ডেস্ক নিউজ:
‘বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই’- এপ্রিলের শুরুতে এমন মন্তব্য করেছিলেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো বিকল্প নেই, কোনো বিকল্প নেই, আন্দোলন, আন্দোলন, আন্দোলন। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা দেশনেত্রীকে কারামুক্ত করব। তার আগে অন্য কোনো কিছু আমরা চিন্তা করছি না, করব না।’

ওই অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল আরও বলেছিলেন, ‘এ দেশে গণতন্ত্রের যতটুকু অর্জন, যিনি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করেছিলেন, তাদের বিদায় করেছিলেন, সেই গৃহবধূ থেকে দেশের পথে-প্রান্তরে গণতন্ত্রের গান গেয়ে বেড়িয়েছিলেন, আজ সেই গণতন্ত্রের মা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে সরকার অন্যায়ভাবে বন্দী করে রেখেছে।’

নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান রেখে বিএনপি মহাসচিব বলেছিলেন, ‘আমাদের সংগঠন শক্তিশালী করতে হবে। প্রতি ঘরে ঘরে গিয়ে এ বাণী পৌঁছে দিতে হবে যে, এখন ঘরে বসে থাকার সময় নেই। নিজের অধিকার আদায়ের জন্য, আমার ভোট আমি দেব- এ অধিকার আদায়ের জন্য, বেঁচে থাকার অধিকারের নিশ্চয়তা পাবার জন্যে সকলকে এ ভয়াবহ, যে দানব আমাদের বুকের ওপর চেপে বসে আছে, সেই দানবকে সরাতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে সকলকে রাজপথে নেমে আসতে হবে। সবাই জাগ্রত হোন, উঠে দাঁড়ান, ফেটে পড়ুন।’

আসলেই কি বিএনপি জাগ্রত হয়েছে, রাজপথে জোরালো কোনো আন্দোলন করতে পেরেছে- এমন প্রশ্ন রাজনৈতিক মহলে। সার্বিক বিচারে শেষ হওয়া এপ্রিলে দলীয় চেয়ারপার্সনের মুক্তির দাবিতে হালে তেমন পানি পায়নি দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল হিসেবে নিজেদের দাবি করা- বিএনপি।

রাজনৈতিক সচেতন মহলের মতে, খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে ডাকা বিভিন্ন কর্মসূচিতে প্রথম দিকে বেশ সরব ছিলেন দলীয় নেতাকর্মীরা। সে সময় নেয়া কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু আস্তে আস্তে যেন তারা ঝিমিয়ে পড়েন। খোদ দলটির কেউ কেউ মনে করেন, এখন আর আন্দোলন তেমন হচ্ছে না। কৌশলগত কারণে বিএনপি ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকটি সফল কর্মসূচি পালন করে। কিন্তু রাজধানীর মধ্যে চার দেয়ালের বাইরে তাদের তেমন কোনো কর্মসূচি চোখে পড়েনি।

তবে, এ বিষয়ে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, পুরো এপ্রিলজুড়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করেছেন নেতাকর্মীরা। এভাবেই আগামী নির্বাচন পর্যন্ত রাজনীতির মাঠ দখলে রাখতে চান তারা।

‘দলীয়প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নির্দলীয় সরকারের অধীন জাতীয় নির্বাচনের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সাংগঠনিক সক্ষমতা যাচাইয়ে নানা চিন্তা-ভাবনা ও উদ্যোগ গ্রহণ চলছে। প্রচুর হোমওয়ার্ক করা হচ্ছে। পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতায় সচেষ্ট রয়েছেন দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা।’

‘দলের মহাসচিব জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে দু-একদিন পরপর নিয়ম করে গুলশান অফিসে মিডিয়া কাভারেজ ছাড়াই বৈঠক করছেন। সবার মতামত নিচ্ছেন। নতুন কর্মপরিকল্পনায় জোটকে সম্পৃক্ত করা, না করা; জোট সম্প্রসারণের বিষয়ে নেতারা তাদের মতামত দিচ্ছেন।’

“সার্বিক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে দলের ‘এক নেতা, একপদ’ নীতি বাস্তবায়ন, বিষয় ভিত্তিক উপ-কমিটি গঠন, অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসন, জেলাপর্যায়ের সমাবেশ ও কর্মী সম্মেলন এবং নিষ্ক্রিয় নেতাদের চিহ্নিতের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে’ বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

‘ইতোমধ্যে বিভাগীয় এবং কয়েকটি জেলায় সমাবেশ করে স্থানীয় নেতাদের বিরোধ নিরসনে নানা উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। জ্যেষ্ঠ নেতাদের জেলা ভাগ করে দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট নেতারা দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলার নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ঢাকা থেকে ওইসব জেলায় গিয়ে কর্মীদের নিয়ে বৈঠক করছেন। সার্বিক সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। মাঠপর্যায়ের নেতারাও লিখিত মতামত দিচ্ছেন’ বলে বিএনপির নীতিনির্ধারণী সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী একাধিক পদধারী নেতাদের অনেকেই পদত্যাগ করলেও বেশকিছু নেতা এখনও দলের একাধিক পদ আঁকড়ে আছেন। তাদের বিষয়ে সমাধান খোঁজা হচ্ছে। যারা দুটি পদ দখল করে আছেন তাদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। তালিকা শেষে ওইসব নেতাদের ডাকা হবে। শুধু কেন্দ্র নয় জেলা-উপজেলা পর্যায়েও ‘এক নেতার একপদ’ নীতি নিশ্চিত করতে হোমওয়ার্কের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি।

দলীয় সূত্রে আরও জানা যায়, জেলা পর্যায়ে ১২ সদস্যের উপ-কমিটি গঠন নিয়ে ভাবছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হবে। নেতাকর্মী ও সমর্থকদের উজ্জীবিত রাখতে এসব কমিটি কাজ করবে। এ নীতির বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহানকে।

মামলা নেই, দলীয় কর্মকাণ্ডেও সক্রিয় নন, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সখ্যতা রয়েছে- এমন নেতাদের তালিকা তৈরির কথাও শোনা যাচ্ছে। খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর তার মুক্তির আন্দোলন করতে গিয়ে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের প্রতি বিশেষ নজর দেয়ার বিষয়টিও গুরুত্ব পাচ্ছে হোমওয়ার্কে।

দলের পরবর্তী করণীয় প্রসঙ্গে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, ‘বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। কেউ যদি মনে করে দলীয় চেয়ারপারসনকে কারাগারে পাঠিয়ে বিএনপির মতো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলকে ভেঙ্গে ফেলা যাবে, সেটা ভুল ধারণা।’

‘অতীতে সেই চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হয়নি। দল আরও শক্তভাবে ঘুরে দাঁড়াবে। সে অনুযায়ী পুরোদমে হোমওয়ার্ক চলছে। নেতারাও কেউ বসে নেই।’

দলটির স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহাবুবুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সরকারের মামলা-হামলা, জুলুম-নিপীড়নসহ নানা কারণে সাংগঠনিকভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়লেও বিএনপি এখনও জনপ্রিয়তায় শক্তিশালী দল।’

‘দলটি আবার নতুন করে সাংগঠনিকভাবে সাজানো হচ্ছে। এতে দলে নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে, নেতাকর্মীরা আরও বেশি সোচ্চার হবেন।’