হাফিজুল ইসলাম চৌধুরী :

স্বপ্ন নয়, সত্যি। অবশেষে মহাকাশে ডানা মেললো বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। গত ১২মে শুক্রবার বিকাল ৪টা ১৪ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের অরল্যান্ডোর কেনেডি স্পেস সেন্টারের কেপ কেনাভেরাল থেকে সম্পূর্ণ নতুন একটি ফ্যালকন-৯ রকেটের মাধ্যমে এটি উৎক্ষেপণ করে মহাকাশ অনুসন্ধান ও মহাকাশ যান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান স্পেস এক্স। মাত্র ৩ মিনিটের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ রকেট ফ্যালকন-৯ মহাকাশে পৌঁছে যায় এবং তা নির্ধারিত প্যাডে ফেরত আসে। স্পেস এক্স জানিয়েছে, উৎক্ষেপণ সম্পূর্ণ নির্ভূল ছিল। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের ৫৭তম স্যাটেলাইটের অধিকারী দেশ হলো বাংলাদেশ।

দেশের এই অর্জনে বিশ^জুড়ে প্রশংসাবানে ভাসছেন প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, পেনসিলভেনিয়া, ভার্জিনিয়া, বস্টন ও ফ্লোরিডাসহ বিভিন্ন স্থানের প্রবাসীরা জয়ের এমন কৃতিত্ব নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপন অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সফর সঙ্গী ছিলেন ফ্লোরিডা রাজ্য আওয়ামী লীগ নেতা, কক্সবাজারের গর্জনিয়া ইউনিয়নের কৃতি সন্তান মো.সাইফুল্লাহ চৌধুরী লেবু। তিনি মুঠোফোনে বলেন, ‘জাতির গৌরবময় ওই মুহূর্তটির সাক্ষী হতে সেদিন অরল্যান্ডো কেনেডি স্পেস সেন্টারে বাংলাদেশি-আমেরিকানদের সমাগম ঘটেছিল। আমরা জানি সজীব ওয়াজেদ জয়ের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান এবং দিকনির্দেশনা ছাড়া এই অর্জন সম্ভব ছিলনা। এ কারণে তিনি অবশ্যই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।’

মো.সাইফুল্লাহ চৌধুরী জানান, উৎক্ষেপণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, ৩০ সদস্যের বাংলাদেশের দলের নেতা তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ ও ইমরান আহমেদ, ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম. জিয়াউদ্দিন, বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ, নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল শামীম আহসান, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্লোরিডা রাজ্যের দলীয় নেতাকর্মীসহ সহ¯্রাধিক বাংলাদেশি উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দেশকে এগিয়ে যাওয়ার পথে অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর সুদুর প্রসারী ভাবনা থেকে ১৯৭২ সালে বেতবুনিয়ায় দেশের প্রথম ভূ-উপগ্রহ স্থাপন করা হয়। সেই উপগ্রহ কেন্দ্রই ছিল মহাকাশের সঙ্গে দেশের যোগাযোগের প্রথম সেতুবন্ধন। তখন বিদেশি স্যাটেলাইটের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে আবহাওয়ার পূর্বাভাস–সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া ছিল সেই ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের কাজ। জাতির পিতা সেদিন স্বপ্নের যে বীজ বুনেছিলেন, তার পথ ধরেই আজ আকাশে উড়ছে দেশের প্রথম নিজস্ব স্যাটেলাইট। এর নামও জাতির পিতার নামেই, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট–-১। ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী পরিকল্পনা, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান এবং দিকনির্দেশনায় বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আজ প্রবেশ করেছে গৌরবময় বিশ্ব স্যাটেলাইট ক্লাবে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান ড. শাহাজান মাহমুদ মুঠোফোনে বলেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশের যেমন নির্ভরতা কমবে অন্য দেশের ওপর, তেমনি দেশের অভ্যন্তরীণ টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। স্পেস এক্স-এর উৎক্ষেপণযান বা রকেট ফ্যালকন-৯ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটকে মহাকাশে ১১৯ দশমিক ১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত অরবিট প্লটে স্থাপন করবে। আর স্যাটেলাইটের সুবিধা পেতে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হবে প্রায় এক মাস।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৯০২ কোটি টাকার মত। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে এক হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা এবং অবশিষ্ট এক হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা বিডার্স ফাইনান্সিং-এর মাধ্যমে ব্যয় সংকুলান হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরে প্রাথমিক এবং রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র দ্বিতীয় গ্রাউন্ড স্টেশনের নির্মাণ কাজও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। মহাকাশে উৎক্ষেপণের পর এটি পরিচালনা, সফল ব্যবহার ও বাণিজ্যিক কার্যত্রম সম্পাদনের জন্য ইতিমধ্যে সরকারি মালিকানাধীন বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি গঠন করা হয়েছে। নতুন এই কোম্পানিতে কারিগরী লোকবল নিয়োগ এবং তাদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশের স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল, ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, ভি-স্যাট সংস্থা বিদেশি স্যাটেলাইট ব্যবহার করছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ খাতে ব্যয় করছে বছরে ১৪ মিলিয়ন ডলার। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কার্যক্রম শুরু হলে এই বিপুল অর্থ দেশেই থেকে যাবে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মোট ৪০টি ট্রান্সপন্ডার রয়েছে। এরমধ্যে ২০টি দেশে ব্যবহারের জন্য এবং ২০টি ভাড়া দিয়ে বৈদেশিক মূদ্রা আয় হবে। এছাড়া নিজস্ব স্যাটেলাইট থাকায় বৈশ্বিক টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতার অবসান হবে। টেলিমেডিসিন, ই-লার্নিং, ই-গবেষণা, ভিডিও কনফারেন্স, প্রতিরক্ষা ও দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় জরুরি যোগাযোগের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট।

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট–-১ উৎক্ষেপন অনুষ্ঠানে এগিয়ে যাচ্ছেন সজীব ওয়াজেদ জয়। পাশে তাঁর সফরসঙ্গীরা।