মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম :

শুক্রবার দিবাগত রাত ২টা ১৪ মিনিটে (বাংলাদেশ সময়) যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হল বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট (কৃত্রিম উপগ্রহ) বঙ্গবন্ধু-১।
অবিসংবাদিত ভাবে এই স্যাটেলাইট নিক্ষেপ আমাদের জাতীয় গৌরবের একটি অংশ। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মুহুর্তটি ছিল সারা বিশ্বের বাংলাদেশীদের জন্য মাহিন্দ্রক্ষণ।
প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে উৎক্ষেপিত এই স্যাটেলাইটের খরচ ও এর যৌক্তিকতা নিয়ে যারা অর্থনৈতিক যোগ-বিয়োগ করছেন, তাদের বুঝা উচিত- জাতীয় পতাকাকে যেমন শুধু লাল-সবুজ কাপড়ের অর্থনৈতিক মূল্যে বিবেচনা করা যায়না, আপাতদৃষ্টিতে মহাকাশযাত্রাকে এভাবে বিশ্লেষণ না করাটা উত্তম ও সমীচীন। যদিও, আমাদের এই মহাকাশযাত্রার সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে।
এ অর্জন নিয়ে রাজনৈতিক কিংবা ব্যক্তিগতভাবে আত্নশ্লাঘাবোধ না করাটা উচিত দায়িত্বশীলদের কারণ বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই মহাকাশযাত্রা বাস্তবিক ও প্রত্যাশিত, তথাপি- সরকারকে এই উদ্যোগের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতেই হবে এবং জনগণ আশা রাখবে এই প্রকল্প যাতে ফলপ্রসু এবং সুদূরপ্রসারি হয়।
আমরা জেনেছি- বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের মূল অবকাঠামো তৈরি করেছে ফ্রান্সের মহাকাশ সংস্থা থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস। সেখানে আরেক মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্সের রকেটে করে স্যাটেলাইটটি মহাকাশে গেল। স্যাটেলাইট তৈরি এবং ওড়ানোর কাজটি বিদেশে হলেও এটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে বাংলাদেশ থেকেই। এ জন্য গাজীপুরের জয়দেবপুরে তৈরি গ্রাউন্ড কন্ট্রোল স্টেশন (ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা) স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণের মূল কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে। আর বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হবে রাঙামাটির বেতবুনিয়া গ্রাউন্ড স্টেশন।
বাংলাদেশে এখন প্রযুক্তির দিক দিয়ে অগ্রসর। বিদেশী মহাকাশ সংস্থাগুলোতে সফটওয়্যার ও অন্যান্য আনুসাঙ্গিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে বিরাট অংশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার এক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র তৈরী হতে পারে। এখানে উল্লেখ্য ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান ইত্যাদি উন্নত দেশগুলোতে শুধুমাত্র স্যাটেলাইটের মূল অংশটুকুন বানানো হয় কিন্তু এর বিভিন্ন স্পেয়ার পার্টস্ বা উপাদানগুলো ভারত, চীন, কোরিয়, তাইওয়ান ইত্যাদি দেশ থেকে সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশে যেহেতু সস্তা শ্রম পাওয়া যাচ্ছে এবং আগামী বহু বৎসর ধরে তুলনামূলক ভাবে সস্তা শ্রম পাওয়া যাবে তাই স্যাটেলাইটের হার্ডওয়্যার, সফটওয়ার থেকে শুরু করে বিভিন্ন উপাদানগুলো ব্যাপকভাবে উৎপাদন করে গার্মেন্ট সেক্টরের মত একটি সম্ভাবনাময় শিল্পের বিকাশ ঘটতে পারে আর বিশাল অংকের বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন করাও সম্ভব হতে পারে।
বাংলাদেশ যেহেতু আয়তনের দিক থেকে ছোট ব-দ্বীপ এবং এর প্রায় প্রত্যেক অংশেই সমানুপাতিক হারে জনাধিক্য রয়েছে। তাই স্যাটেলাইট ব্যবহার করে সমগ্র বাংলাদেশকে জিপিএস এর মাধ্যমে সড়ক, অবকাঠামো পূর্ণাংগিত করা সম্ভব। সবচেয়ে – সম্ভাবনাময়ী খাত হতে পারে টেলিমেডিসিন। তাছাড়া টিভি চ্যানেল, আবহাওয়া, আর্থ স্ট্যাশন ত আছেই।
পৃথিবীর কোন দেশের টেলিকমিউনিকেশন মন্ত্রনালয় স্যাটেলাইট নির্মান বা উৎক্ষেপন করে না, এর জন্য একটি নিজস্ব প্রতিষ্ঠান থাকে যেগুলোকে বলা হয় মহাকাশ সংস্থা। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে National Aeronautics and Space Administration (NASA), ইউরোপে রয়েছে European Space Agency (ESA), জাপানে রয়েছে Japan Aerospace Exploration Agency (JAXA)ইত্যাদি। একইভাবে “বাংলাদেশে স্পেস এজেন্সি” প্রতিষ্ঠা করা সমীচীন যারা শুধু মহাকাশ এবং স্যাটেলাইট নিয়ে গবেষণা ও এর বানিজ্যিক দিক বিশ্লেষণ করবে।
এখন বিগডাটা কম্পিউটিং এর সময়। তথ্য নিয়ে গবেষণাটাই মুল আলেখ্য। স্যটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ও সংগৃহীত তথ্য ভার্সিটি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করা যেতে পারে যা দিয়ে সংশ্লিষ্ট গবেষণাপর ফলাফল আসবে।
বর্তমান বিশ্বে যে কোন দেশের শক্তি মূলত পরিমাণ করা হয়- সংশ্লিষ্ট দেশের মহাকাশ নিয়ন্ত্রণ কে দিয়েই। ১৯৫৭ সালে সেভিয়েট ইউনিয়ন যখন প্রথম স্যাটেলাইট নিক্ষেপ করে তখন তারাই ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ। এই মুহুর্তে আমেরিকার অপারেশনাল স্যাটেলাইট আছে ৫৬৮ টি যেখানে চীনের ১৭৭ ও রাশিয়ার ১৩৩ টি। এই পরিসংখ্যান থেকেই বুঝা যায়- বিশ্বের পরাশক্তিশীল দেশের পরিক্রম। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রজেক্টের অংশ হিসেবে ন্যানো স্যাটেলাইট “ব্র্যাক অন্বেষা” উক্ষেপণ করা হয়।
২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট এর মাধ্যমে বাংলাদেশ নতুনভাবে অংকিত হল বৈশ্বিকভাবে।
আমাদের এই উড্ডয়ন যাতে বহমান থাকে সবসময়।।

মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ
mmtanim@gmail.com