মোহাম্মদ ইলিয়াছ 

বিয়ে হচ্ছে ধর্মীয় ও সামাজিক স্বীকৃতি। যেখানে দু‘জন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ও নারী বৈধ চুক্তির মাধ্যমে ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। আর বাল্যবিবাহ হল অপ্রাপ্ত ব্যক্তির অনানুষ্ঠানিক আইন বর্হিভুত বিবাহ। ১৮ বছরের আগের বিবাহকে বলা হয় বাল্যবিবাহ। ইউনিসেফের শিশু ও নারী বিষয়ক প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশে ৬৪ ভাগ নারীর বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগে। অশিক্ষা, দারিদ্র, নিরাপত্তাহীনতা ও সামাজিক নানা কুসংস্কারের কারণে দেশে বাল্য বিবাহ হচ্ছে। দেশে বিবাহ আইনে মেয়েদের বিবাহের বয়স ১৮ বছর আর ছেলের বয়স ২১বছর। দেশে বাল্য বিবাহ আইনে বিভিন্ন শাস্তির বিধান আছে। বাল্যবিবাহ অনুষ্ঠান বা পরিচালনা করলে দুই বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড বা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড দন্ডিত হবে। আর অভিভাবকরা যদি বাল্যবিবাহের অনুমতি প্রদান করেন সেই ক্ষেত্রেও দুই বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ড বা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে দন্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। আইন থাকার পর এদেশে বাল্যবিবাহ বন্ধ হচ্ছে না। বিশেষ করে অশিক্ষিত সমাজে হচ্ছে বাল্যবিবাহের প্রবণতা। প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে তথ্য গোপন করে বাল্যবিবাহ হচ্ছে। পিতা-মাতার চাপেও হচ্ছে দেশে অহরহ বাল্যবিবাহ। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই বাল্যবিবাহের শিকার একজন শরমিন আক্তারের কথা। নয় বছর বয়সী চতুর্থ শ্রেনীর এ ছাত্রীর বিয়ে হয় চল্লিশোর্ধ্ব এক পুরুষের সাথে। প্রথমদিকে শরমিন নিজের তৎপরতায় প্রশাসনের সহযোগিতায় বাল্যবিবাহ ঠেকালেও পওে তাকে বাল্যবিবাহের শিকার হতে হয়। বসতে হয় বিয়ের পিঁডিতে। তবে এ বিয়ে স্থায়ী ছিল এক মাস। কৌশলে শরমিন পালিয়ে আসে শ্বশুর বাড়ি থেকে।

শরমিনের বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ফারেঙ্গা এলাকায়। তার পিতার নাম মোহাম্মদ আলী ও মাতার নাম ছেনুয়ারা বেগম। পিতার দিনমজুরের কাজের মাইনে কোনমতে তাদের সংসার চলে। অভাব-টনের সংসারের মাঝেও শরমিন পার্শ্ববর্তী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ক্লাস ত্রি‘র শিক্ষা বছরের শেষ পর্যায়ে তার অজান্তে বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়। তখন শরমিনের বয়স ৯ বছরের কিছু বেশি। মেয়ের অসম্মতিতে তার পিতা-মাতা কক্সবাজারের মহেষখালীর চল্লিশোর্ধ্ব সৈয়দুল আলমের সাথে বিয়ে ঠিক করেন। বিষয়টি শরমিন স্কুলে এসে তার শিক্ষকদের সাথে শেয়ার করেন। শিক্ষকরা বিষয়টি লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: মাহবুব আলমকে জানান। ইউএনও তৃতীয় শ্রেনীর ছাত্রী শরমিনের বিয়ের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যান এবং বিয়ে বন্ধের যাবতীয় উদ্যেগ নেন। জব্ধ করেন দু‘টি স্বর্ণের কানের রিং। শারমিনের পিতা-মাতার কাছ থেকে মেয়ের ১৮ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে না দেয়ার মুছলেকা নেন। আর সতর্ক করা হয় বিয়ের সাথে সম্পৃক্তদেরকে। তাদেরকে কাছ থেকে বন্ডে স্বাক্ষর গ্রহণ করা হয়। বিয়ের কথাতে যারা সম্পৃক্ত ছিল তাদেরকে জরিমানা করা হয়। অত:পর এ শিশু মেয়েটির সার্বিক নিরাপত্তা ও শিক্ষা কার্যক্রম নিশ্চিত করার লক্ষে ইউএনও ব্যক্তিগত উদ্যোগে উক্ত ছাত্রীর নামে ৫০ হাজার টাকার একটি সঞ্চয়ী হিসাব খোলেন এবং তার পড়াশুনা ও স্বাবলম্বী হওয়ার বিষয়ে দায়িত্ব নেন। দিনটি ছিল ২০১৭ সালের আগষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহের বুধবার। শুক্রবার শরমিনের বিয়ের দিন ধার্য্য ছিল। বিয়ে বন্ধ হওয়ায় খুশি হল শরমিন। কিন্তু বাল্যবিবাহের অশুভ ছায়া শরমিনের পিঁছু ছাড়েনি। পরের বছর সে চতুর্থ শ্রেনীতে উঠলে গোপনে তার বিয়ে ঠিক হয়। তথ্য গোপন করে পিতা-মাতা সু-কৌশলে চল্লিশোর্ধ্ব ঐ ছেলের সাথে মেয়েকে জোর করে বাল্যবিবাহ দিয়ে দেয়। অথচ এতকিছুর পরও মেয়েটির গোপনে বিয়ের বিষয়টি জেনে ইউএনও হতাশ হন। ইউএনও আক্ষেপের সাথে কথাগুলো জানান। তিনি আরো জানান, মোবাইল কোর্টে এতদসংক্রান্ত আইনটি তফশিলভূক্ত না হওয়ায় বাল্যবিবাহে আরো কঠোর হওয়ার বিষয়ে বিরত থাকতে হয়।

বিয়ের এক মাসের মাথায় শরমিন শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে আসে। আলাপচারিতায় জানা যায়, স্বামীসহ তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন তাকে নির্যাতন করতো। বনিবনা হতো না স্বামীর সাথে। স্বামী সবসময় গালিগালাজ করতো। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে আসার প্রস্তুতি নেয়। ২৫ মার্চ শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে আসে। নিজ বাড়িতে না গিয়ে সে ইউএনও‘র দপ্তরে হাজির হয় এবং কান্নাজণিত কন্ঠে ঘটনার বিবরণ খুলে বলে ইউএনও-কে। শিশু মেয়েটির কান্না দেখে ইউএনও তাকে ঠাঁই দেয়। বর্তমানে মেয়েটি ইউএনও জিন্মায় আছে। ইউএনও তাকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়।

শরমিন শ্বশুরবাড়ি থেকে পালিয়ে আসার ঘটনায় উঠে এসেছে কিছু শিক্ষণীয় বিষয়। যেখানে রয়েছে সচেতনতার কথা। রয়েছে সু-শিক্ষানির্ভর ও কু-সংস্কার বিহীন সমাজ গড়ার কথা। তবে এখানে বলা প্রয়োজন শরমিনের জন্ম নেয়া গ্রামটি সর্বক্ষেত্রে অনগ্রসর এলাকা। শিক্ষার তেমন আলো নেই। গরীব এলাকাতো বটেই। নেই সামাজিক সচেতনতা। অশিক্ষিত এলাকা বললেই তেমন ভুল হবে না। তবে শরমিন আমাদেরকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে দায়িত্ব দিল সেটা হচ্ছে, বাল্যবিবাহ রোধে স্ব-স্ব অবস্থান থেকে আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। একজন মেয়ের জীবনে বাল্যবিবাহ কোনদিনই কাম্য হতে পারে না। বাল্যবিবাহ রোধে সচেতন হতে হবে নারীদেরকে।

বাল্যবিবাহে শিক্ষার অগ্রগতি ব্যাহত হয়। ঝুঁকি থাকে মাতৃমৃত্যুর। অপ্রাপ্তবয়স্ক মা জন্মে দেয় প্রতিবন্ধী শিশুর। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, মা হতে গিয়ে প্রতি ২০ মিনিটে একজন মা মারা যাচ্ছে। দেখা দেয় পরিবারের অশান্তি। তাই বাল্যবিবাহের কুফল সম্পকে সবাইকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে প্রাইমারী স্কুল, হাই স্কুল পড়–য়া মেয়েদেরকে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। দেশের অশিক্ষিত ও অনগ্রসর এলাকার জনগোষ্ঠীকে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে জানাতে হবে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে বাল্যবিবাহ ঠেকানো প্রশাসনের একার দায়িত্ব নয়। সর্বমহলের দায়িত্ব রয়েছে।

লেখক: সহ: অধ্যাপক, আলহাজ্ব মোস্তফিজুর রহমান কলেজ

লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।