তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন হচ্ছে, ইসলামী আন্দোলন ‘পীরভিত্তিক দল’ হওয়ায় অনুসারীদের সংখ্যা আনুপাতিক হারে বেশি। বিশেষ করে দেওবন্দ ও কওমি ঘরানার পীর হিসেবে ‘চরমোনাই ধারাটি’ গ্রহণযোগ্য বেশি। ‘পীরভিত্তিক’ দল হওয়ার কারণেই শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে দলটির জনপ্রিয়তা বেড়ে চলেছে। যদিও বিজয়ী বা দ্বিতীয় স্থান অর্জনকারীর সঙ্গে ভোটের ব্যবধান অনেক বেশি। এ কারণে দলটির ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়’ আরোহণের কোনও নিকট সম্ভাবনা দেখছেন না বিশ্লেষকরা।

গত দুই-তিন বছরে ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জে তৃতীয় স্থান লাভ করেন ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মুফতি মাছুম বিল্লাহ। তিনি পেয়েছিলেন ১৩ হাজার ৯১৪ ভোট। ২০১৫ সালে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও তৃতীয় স্থান লাভ করে ইসলামী আন্দোলন। ঢাকা উত্তর সিটিতে ১৮ হাজার ৫০ ভোট পেয়ে তৃতীয় হন দলটির তরুণ নেতা শেখ ফজলে বারী মাসউদ। আর ঢাকা দক্ষিণে ১৪ হাজার ৭৮৪ ভোট পেয়ে তৃতীয় হন ইসলামী আন্দোলনের নেতা আবদুর রহমান। রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলটির মনোনীত প্রার্থী এটিএম গোলাম মোস্তফা পান ২৩ হাজার ৭১৮ ভোট। সেখানে বিএনপির প্রার্থীর ভোট ছিল ৩৪ হাজারের একটু ওপরে। গত ১৫ মে অনুষ্ঠিত খুলনা সিটি নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীর ভোটপ্রাপ্তি ছিল প্রায় ১৫ হাজার। এখানেও বিজয়ী প্রার্থীর সঙ্গে পার্থক্য ছিল বিপুল পরিমাণ।

ইসলামী আন্দোলনের প্রচার বিভাগের তথ্যমতে, বর্তমানে দলটির দলীয় প্রতীকে তিনটি ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। প্রতীক ছাড়া নির্বাচনে সমর্থিত চেয়ারম্যান আছেন দুজন। এরমধ্যে বরিশালের চরমোনাই, যেখানে দলটির বর্তমান আমির (পীর চরমোনাই) সৈয়দ রেজাউল করিম চেয়ারম্যান ছিলেন ২০০৩ সাল থেকে। তিনি টানা দুই দফা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বর্তমানে এই ইউপিতে চেয়ারম্যান তার ছোট ভাই মুফতি ইসহাক মুহাম্মদ আবুল খায়ের। ২০১৬ সালের মে মাসে চতুর্থ দফা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার কমলাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আলাউদ্দিন আলাল। তিনি ২১৮ ভোটে হারান আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী আদিতমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ওই ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান শওকত আলীকে। ওই ইউপি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি ছিল বলে জানা যায়। আলাল হাতপাখা প্রতীকে চার হাজার ৬৭৭ ভোট পান। এছাড়া লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগর থানার চরকাদিরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দলের প্রার্থী মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ। আরও দুটি ইউপিতে দল সমর্থিত চেয়ারম্যান রয়েছে। বিজয়ী চেয়ারম্যানের সংখ্যা কম হলেও অনেক স্থানে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছেন ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীরা। প্রচার বিভাগ জানায়, সারাদেশে এক হাজারের বেশি স্থানে নির্বাচন করেছে দলটির মনোনীত প্রার্থীরা।

.

চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ রেজাউল করীম, ছবি- সংগৃহীত

ইসলামী আন্দোলন ও ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইসলামী আন্দোলনের সাংগঠনিক সক্ষমতার কারণে সারাদেশে দলটির কাজ রয়েছে। দ্বিতীয়ত, দেশের অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলগুলোর কিছু বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ এবং কিছু জোটহীন। দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থার কারণে সারাদেশে এগুলো সক্রিয়তা নেই।

ইসলামী আন্দোলনের আমির মাওলানা সৈয়দ রেজাউল করিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বোঝা যেত ইসলামী আন্দোলনের জনসমর্থন কোন পর্যায়ে।’

ভোটপ্রাপ্তির বিষয়ে ‘পীর সাহেব চরমোনাই’র ভাষ্য, ‘মানুষ বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর থেকে মানুষ মুক্তি চায়। বিকল্প শক্তি খুঁজে পাচ্ছে না। মানুষ সন্ত্রাস, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ চায়। শান্তিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা চায়। বিকল্প কোনও প্ল্যাটফর্ম না থাকায় তারা ইসলামের দিকে ঝুঁকছে। সেই ধারাবাহিকতায় ইসলামী আন্দোলনের দিকে আসছে মানুষ।’

লালমনিরহাট জেলার কমলাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আলাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের এখানে ইসলামী আন্দোলনের সমর্থক ছিল অনেক। এছাড়া আমি চেয়ারম্যান হওয়ার আগে মেম্বার ছিলাম। ওই সময়ের কাজে মানুষ আমার ওপর খুশি। আমার বাড়ি অফিসের পাশে। আমাকে মানুষজন সব সময় পায়।’

জানা গেছে, ইসলামী আন্দোলনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির বড় একটি কারণ, প্রয়াত পীর মাওলানা ফজলুল করিম। তার নেতৃত্বেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে দলটির কার্যক্রম। তার সময়েই ৬৪টি জেলাসহ বহু থানায় দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রম ছিল। জনপ্রতিনিধি আলাউদ্দিন আলাল বলেন, ‘ফজলুল করিম পীর সাবের সময়েই অনেকবার ওয়াজ-মাহফিল হয়েছে। সংগঠনের কাজ হয়েছে।’

২০ দলীয় জোটের শরিক খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের মনে করেন, বেশিরভাগ ইসলামী দল স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয় না। অনেকক্ষেত্রে তারা একাই থাকে। তিনি আরও বলেন, ‘ভোটারদের মনোভাব তৈরি হয়েছে কিছুটা। ধর্মভিত্তিক দলকে সাপোর্ট দেওয়ার বিষয়টি মানুষ ভাবছে।’

খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মুহাম্মদ মুনতাসির আলী বলছেন ইসলামী দলগুলোর উত্তরোত্তর ভোট বাড়ার কারণ দুটো। তার ভাষ্য, ‘মানুষ ধর্মপ্রাণ, তাদের আবেগ আছে, টান আছে ধর্মের প্রতি। এ কারণে ইসলামী দল নির্বাচনে অংশ নিলে সাধারণ ভোটারদের আকর্ষণ থাকে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ সৃষ্টির পরবর্তী সময়ে ইসলামী দলগুলো কাজ করছে। মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করছে।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে চরমোনাই পীরের দলের ভোট সিগনিফিকেন্টলি বেড়েছে। এটার একটা কারণ হতে পারে, ক্রমান্বয়ে আমরা ধর্মাশ্রয়ী হয়ে পড়েছি। ধর্ম আমাদের অনেকের জীবনে বিরাট গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটাকে ভোটে প্রভাবিত করেছে কিনা, করবে কিনা, এটা প্রশ্নসাপেক্ষ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ধর্মের ব্যবহার বেড়েছে অনেক।’

এ বিষয়ে পরিচয় উদ্ধৃত না করার শর্তে প্রগতিশীল একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘চরমোনাই পীরের মুরিদের সংখ্যা আছে অনেক। মুরিদের সংখ্যা আগেও ছিল। আগে পলিটিক্যালি আওয়ামী লীগ-বিএনপিকে তারা ভোট দিত। এখন শাসকগোষ্ঠীর অপকর্মের কারণে তারা এখন নিজেদের দলকেই বেছে নিচ্ছে। যদিও আওয়ামী লীগ-বিএনপির সঙ্গে তাদের ভোটপ্রাপ্তির ব্যবধান অনেক। এছাড়া সমাজে মাদ্রাসা শিক্ষা বেড়েছে। তবে তাদের এককভাবে ক্ষমতা দখলের কোনও সম্ভাবনা নেই। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে বেশিরভাগ শ্রমজীবীদের উপস্থিতি বেশি। এর কারণে হচ্ছে, দেশে প্রকৃত শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের অনুপস্থিতি।’

ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পর্যবেক্ষক ও লেখক মাওলানা মুনির আহমদ এ বিষয়ে বলেন, ‘স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ ৪৭ বছর পার হতে চলেছে। তবে কাঙ্ক্ষিত মাত্রার ন্যূনতম পর্যায়েও নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা ও ইনসাফপূর্ণ শাসন প্রতিষ্ঠায় সাধারণ রাজনৈতিক দলগুলো চরমভাবে ব্যর্থ। তারা দেশকে রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে গভীর বিভাজন, সহিংসতা, বিচারহীনতা ও অর্থনৈতিক লুটপাটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মভিত্তিক দল নিয়ে আগ্রহ বেড়েছে।’

স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনেও ভোট পাচ্ছে ইসলামী আন্দোলন। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ছাড়া প্রতিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে ক্রমান্বয়ে ভোটে উন্নতি করেছে দলটি। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে তিনশ আসনে প্রার্থী বাছাই চূড়ান্ত করেছে। দলটির প্রচার সম্পাদক আহমদ আবদুল কাইয়ূম জানান, কোনও-কোনও আসনে একাধিক প্রার্থীও ঠিক করা আছে।

নির্বাচন কমিশনের তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাতীয় নির্বাচনেও অংশ নেয় ইসলামী আন্দোলন। ৯১ এর নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে নির্বাচন করে। এরপর ২০০১ সালে জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোটগতভাবে নির্বাচন করে ২৩ টি আসনে। ৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় এককভাবে। ওই নির্বাচনে ২০ টি আসনে প্রার্থিতা করে মাত্র ১১ হাজার ১৫৯টি ভোট পায়।

‘বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির তিনদশক’ শীর্ষক গ্রন্থে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এনায়েত উল্যা পাটোয়ারী লিখেছেন, ‘ভোটের শতকরা হিসেবে ০.২৬৩% ভোট।’ গ্রন্থের তথ্যানুযায়ী, ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন শতাধিক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মোট ৭ লাখ ৩৩ হাজার ৯৬৯ টি ভোট পায়। ওই নির্বাচনের মোট ভোটের যা ১.০৫ শতাংশ।

এনায়েত উল্যা পাটোয়ারী লিখেছেন, ‘ইসলামী আন্দোলন এ পর্যন্ত সংসদ নির্বাচনে কোনও আসনে বিজয়ী হতে না পারলেও ধীরে-ধীরে সংগঠনটি বিস্তার লাভ করছে।’

ইসলামী আন্দোলন এর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ুম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আগামী নির্বাচনে এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত আছে। তবে ফলপ্রসূ ঐক্য হলে জোটগত হতে পারে। তিনশ আসনই চূড়ান্ত। কোনও-কোনও আসনে একাধিক প্রার্থীও রাখছি।’

সাংগঠনিক বিষয়ে আহমদ আবদুল কাইয়ূম জানান, ‘সবজেলায় কমিটি আছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে আশি শতাংশ। এগারোশ’ ইউনিয়ন কমিটি। প্রার্থিতা করেছে ইউনিয়ন নির্বাচনে। সব থানায় কমিটি আছে। ওয়ার্ডভিত্তিক কার্যক্রম চলছে।’

এদিকে, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ জানান, ‘ইসলামী ঐক্যজোটে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিপুল ভোট পেয়েছে। এককভাবে নির্বাচন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপজেলা সদরে ৫৮ হাজার ভোট পেয়েছে আমাদের প্রার্থী। ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলা নির্বাচনে পায় প্রায় ৪২ হাজার। ফুলপুরে পায় ৪০ হাজারের ওপরে।’

খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মুহাম্মদ মুনতাসির আলী জানান, তার দলের ‘উপজেলা ভাইস-চেয়ারম্যান তিনজন। খুলনার রুপসা, মানিকগঞ্জ সদর, বালাগঞ্জ উপজেলায় দলীয় মনোনিতরা বিজয়ী হয়েছে। এছাড়া চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচন করেছে সিলেটের প্রায় ১০ টি জায়গায়। প্রার্থীরা আড়াই-তিন হাজার ভোট পেয়েছে গড়ে। কোথাও জামিন বাজেয়াপ্ত হয়নি।’