ডেস্ক নিউজ:
বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলটির নেতাদের তৎপরতা আগের মতো লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটিকে দলের ঐক্য হিসেবে দেখছেন অনেকে। কেউ কেউ আবার মনে করছেন, চেয়ারপারসনের কার্যালয় ঘিরে আগে যে ‘সিন্ডিকেট’ ছিল, তা আর ‘সক্রিয়’ নেই। ওই ‘সিন্ডিকেট’র কারণে আগে অনেকেই সেখানে ভিড়তে পারতেন না।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় কারাগারে যান বিএনপি চেয়ারপারসন। তার অবর্তমানে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বর্তমানে লন্ডনে অবস্থান করছেন তিনি। দুর্নীতির ওই মামলায় তিনিও সাজাপ্রাপ্ত আসামি। এমন প্রেক্ষাপটে কীভাবে চলছে দেশের অন্যতম প্রধান একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানের কার্যালয়?

সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা যায়, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর ফেব্রুয়ারি-মার্চ এ দুই মাসে অন্তত ৩০টির বেশি বৈঠক হয় গুলশান কার্যালয়ে। এর মধ্যে ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিকদের দুবার ব্রিফ করা হয়। দলের স্থায়ী কমিটি এবং জোটের একাধিক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী এবং বিভাগীয় নেতাকর্মীদের নিয়েও বৈঠক হয়।

খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পরের দিন (৯ ফেব্রুয়ারি) বিএনপির মহাসচিব গুলশান কার্যালয়ে প্রথমে বিদেশি এবং পরে দেশি গণমাধ্যমকর্মীদের ব্রিফ করেন। ১০ ফেব্রুয়ারি স্থায়ী কমিটির সদস্যদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১১ ফেব্রুয়ারি ২০ দলীয় জোটের সভা, ১২ ফেব্রুয়ারি কূটনীতিকদের ব্রিফ, ১৫ ফেব্রুয়ারি দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে আইনজীবী ও অন্যান্য পেশাজীবীদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

১৬ ফেব্রুয়ারি আবারও জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে আইনজীবীদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি বুদ্বিজীবীদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা। ১৯ ফেব্রুয়ারি স্থায়ী কমিটি, ঢাকা বিভাগের নেতাকর্মী এবং বৈদেশিক লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক হয়।

২১ ফেব্রুয়ারি জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেলের সঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৈঠক করেন। ২২ ফেব্রুয়ারি সিনিয়র নেতারা বৈঠক করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি মঈন খান, রিয়াজ রহমান ও এনাম চৌধুরী বৈঠক করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি সিনিয়র নেতা ও আইনজীবী এবং স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

গত ৯ এপ্রিল গাজীপুর ও খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং প্রার্থী চূড়ান্তের বিষয়েও গুলশান কার্যালয়ে বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত হয়।

সর্বশেষ শুক্রবার রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলটির নেতাদের এক যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতা এবং মুক্তি আজকের বৈঠকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। একই সঙ্গে আসন্ন ১৫ মে গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়েও আলোচনা হয়েছে।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে অন্যদের মধ্যে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, ড. আব্দুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, বরকত উল্লাহ বুলু, মোহাম্মদ শাহজাহান, শওকত মাহমুদ, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, আহমেদ আজম খান, ব্যারিস্টার আমিনুল হক, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, আতাউর রহমান ঢালী, জয়নাল আবেদীন, আব্দুল হাই শিকদার, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, এম এ কাইয়ুম, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, তাজমেরী এস ইসলাম, আ ন হ আক্তার হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, হারুন রশিদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

BNP-Office1

জানা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকগুলোতে লন্ডন থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন। দলীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত তার মতামতের ভিত্তিতেই নেয়া হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগে গুলশান কার্যালয়ে একটি সিন্ডিকেটের তৎপরতা ছিল। সেই সিন্ডিকেট এখন আর সক্রিয় নেই। এ কারণে নেতাদের মধ্যে ঐক্য তৈরি হয়েছে। নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। ওই সিন্ডিকেটের কারণে যেসব নেতা চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আসতে পারতেন না তারা এখন নিয়মিত আসছেন। দ্বিতীয় সারি থেকে অনেক নেতাই আগে কার্যালয়ে প্রবেশ করতে পারতেন না। কিন্তু এখন তারা আসতে পারছেন এবং দলীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হচ্ছেন।

বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ের একটি সূত্রের দাবি, বরিশাল কেন্দ্রিক দলের কেন্দ্রীয় এক সহ-সভাপতি ও যুগ্ম মহাসচিবের মধ্যে আগে প্রচণ্ড দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত তারা এখন একসঙ্গে নিতে পারছেন।

সূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপারসনের অনুপস্থিতিতে তার কক্ষ বন্ধ থাকে। তবে অন্যান্য দাফতরিক কর্মকাণ্ড যথারীতি চলছে। দলীয় প্রধানের অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব বেড়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্টরা একটু চাপের মধ্যে আছেন বলেও জানা যায়।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার জাগো নিউজকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দলীয় প্রধান না থাকলেও কার্যালয়ের কর্মকাণ্ড যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে।’

সম্প্রতি গুলশান কার্যালয়ে কথা হয় বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলনের সঙ্গে। খালেদা জিয়ার কারাগারে যাওয়ার আগে এবং পরে গুলশান কার্যালয়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘ম্যাডাম থাকলে যে কর্মকাণ্ডগুলো পরিচালিত হতো, সেগুলো তো ওনার স্বকীয়তা, ওনার বৈশিষ্ট্যই ছিল আলাদা। উনি যেহেতু নাই, ফলে দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পিত হয়েছে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ওপর। তার পরামর্শক্রমে মহাসচিব স্থায়ী কমিটির নেতৃবৃন্দকে নিয়ে দফায় দফায় মিটিং করছেন। দলীয় কর্মকাণ্ড কীভাবে চলবে, আন্দোলন-সংগ্রাম, দেশনেত্রীর মুক্তির আন্দোলন, আগামী নির্বাচনে দলের অবস্থানসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে শীর্ষ নেতারা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।’

‘সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দল এখন ঐক্যবদ্ধ এবং আমরা আশাবাদী, সামনের আন্দোলন-সংগ্রামে আপনারা ঐক্যবদ্ধ বিএনপিকে দেখতে পাবেন এবং রাজপথের আন্দোলনে আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত’- যোগ করেন তিনি।

দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয় ঘিরে তৈরি হওয়া সিন্ডিকেটের কারণে আগে অনেক নেতাকর্মী কার্যালয়ে আসতে পারতেন না- এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘না, না। বিএনপির মধ্যে সিন্ডিকেট কখনওই ছিল না। বিএনপি, বিএনপিই। সিন্ডিকেট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে হয়। এটা এফবিসিসিআইয়ের কোনো প্রতিষ্ঠান নয় যে সিন্ডিকেট হবে। এখানে কন্ট্রাকটর বা অন্য কোনো সংস্থার মিটিং হয় না। ফলে সিন্ডিকেটের প্রশ্নই আসে না।’

‘দলীয় নেতাকর্মীরা এখানে আগেও এসেছেন, এখনও আসছেন। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই আমরা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে যাচ্ছি।’

বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে রয়েছেন। এ মুহূর্তে দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘দলের সংবিধানে বলা আছে, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া পলিসি নির্ধারণে স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ যার যার অবস্থান থেকে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে।’

বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয় ঘিরে আগে একটি সিন্ডিকেট সক্রিয় ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তো কোনো সিন্ডিকেটের কথা কখনও শুনিনি। এ বিষয়ে আমার জানা নেই।’