ফাইল ছবি

আমান উল্লাহ কবির, টেকনাফ:

বেকার ও অর্ধ শিক্ষিতরা অল্প দিনে বড়লোক হওয়ার লোভে ঝুঁকেছে ইয়াবা ব্যবসায়। এর মধ্যে মধ্যবিত্তের সংখ্যা দিন দিন চোখে পড়ার মতো। তবে তারা এখন নব্য লাখপতি ও কোটিপতিতে পরিণত হয়ে গেছে। ইয়াবা ব্যবসা থেকে বাদ যাচ্ছেনা কতিপয় গুটি কয়েক জনপ্রতিনিধিরাও।

এক সময়ের রিক্সা চালক, দিন মজুর, মাছ শিকার ও পাহাড়ের লাকড়ী কুড়িয়ে এনে যারা সংসারের হাল ধরেছে তারাই আজ কয়েক কোটি টাকার ধন সম্পদের মালিক। তৈরী করেছে আলীশান বাড়ী। দামী গাড়ী নিয়ে চষে বেড়াচ্ছে গ্রাম থেকে শহরে। সমাজের উচ্চ স্থানও তাদের দখলে। অনেকে টাকার জোরে জনপ্রতিনিধির স্থান দখল করে নিয়েছে। আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতো ওদের বিত্ত বৈভবে ভরে গেছে। এতোসব কিছুর পরিবর্তনে ইয়াবা মাদকের বদৌলতে।

এখন চারদিকে হাত বাড়ালেই মিলে যায় মরণঘাতি এই ইয়াবা। ছাত্র, কিশোর, যুবক ক্ষেত্র বিশেষে বৃদ্ধরাও জড়িয়ে পড়েছে। ইয়াবা পাচারের কাজে অর্থে বিনিময়ে ব্যবহৃত হচ্ছে শিশু ও নারীরাও। বিভিন্ন অভিনব কৌশল অবলম্বন করে ইয়াবা পাচার অব্যাহত রয়েছে। আইন শৃংখলা বাহিনী মাঝে মধ্যে অভিযান পরিচালনা করে বড় বড় ইয়াবা চালান আটক করতে সক্ষম হলেও রাঘব বোয়ালরা প্রতিবারই রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা, এক সময়ের জেলে এই মরণনাশক ইয়াবার বদৌলতে বর্তমানে ধনসম্পদের মালিক। সে এখন নব্য কোটিপতি। তার বর্তমানে বড় বড় ফিশিং বোট, কটেজ ও জমি রয়েছে। স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেছে, অতীতে সে বোটের মাঝি হিসেবে কাজ করতো। তখন তার কিছুই ছিলনা। বর্তমানে বাঁশের ঘরের পরিবর্তে দালান বাড়ী হয়েছে। হাইফাই চলাফেরা। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, টেকনাফের চায়ের দোকানের কারিগর করে চলতো সংসার। ইয়াবা ব্যবসায়ীর হাত ধরে সেও এখন নব্য কোটিপতি। গ্রামে গড়ে উঠেছে চার তলা বিশিষ্ট আলিশান ভবন। বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে কয়েক একর সম্পত্তি। দামী গাড়ী নিয়ে চলাফেরা। এভাবে ইয়াবা মাদকের হারামী উপার্জনে ছেয়ে গেছে পুরো সমাজ।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাগর ও নাফ নদের পূর্ব-দক্ষিণ জলসীমানা এখন মাদকের একটি ট্রানজিট পয়েন্টে রুপ নিয়েছে। এ দু’টি পয়েন্ট প্রায়ই অরক্ষিত হয়ে পড়ায় মিয়ানমার থেকে বানের স্রোতের মত মরণনেশা ইয়াবা (মাদক) বাংলাদেশের টেকনাফ সীমান্তের নাফ নদী ও সাগর উপকূলের বিভিন্ন পয়েন্টসহ সাগর পথে পাচার হয়ে দেশের নৌবন্দর এবং তৎসংলগ্ন সাগর উপকূলে খালাস হচ্ছে। ইয়াবা বা মাদক পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে ফিশিং বোট। ছদ্মাবেশে এর আড়ালে বস্তা বস্তা ইয়াবা অভিনব কৌশলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাচার হয়ে যাচ্ছে। নাফ নদে ও সাগর উপকূল ছাড়াও বাংলাদেশ-মিয়ানমার দু’দেশের সাগরের জলসীমানায় আইন শৃংখলা বাহিনী বিজিবি, কোষ্টগার্ড, র‌্যাব ও পুলিশের অভিযানে প্রতিনিয়তই বড় মাপের ইয়াবার চালান জব্দ হচ্ছে। এর সাথে পাচারকারীরা কোন মতেই গ্রেফতার হচ্ছে না। এ

প্রসঙ্গে আইন শৃংখলা বাহিনীর সাফ বক্তব্য মাদক বিরোধী অভিযান আঁছ করতে পেরে পাচারকারীরা আগেভাগে পালিয়ে যায়। ফলে ওদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছেনা। উল্লেখ্য, সম্প্রতি কোষ্টগার্ড ও পুলিশের পৃথক অভিযানে টেকনাফে কায়ুকখালী খাল থেতে ৩ লাখ ৮০ হাজার, সাগর সৈকত এলাকা খোনকার পাড়ার মরিচ ক্ষেতে ৫ লাখ ৫০ হাজার পিস এবং সেন্টমার্টিন ছেড়াদ্বীয়ার অদুরে সাগর থেকে ভাসমান অবস্থায় ৯লাখ ৫০ হাজার পিস ইয়াবা মালিক বিহীন জব্দ করে। স্থল ও সাগর পথে বানের ¯্রােতের ন্যায় মাছধরার ট্রলারযোগে বস্তা বস্তা ইয়াবার চালান ঢুকার কারণ অনুসন্ধান করে জানা যায়, মিয়ানমার সীমান্তের দায়িত্বে নিয়োজিত সীমান্তরক্ষী বর্ডারগার্ড পুলিশ (বিজিপি) প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাদক ব্যবসায়ীর সাথে যোগসাজশে মরণ নেশা মাদক ইয়াবা বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে। উদ্দেশ্য একমাত্র বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজম্মকে মেধাহীন এবং সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমানদের মাদকের প্রতি আসক্ত করে ঘোলাও পানিতে মাছ শিকার করে ওদের হীনস্বার্থ হাসিল করা । দেশের যুবক যুবতীরা, ছাত্র/ছাত্রীরা, ডাক্তার, প্রকৌশলীরা মাদকের প্রতি বেশী আশক্ত হচ্ছে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে মাদকের আগ্রাসন।

খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, টেকনাফে মাদক ইয়াবা ব্যবসায়ীর চেয়ে মাকড়াসার জ্বালের মত খুচরা ইয়াবা ব্যবসায়ীর সংখ্যা। বর্তমানে টেকনাফ ইয়াবায় ডুবো ডুবো অবস্থায়। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ইয়াবা মাদক বিস্তার ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে টেকনাফ উপজেলা মাসিক আইন শৃংখলা ও চোরাচালান ট্রাস্কফোর্স কমিটির সভায় একাধিকবার আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও এর প্রভাব তেমন পড়েনি।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধির স্বদিচ্ছার অভাবে মাদকের ভয়াবহতা থেকে উত্তোরণ হওয়া যাচ্ছে না। টেকনাফ পৌর এলাকা, হ্নীলা, টেকনাফ সদর ও সাবরাং ইউনিয়নে এমন কোন ওয়ার্ড নেই, যেখানে মাদক ও ইয়াবা সহজভাবে পাওয়া যাচ্ছেনা। লবণের ট্রাক, পানের ট্রাক, মাছের ট্রাক, দুরপাল্লার বাস, যাত্রীবাহী বাস ও প্রাইভেট গাড়ীতে অভিনব পন্থায় বড় মাপের ইয়াবার চালান পাচার হয়ে যাচ্ছে। আইন শৃংখলা বাহিনীর অভিযানে প্রতিনিয়তই মাদক ইয়াবা যানবাহন ও পরিবহনে জব্দ ও আটক হচ্ছে। এর পরও ইয়াবা পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না।

টেকনাফ ২ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল আছাদুদ জামান চৌধুরী বলেন, চলতি বছর মার্চ মাসে স্থল ও নৌ পথে পৃথক অভিযানে ৬৩ কোটি ২০ লাখ টাকার মূল্যের ২১ লাখ ৬ হাজার ৬৮২ পিস ইয়াবা জব্দ ও আটক হয়েছে। সকলের সহযোগিতা পেলে এর পরিমাণ আরো বৃর্দ্ধি পেতো বলে তিনি দৃঢ়তার সাথে জানান।

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রনজিত কুমার বড়–য়া এ থানায় যোগদানের ১মাস ২০ দিনে পৃথক মাদক বিরোধী অভিযানে ১১ লাখ পিস ইয়াবা জব্দ করে থাকে। তিনি বলেন, মাদক ইয়াবার বিরুদ্ধে পুলিশের জিরো ট্রলারেন্স থাকবে।

টেকনাফ উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাবেক সাংসদ অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন থেকে বাঁচতে হলে সম্মিলিত ভাবে এর প্রতিরোধ করা দেশের নাগরিক হিসাবে সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে।