আজিজুল হক ইসলামাবাদী:
৫ মে তৌহিদী জনতার জন্য এক কালো দিবস। মহান আল্লাহ, প্রিয় নবীজী সা. ও পবিত্র কুরআন অবমাননাকারীদের শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ রাজধানী ঢাকা অবরোধ করেছিল। এটি বাংলদেশের হক্কানী ওলামা-পীর-মাশায়েখ, আশেকে রাসূর সা. ও দেশপ্রেমিক ঈমানদার জনতার জন্য রক্তঝরা এক ঐতিহাসিক দিন। সারাদিন ঢাকা অবরোধ করে বিকেলে লক্ষ লক্ষ নবীপ্রেমিক ধর্মপ্রাণ মানুষ জমায়েত হয়েছিল মতিঝিলের ঐতিহাসিক শাপলা চত্বরে। লক্ষ্য ছিল- আমীরে হেফাজত, মুসলিম উম্মাহর আধ্যাত্মিক রাহবর, শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী সমাবেশে আসবেন, আখেরী নসীহত পেশ করবেন, দোয়া করবেন এবং কর্মসূচি দিবেন। তা নিয়ে আল্লাহর খালেস বান্দারা, রাসূল সা. এর খাঁটি প্রেমিকরা, হেফাজতের মুখলিস কর্মীরা নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরে যাবেন। কিন্তু ট্রাজেডি সম্পূর্ণ ভিন্ন, ঘটনা পরিপূর্ণ উল্টো, পরিস্থিতি কালো মেঘে ঢাকা। ষড়যন্ত্র ও গণহত্যার নীলনকশা অনেক গভীর থেকে। পরিকল্পিতভাবে বর্বরোচিত হত্যাকা-ের আয়োজন করা হলো নিজ দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর মহল থেকে। এমন মর্মান্তিক, মর্মন্তুদ ও বেদনাদায়ক হত্যাকা- হালাকু খান, চেঙ্গিস খানের নৃশংসতাকেও হার মানিয়েছে। যা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালোরাতে হানাদার বাহিনীর বর্বরতার চাইতেও ভয়াবহ। ইতিহাসে এক নতুন কারবালা সৃষ্টি করলো। সারা দিন অবরোধে অবস্থান নেয়া হেফাজত কর্মীরা যখন ক্ষুধা, পিপাসায় ক্লান্ত শরীরে হাহাকার তখন তাদের জন্য সরবরাহকৃত খাবার ও পানির গাড়িও বন্ধ করে দিয়েছে আইন শৃংখলা বাহিনী।
সন্ধ্যা থেকেই রাস্তার লাইট বন্ধ করে দেয়া হলো। মতিঝিলের আশপাশের বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হলো। বিটঘুটে অন্ধকারে সাংবাদিকদের বের করে দিলো। ১ লক্ষ ৫৪ হাজার গুলি, রাবারে ঢাকা স্টিলের বুলেট, টিয়ার গ্যাস, পিপার গান, বৃষ্টির মতো সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল পুলিশ-র‌্যাব-বিজিবির যৌথ বাহিনী নিরস্ত্র, নিরীহ, নিরাপরাধ, তাহাজ্জুদ গুজার, জিকিররত, আল্লাহর ঈমানদার গোলাম ও নবীজী সা. এর সৈনিকদের ওপর। সাজোয়া যানের সাইরেনে সৃষ্টি করা হলো একতরফা যুদ্ধ ক্ষেত্র। যৌথবাহিনীর ১০ হাজার সদস্যের পাশাপাশি সরকার দলীয় প্রফেশনাল শুটার বাহিনী, সন্ত্রাসী-ক্যাডাররাও গণহত্যা চালালো।
গভীর রাতে বন্দুকের নল গর্জে ওঠায় শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়া হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা দিকবেদিক ছুটাছুটি করেন এবং অনেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আলেম, হাফেজ, মুফতি, মহাদ্দিস, মুফসসির, কারী, দরবেশ, বে-গুনাহ মাসুম, নিষ্পাপ তালিবে ইলম, আশেকে রাসূলদের রক্তে ভেসে যায় পল্টন, মতিঝিল, ফকিরাপুল, ইত্তেফাক মোড় ইত্যাদি এলাকা। কালো পিচঢালা রাজপথে পানির মতো গড়াতে থাকে নবীপ্রেমিকদের তাজা রক্তের ধারা। রাত পৌনে ৩ টা থেকে ভোর পর্যন্ত চলা এ তা-বে এ হত্যাকা-ে শাহাদত বরণ করেছে অসংখ্য মানুষ। গুলিবৃদ্ধ হয়েছে হাজার হাজার, চোখ হারিয়েছে অনেকে, পঙ্গু হয়ে গেছে বহু লোক।
হেফাজতে ইসলামের কাফেলার মাতৃভূমি কিন্তু বাংলাদেশ। তারা এদেশের নাগরিক, আইন বিরোধী কোন কর্মকা-ে তারা জড়িত নয়, কোন দাগী আসামিও নয়, আলেমরা শান্তি প্রিয়। সমাজে তারা মর্যদাশালী। তাদের জন্য রাষ্ট্রের বাজেটে কোন বরাদ্দও নেই। তাদের পেছনে সরকারকে এক পয়সাও ব্যয় করতে হয়না। বরং তারা সরকারকে ট্যাক্স দেয়। নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকার আছে কথা বলার, যে কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করার, সমাবেশ-মিটিং করার। কিন্তু বিশ্ববাসি দেখলো কি? শাহবাগে যারা ধর্ম, মহান আল্লাহ, রাসূল সা., পবিত্র কুরআন-হাদীস অবমাননাকরে ও আইন বিরোধী অবস্থান নিয়ে দীর্ঘ ৯০ দিন নাস্তিকতা ও ধর্মদ্রোহিতার আস্ফালন দেখালো তাদেরকে রাষ্ট্রের সেই অইন শৃংখলা বাহিনী তিন-চার স্তরের নিরাপত্তা দিলো। টাইম মতো বিরিয়ানি সরবরাহ করে পিকনিক করার ব্যবস্থা করলো। আবহমানকালের মুসলিম ঐতিহ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ধ্বংস করে ধর্ম অবমাননার নিরাপদ মঞ্চ তৈরি করে দেওয়া হলো। হিন্দুস্তানি কালচার, চাঁদাবাজি, পৌত্তলিকতা, যৌনচার, নারী-পুরুষের উদ্দাম নৃত্য, মদ-গাজা সেবন, দাড়ি-টুপি, পর্দার বিধানকে কটাক্ষ করার মহোৎসব পালনের সুযোগ করে দিলো। এমনকি রাষ্ট সর্বপ্রকার সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে ইসলামবিদ্বেষী দেশবিরোধী একটি আন্তর্জাতিক চক্রের সদস্যদেরকে লালন করল।
পক্ষান্তরে শাপলা চত্বরে জমায়েত হওয়া নবীপ্রেমিক জনতাকে মাত্র একটি রাত্র অতিক্রম করতে দিলনা। অথচ জনগনের ট্যাক্সের টাকায় কেনা অস্ত্র-গোলা-বারূদ রাষ্ট্রযন্ত্র সর্বশক্তি নিয়ে যৌথবাহিনী দিয়ে গভীর রাতে দেশে নিরীহ শান্তিকামী নাগরিকদের গণহত্যায় ব্যবহার করলো। ৫ মে দিবাগত রাতে শাপলা চত্বরের চতুর্দিকে অগ্নেয়াস্ত্রের প্রচন্ড বিস্ফোরণে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। দেশের মানূষ আতংকিত হয়ে পড়ে। মানবাধিকারের শ্লোগান বিক্রি করে যারা ব্যবসা করে তাদের ‘বিবেক বন্ধক’ রেখেছে, মূখে কুলুব দিয়েছে। মানবাধিকার কমিশনের বিবেকও সায় দিল না। বরং অধিকারের সম্পাদক এডভোকেট আদিলুর রহমানকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হলো। এতকিছুর পরও বুদ্ধিজীবী সুশীলসমাজ মানবাধিকার রক্ষার ব্যাপারীরা নীরবতাই পালন করলো।

২০১৩ সালে ৫ই মে ঢাকার শাপলা চত্বরে যারা রক্ত দিয়েছেন, যারা আহত হয়েছেন, তারা কেবল মহান আল্লাহ ও প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সা. এর ভালবাসা নিয়ে ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। হেফাজতে ইসলাম যে ১৩ দফা দাবি নিয়ে সেদিন ময়দানে নেমেছিল সে দাবি আজও পূরণ হয়নি। এ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত হেফাজত আন্দোলন চালিয়ে যাবে। ঈমান রক্ষার আন্দোলনে যারা শাহাদত বরণ করেছেন তারা আমাদেরই ভাই, তাদেরকে আমরা ভুলে যেতে পারি না। শাপলা চত্বরের শহীদদের বিচার বাংলার সবুজ চত্বরে একদিন হবে ইনশাআল্লাহ। যারা সেদিন শাহাদাত বরণ করেছেন তারা অবশ্যই জান্নাতে উচ্চ মাকাম লাভ করবেন। আর যারা আহত হয়েছেন আল্লাহ তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দিবেন।

শতকরা নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ। এদেশ হাজার হাজার নায়েবে রাসূল আলিম-ওলামা, পীর-বুজর্গ, মুহাদ্দিস-মুফাসসির, মুফতি, অলি-আউলিয়ার জন্মভূমি। যাঁদের পদচারণায় বাংলার মাটি ইসলামের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। সেই বাংলাদেশ থেকে ইসলামকে সমূলে উৎখাতের হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক ইসলামবিদ্বেষী চক্র ও তাদের এদেশীয় কিছু বৃত্তিভোগী এজেন্ট। তারা অব্যাহত ও বেপরোয়াভাবে ইসলাম সম্পর্কে কূৎসা রটিয়ে চলেছে। মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারী কিছু নাস্তিক মুরতাদ বামপন্থী ব্লগার মহানবী সা.- ও ইসলামের ওপর আক্রমণে ইতিহাসের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে, এ ধৃষ্টতায় তারা ইয়াহুদি-খ্রিস্টান ও মুশরিকদেরকেও ছাড়িয়ে গেছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে তারা দেশের বিরাজমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা ধ্বংস করে বিদেশি আগ্রাসনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। বস্তুতপক্ষে তারা এ দেশ থেকে ইসলাম নির্মূলের নীলনকশা বাস্তবায়ন শুরু করেছে। কতিপয় প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া তাদের বলিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে প্রতিনিয়ত ইসলাম, মুসলমান ও আলিম-ওলামাদের হেয়প্রতিপন্ন করার হীন চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। যা কেবল মুসলমান নয়; কোনো ধর্মাবলম্বী দেশপ্রেমিক, বিবেকবান ও দায়িতশীল নাগরিকের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। এদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এবং সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

লেখক: সাংগঠনিক সম্পাদক হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ।