানসাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী তাসফিয়া আমিনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতের পরিবারের অভিযোগ, স্কুলছাত্রীর ‘প্রেমিক’ নির্যাতনের পর তাকে হত্যা করে। ওই ঘটনায় নিহতের বাবা মোহাম্মদ আমিন বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। মামলায় কথিত প্রেমিক আদনান মির্জাসহ ছয়জনকে আসামি করা হয়।

চলতি বছরে ১৬ জানুয়ারি খুন হয় নগরীর কলেজিয়েট স্কুলের মেধাবী শিক্ষার্থী আদনান ইসফার (১৫)। আদনান হত্যায় জড়িত আরমান, সাব্বির, মুনতাসির, মহিম ও আবু সাঈদ চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের কর্মী। এছাড়া গত ১৬ ফেব্রুয়ারি নগরীর মুরাদপুরে গ্যাংস্টার সদস্যদের ছোড়া গুলিতে আহত হন সিএমপির এএসআই আবদুল মালেক। ওইদিন রাতে গ্রেফতার করা হয় দুই কিশোরকে। তাদের দুজনই এসএসসির পরীক্ষার্থী ছিল।

অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা কিশোর অপরাধ প্রসঙ্গে বলছেন, আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, আকাশ সংস্কৃতি ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা বা তথ্যপ্রযুক্তি কিশোরদের অপরাধপ্রবণতা বাড়ার অন্যতম কারণ।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার আসিফ মহিউদ্দিন বলেন, ‘কিশোরদের নিয়ন্ত্রণ করতে বাবা-মা ও শিক্ষকরা ব্যর্থ হচ্ছেন। মোবাইল ও ইন্টারনেট কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা রাখছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিশোরদের বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতার অভাব আছে। তারা যে অপরাধ করছে, সেই অপরাধের ফলে কী হবে সেটা তারা চিন্তা করে না। রাজনৈতিক দলের কথিত ‘বড় ভাইদের’ কথায় অসংখ্য কিশোর অপরাধে জড়িয়ে নিজেদের জীবন নিজেরাই ধ্বংস করে ফেলছে।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি লাইলুন নাহার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা মনে করি পরিবারের অভিভাবকদের উদাসীনতার কারণে কিশোর অপরাধ বাড়ছে। বাড়ছে তারুণ্যের অবক্ষয়ও। বর্তমান রাজনীতি ও অবক্ষয়গ্রস্ত সমাজও এজন্য কম দায়ী নয়।  সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয়, বেকারত্ব, অনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব, অনলাইন প্রযুক্তির কু-প্রভাব, পর্নোগ্রাফির প্রসার, অনৈতিক জীবনযাপন, পাচার, বিরোধ-শত্রুতা, ব্যক্তি স্বার্থপরতা, লোভ, সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি এ জন্য দায়ী। এ অবস্থার জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থাও কম দায়ী নয়।’

তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি পাল্টাতে হলে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনকে আরও জোরদার, স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে কাউন্সিলিং, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ছাড়াও সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে আরও সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘কিশোরদের মধ্যে স্মার্টফোনের নেশা আছে। এ নেশার ফলে অকালেই তাদের মনের কোণে বাসা বাঁধছে ‘নোমোফোবিয়া’ নামের এক নীরব ঘাতক। এর ক্ষতিকর প্রভাবে ছোট-বড় সবার মধ্যে অন্য কোনো বাহ্যিক কারণ ছাড়াই অকালে দেদারছে বাড়ছে ডিপ্রেশন (অবসাদ), উৎকণ্ঠার (অ্যাংজাইটি) মতো মানসিক রোগ। যার জেরে কিশোরদের মধ্যে বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা।’

তিনি বলেন, ‘কিশোরদের পরিবার সময় দিচ্ছে না। হাতে তুলে দিচ্ছে মোবাইল। ইন্টারনেটের আসক্তির ফলে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে তারা। সেখানে অপরাধের নানা কৌশল শিখছে। বিভিন্ন পর্নো সাইটে তারা প্রবেশ করছে। এছাড়া যত ধরনের ভিডিও গেম আছে প্রায় সবগুলোই যুদ্ধ, মারামারিবিষয়ক।’

‘অল্প বয়সে খুন, মারামারি- এসব বিষয়ের সঙ্গে একজন কিশোর পরিচিত হচ্ছে। এ ধরনের গেমগুলো কিশোর মনে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করছে। এছাড়া সামগ্রিকভাবে সমাজের মধ্যে মূল্যবোধের বড় ধরনের অবক্ষয় হয়েছে। এটা কারো অস্বীকার করার সুযোগ নেই।’