ওষুধ কোম্পানির ঘুষ, লোভী চিকিৎসক ও বেসরকারি হাসপাতাল সিন্ডিকেট

শাহেদ মিজান, সিবিএন:
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সন্তান প্রসবের অস্বাভাবিক মাধ্যম সিজার মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে। পরিসংখ্যান মতে, ২৩ শতাংশ হারে এখন সিজারের মাধ্যমে বাচ্চার জন্ম হচ্ছে। এই ঝুঁকিপূর্ণ প্রসবে অনেক ক্ষেত্রে মায়ের মৃত্যুও হচ্ছে। সেই সাথে ওই মায়ের প্রজনন ক্ষমতাও সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। এ কারণে সিজার পদ্ধতি নিয়ে অনেক পরিবার চিন্তিত ও হতাশায় ভুগছেন।

চাঞ্চল্যকার তথ্য হচ্ছে, চিকিৎসক ও বেসরকারি হাসপাতালে মালিকদের লোভের কারণে সিজারের মাত্রা বেড়ে চলছে। টাকার লোভে তারা অপ্রয়োজনীয় সিজার করাচ্ছেন। কক্সবাজারের এক হাসপাতালের উচ্চ পর্যায়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাসহ ও ভুক্তভোগীরা এমনটি দাবি করেন।

নাম প্রকাশে অপরাগতা জানিয়ে বেসরকারি হাসপাতালের এক কর্মকর্তা বলেন, তিন কারণে অপ্রয়োজনীয় সিজার করা হচ্ছে। প্রথম কারণ চিকিৎসক, দ্বিতীয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং তৃতীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো।

তিনি জানান, কক্সবাজারের প্রেক্ষাপটে যেসব সিজার অপারেশন হচ্ছে তার অন্তত ৪০ শতাংশ অপ্রয়োজনীয়। স্বাভাবিকভাবে বাচ্চা প্রসব হতে চললেও তার সিজার করা হচ্ছে। এজন্য প্রথম দায়ী সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক, বেসরকারি হাসপাতাল ও ওষুধ কোম্পানিগুলো। কারণ বেসকাররি হাসপাতালে একটি সিজারে ১০ হাজার কমবেশি নেয় চিকিৎসকেরা। মোটা অংকের আয় করতে করতে তারা অপ্রয়োজনীয় সিজার করাচ্ছেন। একইভাবে বেসরকারি হাসপাতালের মালিকেরাও চায় সিজার করাতে । কারণ সিজারের অপারেশন থিয়েটার ফি এবং সিজার পরবর্তী বেড ভাড়াসহ হাসপাতালের আনুষঙ্গিক খরচ দেখিয়ে একটি মোটা অংক আয় করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে গাইনী চিকিৎসকদের সাথে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের একটি স্থায়ী ‘চুক্তি’ও থাকে।

অন্যদিকে সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক এবং দাতব্য ক্লিনিকগুলোতে ঘুষের ফাঁদ বসিয়ে আছেন মোনাফালোভী ওষুধ কোম্পানিগুলো। শীর্ষ পর্যায়সহ প্রায় সব ওষুধ কোম্পানি সিজার করাতে চিকিৎসকদের ঘুষ দিয়ে থাকেন। চিকিৎসকেরা ঘুষ নিয়ে অহেতুক অনেক সিজার করে থাকেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সদর হাসপাতাল, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রসহ কক্সবাজারের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে অহেতুক সিজার করা হচ্ছে। এর মধ্যে সদর হাসপাতাল ও মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে চিকিৎসক ও নার্সদের সিন্ডিকেট অহেতুক সিজার করাচ্ছেন। তারা মূলত ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে অহেতুক সিজার করাতে বাধ্য করছেন রোগীদের।

তথ্য মতে, কক্সবাজারের সদর হাসপাতাল ও গাইনী চিকিৎসকদের মাধ্যমে ঘুষের লেনদেন করেন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। চিকিৎসকেরা ওই ঘুষের ভাগ দেন নার্সদের। মূলত চিকিৎসক ও নার্সরা যোগসাজস করে অহেতুক সিজার করাচ্ছেন। এক্ষেত্রে রোগীরা জিম্মি। কারণ চিকিৎসকের নির্দেশ না মানতেই হচ্ছে তাদের।

এই প্রসঙ্গে কক্সবাজারের এক দাতব্য হাসপাতালের কো-অর্ডিনেটর জানান, তিনি ওই হাসপাতালে বছরখানেক আগে যোগ দিয়েছেন। যোগ দেয়ার কয়েকদিন পর ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা তাঁর কাছে আসতে থাকেন। বিষয়টি জানিয়ে তাঁকে খামে ভরে টাকা দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি বিষয়টি সরাসরি নাকচ করে দেন। এসময় ওষুধ কোম্পানিার প্রতিনিধিরা তাকে জানান, তার আগের কো-অর্ডিনেটরকে তারা মাসিক ভিত্তিতে ‘ঘুষ’ দিতেন সিজার করানোর জন্য। তারা এ-ও জানান- প্রতিটি হাসপাতালের গাইনী চিকিৎসকদের তারা এভাবে সিজার করানোর জন্য ‘ঘুষ’ দেন।

অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালে মোটা টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য স্বাভাবিক সন্তান ডেলিভারির সম্ভাবনা থাকলেও চিকিৎসকেরা ভয় দেখিয়ে অনেক ক্ষেত্রে সিজার করাতে বাধ্য করেন। জীবনের ভয়ে রোগীরা সিজার করাতে সম্মত হন। এতে চিকিৎসক ও হাসপাতাল মালিকের সিন্ডিকেট রয়েছে। তবে অধিকাংশ হাসপাতাল মালিক একই সাথে চিকিৎসক হওয়ায় তা আরো প্রকট আকার ধারণ করে।

প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায়, চিকিৎসকেরা অহেতুক সিজার করেন। এই নিয়ে সন্তান সম্ভবাকে হাসপাতাল আনতে এখন রীতিমত ভয় পায়। সবার কাছে একটা বদ্ধমূল ধারণা জন্ম গেছে যে, হাসপাতালে নিলেই সিজার করতে হবে। তা দরকার না হলেও চিকিৎকসেরা টাকা ‘মারা’র জন্য সিজার করে দেবেন। এই ভয়ে গ্রামাঞ্চলের মানুষ অনকে বেশি ভীত থাকে। তাই সন্তান সম্ভবা মায়ের অবস্থা খারাপ হলেও অনেকে হাসপাতালে নিতে চায় না। এই জন্য অনেক মা ও অনাগত সন্তানের অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। অন্যদিকে সিজারের অতিরিক্ত ব্যয়ে অনেকে আর্থিকভাবে হয়রানির শিকার হন।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে- দেশে অহেতুক সিজার করা হচ্ছে। এই কারণে মাতৃমৃত্যুর হার বেড়েছে। এরকম অভিযোগ অনেক জমা পড়েছে। এই জন্য স্বাস্থ্য বিশেষ ফরম প্রণয়ন করে পর্যবেক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, অহেতুক সিজার করালে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে সরকার।
সেখানে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশে সিজারিয়ান অনেক বেড়ে গেছে। এটা যাতে না হয়, যেখানে সিজারিয়ান করার প্রয়োজন নেই, সেখানে যাতে সিজারিয়ান করা না হয়। সেজন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ ফরম করা হয়েচে। যেখানে সিজারিয়ান হবে প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে ফরম পূরণ করে অধিদপ্তরকে জানাতে হবে।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ড. আবদুল সালাম বলেন, ‘এই রকম আমরা শুনে থাকি। কিন্তু নির্দিষ্ট করে কেউ অভিযোগ নিয়ে আসে না। এমনকি অভিযোগকারীদের চ্যালেঞ্জ করে করে ধরা হলে পরবর্তীতে অস্বীকার করে। এতে অভিযুক্ত চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না। সুনির্দিষ্ট করে কেউ অভিযোগ করলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।’