নীতিশ বড়ুয়া, রামু :

বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার উপ-সংঘরাজ, রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ ও সমাজ সেবায় একুশে পদক পাওয়া পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের বলেছেন, সংসার জীবন প্যাঁচঘরের মতো অত্যন্ত জটিল এবং চক্রময়। এই জটিলতা ও জীবন চক্রকে অত্যন্ত ধৈর্য’র সাথে অতিক্রম করে সঠিক লক্ষে পৌঁছাতে হয়। ধৈর্য হারালে চলবে না। আমরা বাংলাদেশি হিসেবে একই অঞ্চলভূক্ত মানুষ। আমরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সুন্দর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দেখতে চাই।

গতকাল শুক্রবার (২০ এপ্রিল) দিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত রামুর উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বনবিহারে স্বর্গপুরী উৎসব ও বৌদ্ধ মহাসম্মেলনের ধর্মসভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো কামাল হোসেন বলেছেন, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। বাংলাদেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ যেমন এক সাথে বসবাস করে তেমনি উৎসবও সকল সম্প্রদায় মানুষ একসাথে পালন করে। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। সরকার সম্প্রীতির উৎসবকে গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের পরিচিতি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে। এ দেশের মানুষ স্ব-স্ব ধর্মে নিষ্ঠাবান হওয়ায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে তারা অনুকরণীয় আদর্শ বলে ভাবে। দুনিয়ার সব ধর্মই শান্তির কথা বলে। সব ধর্ম অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার কথা বলে। বাংলাদেশের মানুষ ধার্মিক বলেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহনশীলতার আদর্শ এ দেশে বিরাজমান। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এ দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি যুগ যুগ ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বাক্ষর বহন করে আসছে।

এতে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন, রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহা. শাজাহান আলি, সহকারি কমিশনার (ভুমি) চাই থোয়াইহলা চৌধুরী, থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ এ কে লিয়াকত আলী, রামু কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল হক, জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামাল শামসুদ্দিন আহমদ প্রিন্স। কক্সবাজার বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদ সভাপতি প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু’র সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আয়োজনে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বন বিহারের অধ্যক্ষ সারমিত্র মহাথের, স্বাগত বক্তব্য রাখেন রামু উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক নীতিশ বড়–য়া, শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন কক্সবাজার বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অমরবিন্দু বড়–য়া অমল। উৎসবের সম্মানিত অতিথি ও প্রাজ্ঞ ভিক্ষু সংঘকে ফুলেল শুভেচ্ছা ও ক্রেষ্ট দিয়ে সম্মাননা জানান স্বর্গপুরী উৎসব উদযাপন পরিষদ।

বিকেলের সূর্য পশ্চিমে হেলে সারি সারি সাজানো বাগানে ফেলেছে আলোর ছটা। এ আবহে কেউ গাইছে আবার কেউ নৃত্যরত। এখানে কোনো রকম দুঃখ কাউকে স্পর্শ করতে পারে না। এই হলো স্বর্গের কল্পিত রূপ। কোনো লোক চাইলেই বহু আকাঙ্খিত এ স্বর্গে পৌঁছাতে পারে না। সংসার চক্রে ঘুরতে ঘুরতে জীবদ্দশার ভালো কর্মের প্রভাবে একপর্যায়ে মানুষ স্বর্গে আরোহণ করতে সক্ষম হয়, আবার পুনঃজন্ম গ্রহণ করে মর্ত্যলোকে ফিরে আসে। এমনি ভাবেই ঘুরতে ঘুরতে প্রাণীকুল এক সময় নির্বাণ সুখ লাভ করে। এমন বৌদ্ধিক ধারণা থেকেই কক্সবাজারের রামু উপজেলার উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বনবিহারে কৃত্রিম স্বর্গ তৈরি করে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালায় ৩৩ তম স্বর্গপুরী উৎসব উদযাপন করা হয়।

ভোরে প্রভাতফেরী সহকারে বুদ্ধপূজা, সকালে ভিক্ষুসংঘের পিন্ডদান, জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, অষ্টপরিস্কারসহ মহা সংঘদান, ধর্ম দেশনা, অতিথি ভোজন, দুপুরে স্বর্গপুরী উদ্বোধন, দলীয় নৃত্য, ব্যুহচক্রের স্বর্গপুরী মেলা প্রদক্ষিণ ও আলোচনা সভা, সন্ধ্যায় স্বর্গপুরী উৎসবের প্রবক্তা, বিহারের প্রয়াত অধ্যক্ষ প্রজ্ঞামিত্র মহাথের’র নির্বাণ সুখ ও দেশ-জাতি এবং বিশ্বশান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনার মাধ্যমে দিনব্যাপী স্বর্গপুরী উৎসব সম্পন্ন করা হয়। রাতে চলে সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান, বৌদ্ধ কীর্তন ও কবি গান।

সম্প্রীতির তীর্থ ভূমি রামুর উত্তর মিঠাছড়ি গ্রামের স্বর্গপুরী উৎসব হাজারো বৌদ্ধ নারী-পুরুষের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মের লোকজনের অংশ গ্রহণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয় এটি। পবিত্র ত্রি-পিটক থেকে মঙ্গলাচরণের মাধ্যমে শুরু হওয়া আয়োজনে ধর্মদেশনা করেন, চকরিয়া বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ শীলানন্দ মহাথের, শীলরতœ মহাথের, রাঙ্গুনিয়া বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ দীপংকর থের, বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র ও একশ ফুট সিংহ শয্যা গৌতম বুদ্ধমুর্তির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক করুনাশ্রী থের, রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের শীলপ্রিয় থের, কক্সবাজার জেলা গেইট প্রজ্ঞালোক বৌদ্ধ বিহার ও ধ্যান কেন্দ্রের অধ্যক্ষ প্রজ্ঞাপাল ভিক্ষু প্রমুখ। অনুষ্ঠানে পঞ্চশীল প্রার্থনা করেন, উদযাপন পরিষদের উপদেষ্টা কল্যাণ বড়ুয়া।

প্রজ্ঞামিত্র বনবিহারের অধ্যক্ষ সারমিত্র মহাথের জানায়, ১৭৬৭ খ্রি. রাখাইন সম্প্রদায় এ বৌদ্ধ বিহারটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কালের বিবর্তনে রাখাইন সম্প্রদায় এলাকা থেকে চলে গেলে এ অঞ্চলে বসবাসকারী বড়ুয়া বৌদ্ধরা বিহার রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছেন। অনেক বছর ধরে গ্রামবাসী প্রয়াত বিহার অধ্যক্ষ প্রজ্ঞামিত্র মহাথের’র পরিচালনায় বিহার প্রাঙ্গনে ব্যুহচক্র মেলার আয়োজন করেছিলেন। তিনি ১৯৮২ সন থেকে ওই ব্যুহচক্র মেলাকে স্বর্গপুরী নামের উৎসবে রূপান্তর করেন। এরপর প্রতিবছর ব্যুহচক্র মেলা ও স্বর্গপুরী উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ২০০৭ সালে প্রজ্ঞামিত্র মহাথের’র প্রয়ান ও অনিবার্য কারনে দু’য়েক বছর উৎসব করা সম্ভব না হলেও এ বছর ৩৩ তম স্বর্গপুরী উৎসবে কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলা, বান্দরবানের লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি, চট্টগ্রামের পটিয়া, রাউজান, রাঙ্গুনীয়া ও খাগড়াছড়িসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বৌদ্ধদের পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা এ উৎসবে যোগ দিয়েছেন। এছাড়া রামু উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে আগত দলীয় নৃত্য বা কান্ডবাজি উৎসবের আনন্দকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

স্বর্গপুরী উৎসব উদযাপন পরিষদ কর্মকতা সীপন বড়ুয়া জানান, বিগত বছরের ধারাবাহিকতায় এবারেও সুষ্ঠ-সুন্দর আয়োজনে যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদায় স্বর্গপুরী উৎসব সম্পন্ন হয়েছে। দিনব্যাপী এ উৎসব বৌদ্ধদের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিলোনা। সকল ধর্মাবলম্বী লোকজনের অংশ গ্রহণে উত্তর মিঠাছড়ি গ্রামের স্বর্গপুরী উৎসব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উৎসবে রূপ নিয়েছে। শতাধিক বৌদ্ধ ভিক্ষু ও শ্রামনের অংশ গ্রহণে বহুগুণ মর্যাদায় বৃদ্ধি পেয়েছে এ উৎসব। তিনি উৎসব আয়োজনে সহযোগিতার জন্য স্থানীয় প্রশাসনসহ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।