এম.আর মাহমুদ :

কাল ভয়াল ২৯ এপ্রিল। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ভয়াল রাতে বয়ে যাওয়া ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে অবিভক্ত চকরিয়ার উপকূলীয় এলাকার প্রায় ৫০ হাজার নরনারীর প্রাণহানী ও শত কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়েছিল। সে স্মৃতি ২৭ বছর পরও উপকূল বাসী ভূলতে পারেনি। প্রতিবছর ২৯ এপ্রিল আসলেই চকরিয়া, পেকুয়া উপকূলবাসী আপনজন হারানোর শোকে সরবে ও নিরবে কান্নাকাটি করে। ওই দিন তারা আকাশে মেঘ দেখলেই শংকিত হয়ে উঠে।

২৯ এপ্রিল রাতের ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে চকরিয়া ও পেকুয়া উপকূলীয় এলাকার সবকটি ইউনিয়ন নিমিসের মধ্যেই বিরান ভূমিতে পরিনত হয়েছিল। এক কথায় পুরো উপকূলীয় এলাকা পরিণত হয়েছিল ছিল “সাড়ে বত্রিশ ভাজায়”। তখন সব শ্রেণীর মানুষ ছিল ত্রাণ নির্ভর। বিশুদ্ধ পানির অভাবে উপকূল জুড়ে কারবালায় পরিণত হয়েছিল। এছাড়া হাজার হাজার মৃত ব্যক্তির দাপন নিয়ে ব্যস্ত ছিল জীবিত লোকজন ও প্রশাসন। জলোচ্ছাসের পরে উপকূলবাসীর গোয়াল ভরা গরু পুকুর ভরা মাছ গোলা ভরা ধান কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। যারা সকাল বেলায় আমির ছিলেন, তারাই রাতের মধ্যে ফকিরে পরিণত হয়েছিল। তখন ৮০ ভাগ মানুষই জীবন বাঁচানোর তাগিদে সরকারী বেসরকারী ত্রাণ নির্ভর। ওই রাতে চকরিয়া-পেকুয়ার অন্ততঃ ৫০ হাজার নর-নারীর মৃত্যুর বিনিময়ে দেশী-বিদেশী অর্থায়নে শতাধিক সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণ হয়েছিল। বর্তমানে এসব সাইক্লোন সেল্টার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হতশ্রী ও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এছাড়া এসব সাইক্লোন সেল্টার রক্ষণাবেক্ষণ কোন সংস্থা করবে তা ২৭ বছর পরও নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে বেশিরভাগ সাইক্লোন সেল্টার দাবীদার বিহীন সম্পদে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপজেলা পর্যায়ে নির্মিত সাইক্লোন সেল্টারগুলো বাস্তব অবস্থা যাচাই করার জন্য জরীপের কাজ চলছে। উপকূলবাসীকে রক্ষার জন্য সরকার ও এনজিও সংস্থার বেড়িবাধের পাশে প্যারাবন (সবুজ বেষ্টনী) গড়ে তুললেও এখন বেশিরভাগ উজাড় হয়ে গেছে। অপরদিকে কিছু লোভী চিংড়ি চাষি উপকূলীয় এলাকার সবুজ বেষ্টনী (প্যারাবন) উজাড় করে চিংড়ি ঘের করে যাচ্ছে। অনুরূপভাবে উপকূলবাসীকে রক্ষার জন্য এখনো নির্মাণ হয়নি টেকসই বেঁড়িবাধ। কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সবিবুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবী করেন- উপকূলীয় এলাকার বেশিরভাগ ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ সংস্কার করা হয়েছে। তবে পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাবলা দাবী করেছেন, পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়নের চৌয়ারফাঁড়ি হতে সোলতান মিয়ার খামার পর্যন্ত ১৪ চেইন বেড়িবাঁধ এখনও অরক্ষিত। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে পুরো এলাকায় বিপর্যয়ের আশংকা রয়েছে। অপরদিকে বদরখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খাইরুল বশর দাবী করেছেন, তার ইউনিয়নের ৮ ও ৯নং ওয়ার্ডের কিছু অংশের কাজ এখনও বাকী রয়েছে। এছাড়া পেকুয়া উপজেলার মগনামা, উজানটিয়া, পেকুয়া ও রাজখালী ইউনিয়নের বেড়িবাঁধগুলো সংস্কার করা হয়েছে। তবে কিছু কিছু অংশে সমস্যা রয়েছে বলে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানেরা দাবী করেছেন। অপরদিকে পুরো উপকূলীয় এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় ১৯৯১ সালের মত বিপর্যয়ের আশংকা থেকে এলাকাবাসী অনেকটা নিরাপদ বলে মনে করেন জনপ্রতিনিধিরা। পেকুয়া উপজেলার সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্থ অংশ মগনামার বেড়িবাঁধে ব্লক বসানোর কাজ সম্পন্ন হওয়ায় জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব থেকে অনেকটা নিরাপদ হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড মানসম্মতভাবে কাজটি সম্পন্ন করার ওই এলাকার লোকজন অনেকটা এখন শংকা মুক্ত।

এলাকাবাসীর অভিমত, ১৯৯১ সালের পর থেকে বেশ কিছু সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ হলেও দূর্যোগকালীন সময় যা পর্যাপ্ত নয়। ফলে চকরিয়া-পেকুয়ার ৫ লাখ মানুষ এখনো চরম ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করে যাচ্ছে। ২৯ এপ্রিল স্মরণে চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলা পরিষদসহ বিভিন্ন সংস্থা ওই দিনের স্মরণে মিলাদ ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। ৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পরে বেশুমার নারী-পুরুষ পরিচয়হীন থাকায় গণকবরে দাপন করা হয়। ওইসব গণকবরে অস্তিত্ব এখন আর বিদ্যমান নাই।