ডেস্ক নিউজ: 

ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সংগঠনের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত হলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিস্বরূপ বহিষ্কারের এখতিয়ার রয়েছে কেন্দ্রীয় সংসদের। এক্ষেত্রে অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী কমিটি স্থগিতও করা যেতে পারে। কিন্তু বর্তমান সময়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদ কর্তৃক গৃহীত বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত সংগঠনটির নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।

সম্প্রতি বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনিকে অব্যাহতি না বহিষ্কার, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলের ঘটনায় হল সভাপতি ইফফাত জাহান এশাকে বহিষ্কার ও বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে স্বপদে বহাল, এশাকে নির্যাতনের অভিযোগে কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক খালেদা হোসাইন মুনসহ সংগঠনটির ২৪ নেত্রী ও কর্মীকে বহিষ্কার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিকেট খেলা নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষের জের ধরে শাখা ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত ও আড়াই ঘণ্টার মধ্যে তা তুলে নিয়ে কমিটি স্থগিত করা হয়নি বলে প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের এক সহ-সভাপতি নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, ‘বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কোনো সিদ্ধান্তই চিন্তাভাবনা করে নেন না। তারা নিজেরাই নিজেদের নেয়া সিদ্ধান্তে কনফিডেন্ট নন। তাই পরবর্তীতে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই পরিবর্তন করেন। এভাবে ছাত্রলীগের মতো একটি বৃহৎ সংগঠন চলতে পারে না।’

jagonews24

গত ১৯ এপ্রিল চট্টগ্রামের এক কোচিং ব্যবসায়ীকে মারধরের ভিডিও প্রকাশ পায় মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনির বিরুদ্ধে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিওটি প্রকাশ পাওয়ার পর নিজের অব্যাহতি চেয়ে কেন্দ্রীয় সংসদকে চিঠি দেন রনি। ওই ঘটনায় ১৯ এপ্রিলই রনিকে ছাত্রলীগ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার এবং ২০ এপ্রিল রনির অব্যাহতি চাওয়ার ভিত্তিতে তাকে সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে বলে দুটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ পায়।

দুটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেই সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষর রয়েছে। যদিও ১৯ এপ্রিলের বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে সোহাগ দাবি করেছেন, ‘সেটি তাদের নয়, ফেইক, বানানো।’ এর আগেও রনি চট্টগ্রাম বিজ্ঞান কলেজের অধ্যক্ষ জায়েদ খানকে মারধর করেন, এমন ভিডিও প্রকাশ পায়। মারধরের বিষয়টি অবহিত করে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতিকে ব্যবস্থা নিতে মুঠোফোনে অনুরোধ করেছেন বলে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে জানান চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাসির। যদিও ওই ঘটনায় কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি ছাত্রলীগ। এছাড়া চট্টগ্রামে রনির অপকর্মের খবর বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি কেন্দ্রীয় সংসদকে। মারধরের ভিডিও প্রকাশ পাওয়ার পরও রনির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় সংগঠনটির অনেক নেতাকর্মী সমালোচনা করেছেন কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের।

গত ১০ এপ্রিল রাতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হল ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মোর্শেদা খানমের রগ কেটে দিয়েছেন হল সভাপতি ইফফাত জাহান এশা- এমন একটি গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো হয়। ঘটনাটি যাচাই না করে গুজবের ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ‘দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে’ ছাত্রলীগ থেকে এশাকে বহিষ্কার করেন সোহাগ-জাকির। ওই ঘটনারও সমালোচনা করেন ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতারা। তারা বলেন, কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়া এশাকে বহিষ্কার অনৈতিক। প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। চাপের মুখে ১৩ এপ্রিল এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এশার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে তাকে স্বপদে বহাল করা হয়েছে।

১২ এপ্রিল ঘটনাটি খতিয়ে দেখতে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন সোহাগ-জাকির। তদন্ত কমিটির দেয়া প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ১৬ এপ্রিল সোহাগ-জাকির স্বাক্ষরিত আরেকটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘১০ এপ্রিল রাতে কবি সুফিয়া কামাল হলে সংঘটিত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকায় ছাত্রলীগ থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাহিত্য বিষয়ক সম্পাদক খালেদা হোসাইন মুন, হল ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মোর্শেদা খানমসহ হলের ২৪ নেত্রী ও কর্মীকে। ওই ঘটনার প্রতিবাদ করে সংবাদ সম্মেলন করেন খালেদা হোসাইন মুন। ১৯ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘গঠনতন্ত্র না মেনে তাকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বলা হয়েছে কবি সুফিয়া কামাল হলের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে আমাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু সেই তদন্ত কমিটি আমার সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করেনি। আমার কোনো বক্তব্যও নেয়নি। ফলে আমি দোষী না নির্দোষ বা আমি কী দোষ করেছি তা নিয়ে অন্ধকারে রয়েছি।’

মুন বলেন, ‘ঘটনায় যারা প্রকৃত দোষী আমি তাদের শাস্তি দাবি করছি। কিন্তু যে ঘটনার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই সেখানে একটি অসম্পূর্ণ তদন্ত আমাকে দোষীসাব্যস্ত করে অগঠনতান্ত্রিকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে।’

jagonews24

তিনি বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও দাবি করেন। এছাড়া মুন হল ছেড়েছেন প্রায় বছর খানেক হলো। বর্তমানে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। তাই ওই ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা ও বহিষ্কারাদেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতারাও। এছাড়া বহিষ্কৃত ২৪ জনের মধ্যে তিনজন ওইদিন হলেই ছিলেন না। কিন্তু তারাও বহিষ্কার হয়েছে। একজন ৯ এপ্রিল চিকিৎসার উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে ভারতে রয়েছেন।

বহিষ্কৃত ২৪ জনের মধ্যে একাধিক নেত্রীর সঙ্গে জাগো নিউজ’র কথা হয়। তারা সবাই জানিয়েছেন, তাদের সঙ্গে তদন্ত কমিটি কোনো ধরনের কথা হয়নি।

এর আগে, ৩ এপ্রিল দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত করে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে পুনরায় নিজেদের সিদ্ধান্তের কথা জানায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। ওইদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে গত ১ এপ্রিলের একটি ঘটনায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জবি ছাত্রলীগের সাংগাঠনিক কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। পরে রাত সাড়ে ৮টার দিকে আবারও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত আরেক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে আরেকটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘জবি ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত করা হয়নি, মঙ্গলবারের জবির ঘটনাকে নিয়ে একটি ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’

জানা গেছে, ১ এপ্রিল মঙ্গলবার ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে কমপক্ষে চারজন আহত হন। সে সময় সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে এক সাংবাদকিকে লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. সাইফুর রহমান সোহাগ অনেকটা ক্ষেপে যান। তিনি সরাসরি নিজেদের নেয়া সিদ্ধান্ত এবং তা পরিবর্তনের বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি। সব প্রশ্নই তিনি পাশ কাটিয়ে অন্যদিকে নিতে চেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এটি সাংবাদিকদের প্রোপাগান্ডা। চট্টগ্রামের ঘটনায় রনিকে আজীবন বহিষ্কারের প্রেস বিজ্ঞপ্তিটি ফেক, সেটি বানানো হয়েছিল।’

jagonews24

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার বিষয়ে তিনি সাংবাদিকদের জানার অভাব বলে দাবি করেন। কবি সুফিয়া কামাল হলের ঘটনায় এশাকে বহিষ্কার ও বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের বিষয়ে বলেন, ‘এশা নির্দোষ, তাই বহিষ্কারাদেশ তুলে নেয়া হয়েছে।’ একই ঘটনায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেত্রীসহ ২৪ জনকে বহিষ্কারের বিষয়ে বলেন, ‘তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে।’

‘তদন্ত কমিটি বহিষ্কৃতদের সঙ্গে কথা বলেনি’- এমন অভিযোগের বিষয়ে সোহাগ সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাস ভবনে হামলাকারীদের বিচার চান। বলেন, ‘যে কেউ অভিযোগ দিতে পারে। যারা এসবের পক্ষে কথা বলবে তারা উপাচার্যের বাসায় হামলাকারী।’

উপাচার্যের বাসায় হামলাকারী হিসেবে আপনি কি সুফিয়া কামাল হলের বহিষ্কৃত ২৪ ছাত্রলীগ নেত্রীর প্রতি ইঙ্গিত করছেন- প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে কিছুটা সময় নিয়ে তিনি বলেন, ‘না, যারা এশাকে মারধরের বিচার চায় না তারা হামলাকারী। সুফিয়া কামাল হলে যারা এশাকে মারধর করেছে আমরা তাদেরও বিচার চাই। এটাকে যারা ঠেকানোর চেষ্টা করছে তাদেরও যেন বিচার হয়।’