মো: আতিকুর রহমান শাকিল ॥
আসলে বিস্মৃতির শাসন গ্রাহ্য করে কালের কপোলতলে চির শুভ্র সমুজ্জল হয়ে যারা হাজার বছর এই পৃথিবীর মাঝেই পঞ্চমীর চাঁদ হয়ে বেঁচে থাকবেন, তাদের নিয়ে লিখতে যাওয়া সময়ের অপব্যবহার ছাড়া কিছুই নয়। তথাপি সময়ের দাবি পূরণের জন্যই লিখতে যাওয়া। আসলে তারাতো অমৃতের সন্তান। এই চরম অবক্ষয়ের যুগে আলোকিত কিছু মানুষ তিমির হননের দায়িত্ব স্বীয় মাথায় তুলে নিয়েছেন বলেই এই সবুজ দেশ, এই সমাজ, এই রাষ্ট্র এখনও সুন্দর পথে চলছে। আর তেমনি একজন তিমির হননের স্বীয় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন কক্সবাজার নারী কল্যাণ সমবায় সমিতির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা ফাতেমা আনকিছ ডেইজী। তার নীতি-নৈতিকতা নির্যাতিত নারীদের প্রতি দরদ ও আন্তরিকতায় বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে Small minds discuss people, Average minds discuss event, Great minds discuss ideas, But the greatest mind works in silent সংকীর্ণ বা ছোট মনের মানুষেরা মানুষের সমালোচনা করে, গড়পড়তা বা মাঝারী ধরনের মনের মানুষেরা কাজের সমালোচনা করে, বড় মনের মানুষেরা নিজ ধারণা ব্যাখ্যা করে কিন্তু শ্রেষ্ঠ মনের মানুষেরা কাজ করে নীরবে। বাস্তবিক সত্য যে, বড় বা শ্রেষ্ঠ মনের মানুষদের অন্যের সমালোচনা করার সময় তাদের নেই। তারা কথায় নয়-কাজে বিশ্বাসী। তেমনি এক মহৎ মনের নারী ফাতেমা আনকিছ ডেইজী।
কুতুব আউলিয়ার পুণ্যভূমি কুতুবদিয়ার বড়ঘোপের সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার দাদা ছিলেন মরহুম এরশাদ আলী মাতবর। বাবা মরহুম আবু তাহের চৌধুরী অসহায় মানুষের সুখ-দুঃখে ছুটে যেতেন সমাজসেবক হিসেবে বেশ পরিচিত ছিল জেলাব্যাপী। তার ছোট চাচা কুতুবদিয়ার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, সাবেক জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি, বর্তমান বড়ঘোপ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম সহ-সভাপতি ও জাতীয় ম্যাগাজিন জাতির আলোর সম্পাদকমন্ডলীর উপদেষ্টা জননেতা এডভোকেট ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী। ফাতেমা আনকিছ ডেইজীর বড় খালা কক্সবাজার সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য সালেহা রহমান। তারই ছেলে লুৎফুর রহমান কাজল বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মৎস্যজীবী বিষয়ক সম্পাদক ও কক্সবাজার সদর ও রামু আসনের সাবেক জনপ্রিয় সংসদ সদস্য।
ডেইজী কুতুবদিয়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে কক্সবাজারে চলে আসেন। পড়ালেখা শেষ করে যোগদান করেন সরকারি চাকরিতে। স্বাস্থ্য বিভাগে পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা হিসেবে এখনো কর্মরত আছেন। আসলে যুগ যুগ ধরে অনেক মানুষেই নীরবে নিভৃতে কোনো কিছুর প্রত্যাশা না করে মানবসেবায় নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেন। সকল প্রচারণার আড়ালে থেকে বটবৃক্ষের মতোই নিশ্চুপে ছায়া দিয়ে যান অসহায় দরিদ্র মানুষদের। গরিব, দুঃখী, অসহায় ও নির্যাতিত নারীদের পাশে থেকে সেবা করাটাকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন ফাতেমা আনকিছ ডেইজী। এই জেলার মানুষদের প্রতি ভালোবাসার টানে সরকারি দায়িত্ব পালনের পরও যে সময়টুকু তার হাতে থাকে সে সময়কে ব্যয় করছেন নারীদের কল্যাণে। তাই তিনি গড়ে তুলেছেন নারীদেরকে নিয়ে এই জেলায় বৃহত্তম নারী সেবার সংগঠন “নারী কল্যাণ সমবায় সমিতি”। সে সংগঠনে সাড়ে তিন হাজার সদস্য রয়েছে। তাদের সুখ-দুঃখে পাশে থেকে রাতবিরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন মহীয়সী এই নারী। মহীয়সী নারী সমিতির উদ্যোগে ও নিজ অর্থায়নে দীর্ঘদিন ঘরে অসহায় নিষ্পেষিত সাধারণ মানুষদেরকে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। অনেক সময় দেখা গেছে বিভিন্ন এলাকায় ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প, খাদ্য বিতরণ, কাপড় বিতরণ, ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতরে ঈদ সামগ্রী বিতরণ এবং বাবার জিয়াফতের জন্য বড় গরু জবাই করে এতিম মিসকিনদেরকে খাওয়াচ্ছেন। বিশেষ করে পুরুষ কর্তৃক নির্যাতিত নারীদের বিচার পেতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেন। সমাজসেবা ও মানবিক কল্যাণে অবদান রাখায় পরপর তিন বার সমবায় পুরস্কারে ভুষিত হয়েছেন। এছাড়াও সরকারি-বেসরকারি, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে তাকে সম্মাননাসহ ফুলে ফুলে সিক্ত করে।
সমাজ যখন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে তখনই মহান সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ নিয়ে কিছু কিছু মানুষ এই ধরাধামে অবতীর্ণ হন। এরা ক্ষণজন্মা। পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মানুষকে উদ্ধার করে আলোর পথে নিয়ে আসার জন্য নিবেদিত হন এইসব মহাপ্রাণ মানুষগুলো।
তিনি নারী গড়ার কারিগর এবং নারীদেরকে ভালো পথে জীবন-যাপন করার স্বপ্ন দেখান কোমলে কঠোরে প্রতিভা ডেইজী একজন অনন্য নারী। তার নিজ হাতে গড়া নারী কল্যাণ সমবায় সমিতি মানবিক কোমলতায় সিক্ত বৃহত্তর মানবতার কল্যাণে নিবেদিত। তিনি সব সময়ই প্রচার বিমুখ। ডেইজী মনে করেন, যে চেতনা নিয়ে সেদিন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আজ সেটা পরিপূর্ণতা পেয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে, এটি অনেক বড় পাওয়া। তবে শোষণমুক্ত, ধর্ম নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ে সকলকে একযোগে মনেপ্রাণে সমাজমুখী হতে হবে।
একজন সংগ্রামী, আত্মপ্রত্যয়ী মানবসেবক। মন উজাড় করে অসহায়, নিপীড়িত নারীদের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি দান করেন অজস্র। নারী সম্পর্কে উদাহরণস্বরূপ বলা যায়-ধর্মগ্রন্থগুলোয় নারী ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা রয়েছে। ইসলাম ধর্মে মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত বলা হয়েছে। আবার পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে ‘তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের শস্যক্ষেত্র’। মনুসংহিতায় বলা হচ্ছে, ‘নারী জাতি ক্ষেত্রস্বরূপ এবং পুরুষ বীজস্বরূপ। ক্ষেত্র ও বীজের সংযোগেই সমস্ত প্রাণীর উদ্ভব হয়ে থাকে’। ধর্মগ্রন্থেই নারী ত্রাতা-দার্শনিক-মুনি-ঋষি। ত্রাতা হিসেবে, পথপ্রদর্শক হিসেবে নারীদের উপস্থাপন রয়েছে অন্য ধর্মগ্রন্থগুলোতেও। গান্ধারী মহাভারতের এমন এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র। গান্ধারী, দুর্যোধনসহ শত পুত্রের মা। যখন যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের সঙ্গে পাশা খেলায় হারতে হারতে শেষ পর্যন্ত দ্রৌপদীকে বাজি ধরেও হেরে যান, তখন দুর্যোধনের আদেশে দুঃশাসন সবার সামনে দ্রৌপদীর শাড়ি খুলতে থাকেন। দুর্যোধনের এই কুকর্মের জন্য গান্ধারী স্বামী ধৃতরাষ্ট্রকে ছেলেকে ত্যাগ করতে বলেছিলেন। এ মুহূর্তে বিশ্বের বেশ কিছু দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বরা নারী। শিক্ষা-মেধায় নারী পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে এগোচ্ছেন, কোথাও কোথাও পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছেন।