মো: ছফওয়ানুল করিম :

২৭ এপ্রিল পেকুয়া উপজেলার জন্মদিন। প্রতিষ্ঠার ১৬ বছর পেরিয়েছে এ উপজেলাটি। কিন্তু স্থানীয়দের অভিমত ১৬ বছরেও পুরোপুরি সরকারী সেবা নিশ্চিত করতে পারেনি প্রশাসন। একটি উপজেলার জনসাধারণকে সেবা দেয়ার জন্য যেসব সরকারী বিভাগ প্রয়োজন তার সবগুলোও এখনো স্থাপিত হয়নি পেকুয়ায়। আর যেসব বিভাগ বিদ্যমান আছে সেগুলোও চলছে অনেকটা খুটিয়ে খুটিয়ে। খোঁজ নিয়ে জানাযায়, বর্তমানে পেকুয়ায় সরকারী সেবাদানকারী অধিদপ্তর বা কার্যালয় রয়েছে ২০ টি। তৎমধ্যে ৯ টি অধিদপ্তরেই ভারপ্রাপ্ত বা অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে চলছে। এরমধ্যেও কিছু কিছু বিভাগ রয়েছে যেগুলোর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে কখনো দেখা যায়না। এমনকি উপজেলার উন্নয়ন সমন্বয় সভায়ও তাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়না। অথচ এসবের কোন তদারকি বা নজরদারি নেই বললেই চলে। ফলে স্থানীয় জনগণ তাদের প্রাপ্য সরকারী সেবা থেকে বঞ্চিত হবার পাশাপাশি হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে জানাগেছে। আর এ জন্য স্থানীয় সাংসদকে দায়ি করছেন সচেতন মহল।

হাজারো মায়ের স্বপ্নের বরপুত্র হিসেবে সালাহউদ্দিন আহমদ চির অবহেলিত উপকূলীয় এলাকা পেকুয়াকে উপজেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। আর তখন থেকেই তিনি পেকুয়া উপজেলার প্রতিষ্ঠাতার স্বীকৃতি পান। ২০০২ সালের ২৭ এপ্রিল পেকুয়া উপজেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এ উপজেলার উদ্বোধন করেন। ১৩৯.৯৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের পেকুয়া উপজেলা প্রাথমিক ভাবে ৫ টি এবং পরে ৭ টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত হয়। ইউনিয়ন গুলো হচ্ছে, পেকুয়া সদর, রাজাখালী, শিলখালী, বারবাকিয়া, টইটং, মগনামা ও উজানটিয়া। তথ্যসূত্রে জানাযায়, তৎকালীন যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী ও বর্তমান বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আলহাজ্ব সালাহউদ্দিন আহমদের ঐকান্তিক প্রচেষ্ঠায় ২০০২ সালের ২৭ মার্চ সরকারের প্রশাসনিক পুর্ণবিন্যাস সংক্রান্ত ‘নিকা’র সভায় কক্সবাজার জেলার ৮ম ও দেশের ৪৬৭ তম উপজেলা হিসেবে পেকুয়া উপজেলার গোড়াপত্তন হয়। একই বছরের ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশ গেজেটে পেকুয়া উপজেলার ঘোষণা মুদ্রিত হয়।

উপজেলা প্রতিষ্ঠার পরবর্তী সময়গুলোতে দেশের রাজনৈতিক মেরুকরণে প্রতিষ্ঠাতা সালাহউদ্দিন আহমদ অধিকাংশ সময় জুড়েই ছিলেন বেকায়দায়। অধিকাংশ সময় তিনি জেল জুলুমের শিকার হয়েছেন। সর্বশেষ তিনি দেশ থেকে গুম হয়ে ৬২ দিন পর ভারতের সিলং রাজ্যে তার খোঁজ মেলে। গত ৪ বছর ধরে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। পেকুয়ার অধিকাংশ জনগন মনে করে, প্রতিষ্ঠাতা যে যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে এ উপজেলাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পরবর্তীতের সে নেতৃত্বের অভাবেই মূলত পেকুয়াবাসি সরকারী সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

পেকুয়া একটি উপকূলীয় এলাকা যা মাতামহুরী নদী ও বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন শাখা প্রশাখা দ্বারা বেষ্টিত। পেকুয়ার আদি এলাকা হচ্ছে সাবেক গুলদি যা বর্তমানে পেকুয়া সদরে অবস্থিত। ১৮৮৭ সালের ক্যাডাস্ট্রোল সার্ভে অনুযায়ী পেকুয়ার নাম পাওয়া যায় পেকুয়া দ্বীপ হিসেবে। তবে পেকুয়ার নামকরণের ক্ষেত্রে বেশী প্রসিদ্ধ তথ্য হল ‘পেক’ থেকে ‘পেকুয়া’র নামকরণ করা হয়েছে। ‘পেক’ অর্থ কাঁদা। একসময়কার বন জঙ্গলে ভরা উপকূলীয় পেকুয়া কাদামাটিতে পূর্ণ একটি প্যারা এলাকা ছিল। আর সেখান থেকেই পেকুয়ার নামকরণ করা হয়েছে। ১৬ বছরে পেকুয়ায় ১১ জন উপজেলা নির্বাহী অফিসার দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে প্রথম উপজেলা নির্বাচন হয়ে প্রথম মেয়াদের পর ২য় মেয়াদেও উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন শাফায়েত আজিজ রাজু।

জানাযায়, পেকুয়া উপজেলা পরিষদের চারতলা বিশিষ্ট ভবনটিতে কার্যক্রম চালু করা হয় ২০০৪ সালে। এর আগে পেকুয়া শহীদ জিয়া বিজনেস ম্যানেজম্যান্ট ইনষ্টিটিউশনের একটি ভবন থেকেই উপজেলার কার্যক্রম পরিচালনা করা হত। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে সরকারী বিভিন্ন বিভাগের কার্যক্রম শুরু করে পেকুয়ায়। তবে প্রতিষ্ঠার ১৬ বছরেও গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি সরকারী অধিদপ্তর স্থাপন করা যায়নি পেকুয়ায়। তৎমধ্যে পেকুয়াবাসি যে সেবা নিয়ে সবচেয়ে ভুক্তভোগী সেটি হল, খাদ্য অফিস এবং সোনালী ব্যাংকের সেবা নিয়ে। সম্প্রতি পেকুয়ার এক অবসরপ্রাপ্ত বয়োবৃদ্ধ সরকারী কর্মকর্তা মগনামা ইউনিয়নের আখতার হোছাইন চকরিয়ায় পেনশনের টাকা তুলতে গিয়ে মারা গেলে সোনালী ব্যাংকের শাখা স্থাপনের দাবি উঠে জোরেসোরে। কেননা পেকুয়ার লোকজনকে অবসর ভাতা, সরকারী লেনদেন ও সরকারী অনুদানের সেবা নিতে চকরিয়া উপজেলায় যেতে হয় এখনো।

পেকুয়া উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন বিভাগের সাথে কথা বলে জানাযায়, উপজেলার ২০ টি সরকারী সেবাদানকারী বিভাগের মধ্যে ৯ টিই চলছে ভারপ্রাপ্ত বা অফিস সহকারী দিয়ে। জানাযায়, উপজেলা ভূমি অফিস চলছে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে। উপজেলা ভূমি সহকারী কর্মকর্তা সালমা ফেরদৌস ছুটিতে থাকায় পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাহবুবুল করিমকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তাছাড়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, পল্লী উন্নয়ন অধিদপ্তর, মহিলা বিষয়ক অধিদপÍর, পরিসংখ্যান অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, সমাজসেবা অধিদপ্তর, পল্লী উন্নয়ন (বিআরডিবি), উপজেলা হিসাব রক্ষণ অফিসের মত গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলো চলছে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দিয়ে। কোনটি চলছে কেবল অফিস সহকারী দিয়েই। বিশেষ করে উপজেলা ভূমি অফিস ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের হয়রানিতে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে পেকুয়াবাসি। এ প্রসঙ্গে পেকুয়া উপজেলা চেয়ারম্যান শাফায়েত আজিজ রাজু বলেন, ‘কর্মকর্তা সংকটে গত ১৬ বছরেও পেকুয়ার জনগণের সরকারী সেবা পুরোপুরি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তবে সীমিত সাধ্যের মধ্যে আমাদের চেষ্টারও কমতি নেই।’ একটি খাদ্য অফিস এবং আরেকটি রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের শাখার অভাবে পেকুয়ার জনসাধারণ নিরবিচ্ছিন্ন সরকারী সেবা পেতে হয়রানির শিকার হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এদিকে পেকুয়া উপজেলার চারপাশের অধিকাংশ বেড়ীবাঁধ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিনে হলেও এ বোর্ডের কোন কার্যালয় আজও স্থাপিত হয়নি পেকুয়ায়। তাছাড়া পেকুয়ার উপর দিয়ে আঞ্চলিক মহাসড়ক বয়ে গেলেও এখনো স্থাপিত হয়নি সড়ক ও জনপদ বিভাগের কোন অফিস। অথচ এ এসড়কটিকে বলা হয় সোনাদিয়া বন্দর (প্রস্তাবিত) থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের কানেক্টিং সড়ক। তাছাড়া এ সড়কটি মাষ্টার প্লান অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যোগাযোগের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক হবে এটি। কেননা এ সড়ক দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার যাতায়াতে দুরত্ব কমে যাওয়ায় সময় বাঁচবে কমপক্ষে দেড় ঘন্টা। সড়ক ও জনপদ বিভাগের অফিস স্থাপনের জন্য ২০০৪ সালেই জমি অধিগ্রহন করা হলেও সে জমি এখন বেদখল হয়ে আছে বলে জানান স্থানীয়রা।

বর্তমানে যেসব বিভাগ সরকারী সেবা দিয়ে যাচ্ছে সেগুলোর মধ্যে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, উপজেলা ভূমি অফিস, সাব-রেজিষ্ট্রি অফিস, উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, উপজেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, উপজেলা মৎস্য অফিস, উপজেলা প্রাণি সম্পদ অফিস, উপজেলা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর, উপজলো সমাজ সেবা কার্যালয়, সমবায় অফিস, পল্লী উন্নয়ন অফিস, পরিসংখ্যান অফিস, হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তার কার্যালয়, নির্বাচন অফিস, বন ও পরিবেশ অধিদপ্তর।