কালেরকন্ঠ : বিশ্বব্যাংকের নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ ঘোষণার মধুর যন্ত্রণা শুরু হতে চলেছে আসছে ১ জুলাই থেকে। ২০১৫ থেকে ২০১৭ এই তিন বছর ধারাবাহিকভাবে মাথাপিছু জাতীয় আয় বিশ্বব্যাংকের দেওয়া শর্তের আলোকে অর্জন করায় আগামী জুলাই থেকে বাংলাদেশের জন্য সস্তা ঋণ বন্ধ করে দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। একই সঙ্গে, বহুজাতিক সংস্থাটি মূলধন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ায় সদস্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশকেও গুনতে হবে বাড়তি চাঁদা।

সংস্থাটির মূল্যায়নে ১৯৭২ সালে সদস্য হওয়ার পর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত নিম্ন আয়ের দেশ ছিল বাংলাদেশ। সে সুবাধে স্বল্প সুদে ঋণ পেয়েছিল বাংলাদেশ। তবে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশ যেহেতু নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে এবং তিন বছর ধারাবাহিকভাবে জাতীয় আয় বেড়েছে; তাই কম সুদে ঋণ পাওয়ার সুযোগ আর নেই। জুলাই থেকে কঠিন শর্তেই ঋণ নিতে হবে। সে ঋণের সুদের হার ২ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এখন যা ০.৭৫ শতাংশে পাওয়া যায়। বাংলাদেশ আগামী ১ জুলাই থেকে ‘গ্যাপ কান্ট্রি’ হিসেবে পরিচিত হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে এসব কথা জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। অন্যদিকে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থার (জাইকা) ঋণের সুদের হারও বাড়তে যাচ্ছে। ৩৯তম ইয়েন লোন প্যাকেজের আওতায় সংস্থাটি বাংলাদেশকে যে ঋণ দেবে, সে ঋণের সুদের হার হবে এক শতাংশ। যেটা এখন ০.৭৫ শতাংশে আছে।

এদিকে বহুজাতিক বিশ্বব্যাংক তাদের মূলধন বাড়াতে চলেছে। বিশ্বব্যাপী নতুন নতুন যেসব চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে, সেসব খাতে ঋণ বাড়াতে মূলধন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থাটি। মূলধনের আকার ১০ হাজার কোটি ডলার বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে মূলধনের এই আকার বাড়তে পারে। এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। এই টাকা ওঠানো হবে বিশ্বব্যাংকের ১৮৯টি সদস্য রাষ্ট্র থেকে। বিশ্বব্যাংকে যার শেয়ার যত বেশি, ওই দেশের চাঁদার হারও বেশি। সদস্য হওয়ায় বাংলাদেশকেও বাড়তি চাঁদা দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা ও শরণার্থীদের আশ্রয়ে বাড়তি এই টাকা বিনিয়োগ হবে। ৯৬ পৃষ্ঠার এসংক্রান্ত প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আগামী ২০ এপ্রিল থেকে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বসন্তকালীন অধিবেশনে মূলধন বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। ২০১০ সালে শেষবারের মতো মূলধন বাড়িয়েছিল বিশ্বব্যাংক। ওই সময়কার প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিকের আমলে বিশ্ব মন্দা থেকে রক্ষা পেতে আট হাজার ৬০০ কোটি ডলার মূলধন বাড়ানো হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী ঋণের হার বাড়াতে এমন উদ্যোগ বলে জানিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের কর্মকর্তারা।

জানতে চাইলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব কাজী শফিকুল আযম কালের কণ্ঠকে বলেন, বিশ্বব্যাংকের হিসেবে বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। পরপর তিন বছর বাংলাদেশ জাতীয় মাথাপিছু আয় ধারাবাহিকভাবে ধরে রেখেছে। সে কারণে বিশ্বব্যাংক থেকে এত বছর সহজ শর্তে যে ঋণ পাওয়া যেত, সেটি জুলাই থেকে আর পাওয়া যাবে না। সুদের হার বাড়বে।

তিনি আরো বলেন, বিশ্বব্যাংক বিশ্বব্যাপী তাদের ঋণের পরিমাণ বাড়াতে চায়। সে কারণে তারা মূলধন বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মূলধন বাড়লে বাংলাদেশের জন্য বেশি করে ঋণ পাওয়ার পথ সুগম হবে বলে জানান শফিকুল আযম।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিম্ন আয়ের দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ এত দিন বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (আইডিএ) থেকে সহজ শর্তে ঋণ পেত। এই ঋণের সার্ভিস চার্জ ০.৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকা ঋণ নিলে সুদের হার ৭৫ পয়সা। জুলাই থেকে বিভিন্ন প্রকল্পে যে ঋণ নেওয়া হবে, সে ঋণের সুদের হার ২ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ ১০০ টাকা ঋণ নিলে সে ঋণের সুদের হার হবে দুই টাকা। বিশ্বব্যাংক সূত্র বলছে, আসছে জুলাই থেকে ডলারে ঋণ নিলে ঋণের সুদের হার হবে দুই শতাংশ। আর বর্তমান যে পদ্ধতিতে স্পেশাল ড্রইং রাইটে (এসডিআর) বাংলাদেশ আইডিএ ঋণ নেয়, সে আলোকে নিলে ঋণের সুদের হার হবে ২.৬ শতাংশ।

এ ছাড়া ঋণ পরিশোধের সময়সীমাও কমে যাচ্ছে আসছে জুলাই থেকে। জুলাই থেকে কোনো প্রকল্পে ঋণচুক্তি করলে সে ঋণ ৩০ বছরে পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। এখন এই সময়সীমা আছে ৩৮ বছর। সে হিসেবে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা কমবে আট বছর। ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ আইডিএ থেকে এত দিন সহজ শর্তে ঋণ পেত। জুলাই থেকে ঋণের সুদের হার বাড়বে। কারণ, বিশ্বব্যাংকের এটলাস পদ্ধতিতে কোনো দেশ ধারাবাহিকভাবে তিন বছর ১১৬৫ ডলারের বেশি মাথাপিছু জাতীয় আয় হলে ওই দেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়। বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে তিন বছর ১১৬৫ ডলারের বেশি মাথাপিছু জাতীয় আয় অর্জিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এটলাস পদ্ধতির হিসেবে এটি এখন এক হাজার ৪৯৬ ডলার। তাই জুলাই থেকে কম সুদে আর ঋণ পাবে না বাংলাদেশ।

ইআরডির অতিরিক্ত সচিব শহিদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার ঘোষণা আসার পর থেকে জাইকা তাদের ঋণের সুদের হার বাড়াচ্ছে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত সংস্থাটির ঋণের সুদের হার ছিল ০.০১ শতাংশ। পরের বছর সেটি বাড়িয়ে ০.৭৫ করা হয়েছে। এখন তা ১ শতাংশে উন্নীত করার প্রস্তাব এসেছে। আসছে ৩৯তম ইয়েন লোন প্যাকেজের আওতায় নতুন ঋণের সুদের হার কার্যকর হবে।