ইমাম খাইর, মদিনা শরিফ থেকে:
মদিনা মোনাওয়ারায় অবস্থিত ঐতিহাসিক কবরস্থান জান্নাতুল বাকি। যেটাকে আরবীতে বলা হয়- বাকিউল গারকাদ। যা মদিনাবাসীর কাছে ‘বাকি কবরস্থান’ নামে পরিচিত। জান্নাতুল বাকি মসজিদে নববীর পূর্ব দিকে অবস্থিত।

প্রবেশ পথের বাম পাশে জলিলুর কদর সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালেক (র) এর কবর। নেমপ্লেটে তা দৃশ্যমান। ডান পাশে জিয়ারতের নির্দেশনা সম্বলিত সাইনবোর্ড চোখে পড়বে।

তবে, জান্নাতুল বাকিতে মাত্র কয়েকজন সাহাবী ছাড়া আর কারো নেমপ্লেট নেই। এখানে প্রায় দশ হাজার সাহাবার কবর রয়েছে বলে রেওয়ায়েত আছে।

জান্নাতুল বাকিতে নবী করিম (সা.)-এর পরিবারের অধিকাংশ সদস্য থেকে শুরু করে, সাহাবা, পীর-আউলিয়া, গাওস-কুতুব, বুজুর্গ এবং প্রচুর মুসলমানের কবর বিদ্যমান। তবে কোন কবরে নাম লিখা নাই।

ইতিহাসের পাতা থেকে যতটুকু জানা যায়, এই কবরস্থানের গোড়াপত্তন ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রায়ই শেষ রাতে জান্নাতুল বাকিতে যেতেন এবং দোয়া করতেন। দোয়ায় নবী করিম (সা.) বাকি কবরবাসীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন।

হাদিসে আছে, হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) শেষ রাতে বাকির দিকে বেরিয়ে যেতেন। বলতেন, ‘হে (কবরের) মুমিন সম্প্রদায়! তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। তোমাদের নিকট এসেছে যা তোমাদেরকে ওয়াদা দেওয়া হয়েছিল। কাল কিয়ামত পর্যন্ত তোমরা অবশিষ্ট থাকবে এবং ইনশাআল্লাহ নিশ্চয়ই আমরাও তোমাদের সঙ্গে মিলিত হবো। হে আল্লাহ! তুমি বাকিউল গারদবাসীদের ক্ষমা করে দাও।’ –সহিহ মুসলিম

কবর জিয়ারত করা প্রত্যেক স্থানেই শরিয়তসম্মত। এ বিষয়ে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) হাদিসে ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা কবর জিয়ারত করো, কেননা তা তোমাদের মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেবে।’ –সহিহ মুসলিম

জান্নাতুল বাকিতে যাদের কবর রয়েছে তন্মধ্যে- নবী কন্যা হজরত ফাতেমা (রা.), ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান (রা.), উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.), নবীর চাচা হজরত আব্বাস (রা.), নবী পুত্র হজরত ইবরাহিম (রা.), দৌহিত্র হজরত হাসান (রা.), হজরত উসমান (রা.), নবী কন্যা হজরত রোকাইয়া (রা.), বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.), হজরত সাআদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.), হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.), নবীর দুধমা হজরত হালিমা সাদিয়া (রা.) প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মদিনায় অবস্থানরত হজপালনকারীদের মৃত্যু হলে এই কবরস্থানে দাফন করা হয়। সেই সঙ্গে মদিনাবাসী এখানে দাফনের সুযোগ পান। এখনও প্রতিদিন এখানে লাশ দাফন করা হয়। তবে বাকি কবরস্থানের শুরুর অংশে এখন আর নতুন করে কাউকে কবর দেওয়া হয় না। কারণ এসব অংশেই রয়েছে সাহাবাদের কবর।

জান্নাতুল বাকী জিয়ারতের জন্য ফজর ও আসরের নামাজের পর খুলে দেওয়া হয়। ফজরের পর ৩ ঘন্টা, আসরের পর ১ ঘন্টা। তখন শুধু পুরুষরা জিয়ারতের জন্য ভেতরে যেতে পারেন। কারণ, নারীদের জন্য ইসলামি শরিয়তে কবর জেয়ারত করা বৈধ নয়। প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ আলাদা। বিরাট আয়তনের জান্নাতুল বাকির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। নিয়োজিত নিরাপত্তাকর্মী যথেষ্ট আন্তরিক।

ইসলামি স্কলারদের মতে, জান্নাতুল বাকিতে সমাহিতদের প্রতি সালাম দেওয়ার সুন্নত পদ্ধতি হলো- অনির্দিষ্টভাবে সবাইকে একসঙ্গে সালাম দেওয়া ও তাদের জন্য দোয়া করা।

ওসমানি খেলাফতের সময় এবং এরও আগে জান্নাতুল বাকিতে অবস্থিত সাহাবিদের কবরের ওপর নানা ধরনের স্থাপনা ছিল। পরে কবরকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের কুসংস্কার চালু হয়। পরবর্তীতে সৌদি আরব সরকার এসব স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়। বর্তমানে জান্নাতুল বাকির কোনো কবরে নামফলক নেই। কোনটা কার কবর তাও নির্দিষ্ট করা নেই।

তারপরও মদিনার বয়স্ক ও অনুসন্ধানীদের কাছে জিজ্ঞেস করলে দু’একটি কবরের কথা তারা বলতে পারেন।

যেমন, জান্নাতুল বাকিতে প্রবেশের মুখে আলাদা করে ঘেরাও করে রাখা কবর দু’টো।

এই দুই কবরের একটি হজরত ফাতেমা (রা.), অপরটি হজরত আয়েশা (রা.)।
কবরস্থানের একেবারে শেষ মাথায় রয়েছে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান (রা.)-এর কবর।

জান্নাতুল বাকিতে কবর হলেই, তার জন্য বেহেশত ওয়াজিব। এখান থেকে কিয়ামতের দিন সত্তর হাজারের একটি দল পুনরুত্থিত হবে; যারা বিনা হিসেবে বেহেশতে যাবে। এমন কথার ভিত্তি ইসলামে নেই। বস্তুত প্রত্যেককে তার আমল অনুযায়ী প্রতিদান দেওয়া হবে।