সিবিএন ডেস্ক:

ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা ও ফেসবুকের সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হওয়ার পর অনলাইনে মানুষের তথ্য নিরাপত্তার ঝুঁকির বিষয়টি উঠে আসায় বিস্মিত হয়েছে পুরো বিশ্ব।

তবে এটিকে গণতন্ত্র ও আধুনিক প্রযুক্তির মধ্যকার সুদূরপ্রসারী ও গভীর সঙ্কটের ছোট্ট একটি অংশ বলে মনে করছেন সাংবাদিক ও টেক ব্লগার জেমি বার্টলেট।

মি. বার্টলেট বলেন, “ফ্লোরিডার স্কুলে গুলি চালানোর ঘটনার প্রতিবাদের সময় বোঝা যায় প্রযুক্তি গণতন্ত্রকে কতভাবে সহায়তা করতে পারে। এটি মানুষকে তথ্য পাওয়ার বিষয়ে ও একত্রিত করার ক্ষেত্রে যেমন সাহায্য করতে পারে তেমনি রাজনৈতিক মতপ্রকাশের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।”

কিন্তু প্রযুক্তির দৃশ্যমান উপকারিতার কারণে এর সুদূরপ্রসারী ক্ষতিগুলো সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট সচেতন না বলে মনে করেন মি.বার্টলেট।

আধুনিক প্রযুক্তির সাথে গণতন্ত্রের চিরাচরিত উপাদানগুলোর আধুনিকায়ন না হওয়াকেই এই সমস্যার কারণ হিসেবে মনে করছেন মি. বার্টলেট।

“এটি সামঞ্জস্যের অভাব। আমাদের গণতন্ত্র পুরোনো পদ্ধতিতে কাজ করে। গণতন্ত্র কার্যকর হওয়ার জন্য সুষ্ঠ নির্বাচন, নিরপেক্ষ গণমাধ্যম ও শিক্ষিত নাগরিকের মত উপাদান জরুরি।”

“কিন্তু বর্তমানে আমাদের সম্পূর্ণ নতুন একটি উপাদান নিয়ে চিন্তা করতে হবে, আর সেটি হলো ডিজিটাল প্রযুক্তি। আর এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন নিয়মে পরিচালিত হয়।”

“ডিজিটাল প্রযুক্তি এককেন্দ্রিক নয়, এটি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন, এটি তথ্যনির্ভর ও অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এর উন্নয়ন হয়।”

একসময় সাধারণ মানুষকে জানানোর জন্য যে ধরণের মাধ্যম ব্যবহৃত হোতো, ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে তার অধিকাংশই পরিবর্তিত হয়েছে বলে মনে করেন মি.বার্টলেট।

মি. বার্টলেট বলেন সব নাগরিক যেন একই ধরনের তথ্য পেয়ে থাকেন এবং রাজনীতিবিদদের বক্তব্য একইভাবে যেন সবার কাছে উপস্থাপিত হয় সেটি নিশ্চিত করা বর্তমান গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার অন্যতম প্রধান শর্ত।

“কিন্তু বর্তমান ডিজিটাল প্রযুক্তিতে ‘বিগ ডেটা অ্যানালিসিস’ ও ‘মাইক্রো টার্গেটিং’ এর মাধ্যমে আমার প্রত্যেক ব্যবহারকারীর ছোটোখাটো পছন্দ, চাহিদা সম্পর্কে নিখুঁত ধারণা পেতে পারি।”

“আর এই প্রযুক্তির সহায়তায় এখন রাজনীতিবিদরা প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে তার পছন্দ ও চাহিদা অনুযায়ী বার্তা পাঠাতে পারে।”

মি. বার্টলেটের মতে, এই সুবিধার কারণে এখন রাজনীতিবিদরা আলাদাভাবে প্রত্যেক মানুষের মানসিক দুর্বলতার সুযোগ নিতে পারেন। এবং রাজনীতিবিদদের সেই কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন।

মি. বার্টলেট আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, খুব দ্রুতই রাজনীতিবিদরা লক্ষাধিক ব্যক্তিকে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিগত বার্তা পাঠাতে পারবেন এবং সেটি নিয়ন্ত্রণ বা পর্যবেক্ষণ করার কোনো উপায় থাকবে না।

এসব বার্তার প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যবহারকারীর ধর্মীয় বিশ্বাস, রাজনৈতিক মতবাদ, জীবনধারা সম্পর্কে প্রায় নিখুঁত তথ্য পাওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারায় সম্প্রতি ব্যাপক সমালোচনার শিকার হন ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারায় সম্প্রতি ব্যাপক সমালোচনার শিকার হন ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ

মি. বার্টলেট মনে করেন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে নিকট ভবিষ্যতে ব্যক্তির ব্যবহারের গাড়ি তার যাতায়াত সংক্রান্ত তথ্য জানবে, ফ্রিজ জানবে কি ধরণের খাবার একজন ব্যক্তি খেতে পছন্দ করেন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেয়া তথ্যের মাধ্যমে জানা যাবে তার দৈনন্দিন জীবনের ছোটোখাটো বিষয় সম্পর্কে।

আর তখন প্রত্যেক নাগরিকের সম্পর্কে জানা তথ্য দিয়ে তার দৈনন্দিন চিন্তাভাবনা ও সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করা সহজ হবে।

অতিরিক্ত মাত্রায় তথ্য পাওয়ার কারণে বর্তমানের নাগরিকদেরও আগের চেয়ে অনেক বেশী বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বলে মনে করেন মি.বার্টলেট।

“অতিরিক্ত তথ্যের আদান-প্রদান বর্তমানের মানুষকে অনেক বেশী চিন্তিত করে রাখে আর বিভিন্ন মতামতের প্রচারের কারণে তাদের একের অন্যের সাথে একমত হওয়ার সম্ভাবনাও দিনদিন কমছে,” বলেন মি. বার্টলেট। আর মানুষের এই বিভ্রান্তি ও মতানৈক্যের সুযোগ নিয়ে তাদের প্রভাবিত করার সুযোগ থাকবে রাজনীতিবিদদের সামনে।

মি. বার্টলেট মনে করেন, ডিজিটাল প্রযুক্তি ও গণতন্ত্রের এই দ্বন্দ্ব শেষে বিজয়ী হবে যে কোনো একটি পক্ষ।

ডিজিটাল প্রযুক্তির আগ্রাসনে বর্তমান সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার পতন হবে অথবা রাজনীতিবিদরা তাদের ক্ষমতার ব্যবহার করে ডিজিটাল প্রযুক্তির বিপ্লব থামিয়ে দেবেন।

মি.বার্টলেটের মতে, এখন পর্যন্ত এই যুদ্ধে এগিয়ে রয়েছে প্রযুক্তি। আর এই ধারা অব্যাহত থাকলে ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়ে যাবে গণতন্ত্র। যেভাবে কালের বিবর্তনে ধ্বংস হয়ে গেছে রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের মত সমাজব্যবস্থা।