শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

জাকাত মানে পবিত্রতা ও প্রবৃদ্ধি, রমাদান মানে আগুনে পুড়ে সোনা খাদমুক্ত খাঁটি করা। রমাদানের সঙ্গে জাকাতের সুনিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আল-কোরআনে নামাজের নির্দেশ যেমন ৮২ বার রয়েছে, অনুরূপ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জাকাতের নির্দেশনাও রয়েছে ৮২ বার। ‘জাকাত’ শব্দ দ্বারা ৩০ বার, ‘ইনফাক’ শব্দ দ্বারা ৪৩ বার এবং ‘সদাকা’ শব্দ দ্বারা ৯ বার। ইনফাক শব্দটি ব্যাপক, সদাকাহ শব্দটি সাধারণ ও জাকাত শব্দটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো এর ব্যতিক্রমও হয়েছে, অর্থাৎ এ তিনটি শব্দ একে অন্যের স্থলে ব্যবহার হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা কোরআন মজিদে বলেন: ‘মুত্তাকিগণ জান্নাতে ফোয়ারার নিকটে থাকবে। তারা গ্রহণ করবে যা তাদের পালনকর্তা তাদেরকে দেবেন। নিশ্চয় ইতিপূর্বে তারা ছিল সৎকর্মপরায়ণ, তারা রাত্রির সামান্য অংশেই নিদ্রা যেত, রাতের শেষ প্রহরে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং তাদের ধনসম্পদে ছিল প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক বা ন্যায্য অধিকার।’ (সুরা-৫১ জারিয়াত, আয়াত: ১৫-১৯)।
প্রয়োজনের অধিক ‘নিসাব’ পরিমাণ (সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্য) বা তদূর্ধ্ব পরিমাণ অর্থসম্পদ (সোনা, রুপা, নগদ টাকা ও ব্যবসাপণ্য) কারও কাছে এক বছর থাকলে তাকে তার বর্ণিত খাতসমূহের সমুদয় অর্থসম্পদের ২.৫% (আড়াই শতাংশ তথা চল্লিশ ভাগের এক ভাগ) জাকাত প্রদান করা ফরজ। ঋণ থাকলে তা বাদ দিয়ে হিসাব করতে হবে। অনুরূপ বর্তমান মাসের যাবতীয় খরচও বাদ রাখবে। কারও ওপর জাকাত ফরজ অবস্থায় তার মৃত্যু হলে, প্রথমে তার সম্পদ থেকে জাকাত আদায় করতে হবে। অবশিষ্ট সম্পদ যথারীতি ব্যবহার ও বণ্টন হবে। (জাকাত নির্দেশিকা, পৃষ্ঠা: ১২৮)।

সদাকা, জাকাত ও ইনফাক সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সর্বোচ্চ বর্ণনায় আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ (হে রাসুল!) তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে, কী দান করবে? আপনি বলুন, যা তোমার প্রয়োজনের অধিক অথবা যতটুকু দান করলে তোমার অসুবিধা না হয়।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২১৯)।

যেসব গাড়ি ব্যবহারে ভাড়ায় বা ব্যবসায়িক কাজে নিয়োজিত, সেসবের মূল্য হিসাব করতে হবে না; তবে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে রাখা গাড়ির মূল্য হিসাব করে জাকাত প্রদান করতে হবে। অনুরূপ যেসব বাড়ি, ফ্ল্যাট বা জমি বসবাসের জন্য, ভাড়া দেওয়ার জন্য বা ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহারের জন্য অথবা স্থায়ী সম্পদ হিসেবে রাখা আছে তার মূল্য ধরতে হবে না; তবে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে রাখা বাড়ি, ফ্ল্যাট বা জমির মূল্য ধরে জাকাত দিতে হবে।

জাকাত ও সদকাতুল ফিতর ব্যয়ের আটটি খাত রয়েছে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মূলত সদকাত হলো ফকির, মিসকিন, জাকাতকর্মী ১, অনুরক্ত ব্যক্তি ও নওমুসলিম, ক্রীতদাস, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আল্লাহর পথে জিহাদ ও বিপদগ্রস্ত বিদেশি মুসাফিরের জন্য। এটি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞানী ও পরম কৌশলী।’ (সুরা-৯ তাওবাহ, আয়াত: ৬০)।

জাকাত ও সদাকাতুল ফিতর প্রদানে যাদের অগ্রাধিকার দেওয়া উত্তম তাদের প্রসঙ্গটি পবিত্র কোরআনে ঘোষণা হয়েছে, ‘এমন অভাবী লোক যারা আল্লাহর পথে নিজেদের নিয়োজিত রাখার কারণে (উপার্জনের জন্য) দুনিয়া চষে বেড়াতে পারে না। সম্ভ্রান্ততার কারণে অনভিজ্ঞ লোকেরা তাদের অভাবহীন মনে করে। আপনি তাদের চিহ্ন দেখে চিনতে পারবেন। তারা মানুষের কাছে নির্লজ্জভাবে ভিক্ষা করে না। আর তোমরা যে কোনো উত্তম জিনিস ব্যয় করো, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা সে বিষয়ে অবগত আছেন।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৭৩)।

জাকাত ও সদকাতুল ফিতর যাঁদের দেওয়া যায় না তাঁরা হলেন: ১. পিতা-মাতা (ঊর্ধ্বতন পুরুষ), ২. ছেলেমেয়ে (অধস্তন পুরুষ), ৩. ধনী লোক (নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক), ৪. সায়্যিদ (হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রকৃত বংশধর), ৫. অমুসলিম।

জাকাত প্রদান করতে গিয়ে আত্মপ্রচারণা ঠিক নয়। ব্যানার ঝুলিয়ে মাইকিং করে জাকাত প্রদান করা মোটেই সুন্নতসম্মত নয়। জাকাত প্রদান করতে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায়ভার জাকাত দাতাকেই নিতে হবে। যথা: কেউ আহত হলে তার চিকিৎসা ব্যয় ও পরিবারের ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব নিতে হবে। কেউ নিহত হলে; ‘কতলে খতা’ বা অনিচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডের জন্য তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক