মো. সাব্বির রহমান

দেওয়ানি সব ধরনের মামলার জন্য আদালতের বাইরে এসে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) ব্যবস্থা রয়েছে, যা দেওয়ানি কার্যবিধিকে এক চমৎকার বিশেষত্ব প্রদান করেছে। ফৌজদারি অপরাধগুলো সমাজের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয় বলে অপরাধের বিচার সম্পূর্ণ রাষ্ট্রের হাতে ন্যস্ত থাকে। তথাপিও ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রেও কিছু অপরাধ পক্ষদ্বয়ের পারস্পরিক সমঝোতা বা চুক্তির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়। ফৌজদারি কার্যবিধিতে যা ‘কম্পাউন্ডিং অফেন্স’ বা ‘আপসযোগ্য অপরাধ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও অভিযুক্ত ব্যক্তি পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে ও ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে আদালতের অনুমতি ব্যতিরেকে কিংবা আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে মামলা নিষ্পত্তি করার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়।

ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ৩৪৫ ধারায় ‘আপসযোগ্য অপরাধ’ বিষয়ক যাবতীয় বিধান উল্লেখ করা হয়েছে। কম্পাউন্ডিং অফেন্সের ক্ষেত্রে আইনের নীতি হলো এই যে, যেসব অপরাধ তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ এবং যেগুলোয় রাষ্ট্রের স্বার্থের তুলনায় কেবল ব্যক্তিস্বার্থই ক্ষুন্ন হয়ে থাকে, সেসব অপরাধের বিচার আপসের ভিত্তিতে নিষ্পত্তি হতে পারে। ফৌজদারি মামলায় আপসের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন কেবল ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি। এক্ষেত্রে ব্যক্তি যদি নাবালোক হয় তবে তার আইনানুগ অভিভাবকও আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে আপসের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারবে।

ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪৫ ধারায় অপরাধগুলোকে আপসযোগ্যতার ভিত্তিতে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগে রয়েছে ১৭টি অপরাধের তালিকা, যেগুলো আদালতের অনুমতি ছাড়াই তৃতীয় কলামে উল্লিখিত ব্যক্তি আপস করতে পারবে। আর দ্বিতীয় ভাগে আছে আরো ৪৪টি অপরাধের তালিকা, যেগুলো আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে কলামে উল্লিখিত ব্যক্তি আপস করতে পারে। তবে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪৫ ধারার উল্লেখ নেই, এমন কোনো অপরাধ আপস করা যাবে না। বিশেষ আইনে উল্লিখিত অপরাধগুলোও আপসযোগ্য নহে হিসেবে বিবেচিত হবে। যদি কোনো আপোসযোগ্য নহে অপরাধ আইনের বিধান লঙ্ঘন করে আপস করা হয়, তাহলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির ২১৩ ও ২১৪ ধারা আনুযায়ী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। মামলার যেকোনো পর্যায়েই আপসের ও মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।

মামলা হাইকোর্ট বিভাগ বা সেশন কোর্টে আপিলরত অবস্থাতেও আপস করা যেতে পারে। মামলা আপস করার মধ্য দিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি মামলা থেকে রেহাই পেয়ে থাকে। এ কারণে কোনো মামলা একবার আপোস করা হলে পুনরায় একই বিষয়ে আদালতে মামলা দায়ের করা যায় না। তবে কোনো আপস যদি ভয়ভীতি প্রদর্শন, প্ররোচণা বা জোরপূর্বক করা হয়, তবে তা আপস হিসেবে বিবেচিত হবে না। নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মামলা প্রত্যাহার করা হলে একই বিষয়ে আবার নতুন করে মামলা করা যায় না। দেওয়ানি মামলার ‘রেস জুডিকাটা’ বা দোবারা নীতি এবং ফৌজদারি মামলার ‘ডাবল জিওপারডি’ বা দোবারা সাজা নীতির আলোকে এ ধরনের মামলাকে বাধা দেওয়া হয়। তবে উচ্চতর আদালতে রিভিশন দায়ের করে আদালতকে যদি সন্তুষ্ট করা যায়, সে ক্ষেত্রে পুনর্বিচার কিংবা পুনঃতদন্তের নির্দেশ ন্যায়বিচারের স্বার্থে আদালত দিতে পারেন। হাইকোর্ট বিভাগের সহজাত ক্ষমতার অধীনে এ ধরনের আদেশ দেওয়ার সুযোগ আছে।

ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার

ফৌজদারি মামলা সাধারণত দুই ধরনের: সিআর ও জিআর। জিআর মামলা সাধারণত থানায় করা হয়। আর সিআর মামলা করতে হয় ফৌজদারি আদালতে। জিআর মামলায় বাদীর পক্ষে রাষ্ট্র নিজেই আইনজীবী নিযুক্ত করেন, যাদের বলা হয় হয় পাবলিক প্রসিকিউটর তথা রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি)। আর সিআর মামলা নালিশকারীকেই ব্যক্তিগতভাবে আইনজীবী নিযুক্ত করে মামলা পরিচালনা করতে হয়।

থানায় রুজুকৃত তদন্তাধীন মামলা প্রত্যাহার (জিআর মামলা প্রত্যাহার)

থানায় রুজুকৃত মামলা তদন্তকালে অনেক সময় বাদী তার প্রতিপক্ষের সঙ্গে আপস করে ফেলেন, তখন মামলা বাদী তার তদন্তাধীন মামলা প্রত্যাহার করার আবেদন করে। আবার কোনো মামলায় পর্যাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণের অভাব কিংবা মামলার পক্ষগণের মধ্যে সমঝোতার কারণে মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত আসতে পারে। জিআর মামলা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধিতে দুই ধরনের পদ্ধতি আছে। ফৌজদারি কিছু গুরুতর অপরাধ ছাড়া আদালত অধিকাংশ সময় ফৌজদারি মামলাও প্রত্যাহারে সহায়তা দিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে মামলা তদন্তকালেও প্রত্যাহারের কিছু সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে আপস-অযোগ্য ও পেটিন্যাচারের ফৌজদারি মামলা আপোষ-মীমাংসা হলে সহজেই তদন্তকালে মামলা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়। যা সময় ও অর্থ অপচয় রোধ, দাঙ্গা দমন করে সমাজিক সম্প্রতি বৃদ্ধি করে। বিচারধীন যেসব জিআর মামলা রাষ্ট্র নিজেই পক্ষ, সেসব মামলায় পাবলিক প্রসিকিউটরের পক্ষ থেকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারায় মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করা যায়।

বিচারধীন মামলা প্রত্যাহার এবং আসামির নাম প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া

ফৌজদারি কার্যবিধি ৪৯৪ ধারামতে রাষ্ট্রপক্ষ মামলার কার্যক্রম প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। রায় ঘোষিত হওয়ার পূর্বে পর্যন্ত মামলা প্রত্যাহার করা যায়। সাধারণত দেখা যায়, নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর পএিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বা চিঠির মাধ্যমে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলার তালিকা আহবান করেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত তালিকা প্রাপ্তির পর বিজ্ঞ পিপি-এর মতামতের জন্য পিপি অফিসে প্রেরণ করেন। বিজ্ঞ পিপি উক্ত তালিকার উপর মন্তব্যের কলামে মামলাটি প্রত্যাহারযোগ্য কি না তদন্ত বিষয়ে মতামত দিয়ে পুনরায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় বরাবরে প্রেরণ করেন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত তালিকা প্রাপ্তির পর জেলা কমিটির মিটিং-এ পুনরায় পর্যালোচনা করেন। উক্ত মিটিং-এ পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। জেলা কমিটির মিটিং-এ উক্ত তালিকা ও বিজ্ঞ পিপির মতামতসহ পুনরায় আলোচনা-পর্যালোচনা করে আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের মিটিং তলব করে তালিকা চূড়ান্ত করে এবং চূড়ান্ত মতামতসহ তালিকা বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং পিপি সাহেবের অফিসে প্রেরণ করা হয়। তদনুযায়ী মামলা প্রত্যাহার করা হয়। তবে বিচারিক আদালত মামলা প্রত্যাহার সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের আদেশ মানতে বাধ্য নয়।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলির পক্ষ থেকে মামলা প্রত্যাহার

ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি বা পাবলিক প্রসিকিউটর আদালতের অনুমতি নিয়ে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত মোকদ্দমায়, সাধারণভাবে যেসব অপরাধে তাঁর বিচার হচ্ছে, তার যেকোনো এক বা একাধিক অপরাধ সম্পর্কে পরিচালনা থেকে সরে যেতে পারেন। অভিযোগনামা প্রণয়নের আগে সরে গেলে ওই এক বা একাধিক অপরাধ সম্পর্কে আসামির অব্যাহতি হবে; এবং অভিযোগ প্রণয়নের পর সরে গেলে অথবা এই আইন অনুসারে কোনো অভিযোগনামা প্রণয়ন করা প্রয়োজন না হলে ওই এক বা একাধিক অপরাধ সম্পর্কে আসামিকে খালাস দিতে হবে। মামলা পরিচালনা থেকে সরে যাওয়ার উপযুক্ত কারণ সম্পর্কে সরকারি বাদী আদালতকে সন্তুষ্ট করবেন। কেবল সরকারের তরফ থেকে মামলা থেকে সরে যাওয়ার আদেশ আদালত কর্তৃক অনুমতি প্রদানের জন্য যথেষ্ট কারণ হবে না। ৪৯৪ ধারার অধীনে মামলা প্রত্যাহারে বেশ কিছু বিষয় আদালতের পর্যবেক্ষণে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে।

যেমন: প্রথমত, মামলা প্রত্যাহারের আবেদন কেবল পাবলিক প্রসিকিউটরের তরফ থেকেই হতে হবে। এজাহারকারী কিংবা আসামির আবেদন কিংবা সরকারের কোনো আদেশের বলে মামলা প্রত্যাহার করা যাবে না।

দ্বিতীয়ত, মামলা প্রত্যাহারের যুক্তিযুক্ত কারণ কৌঁসুলির পক্ষ থেকে আদালতের সামনে ব্যাখ্যা করতে হবে। কেবল সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে আদালত মামলা প্রত্যাহারের আদেশ দেবে না।

মামলা প্রত্যাহার সম্পর্কে আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। সুতরাং, আদালত যদি মামলা প্রত্যাহারের কারণ সম্পর্কে সন্তুষ্ট না হন, সে ক্ষেত্রে প্রত্যাহারের অনুমতি না দিয়ে মামলা এগিয়ে নেওয়ার আদেশ দেবেন।

মামলার ভুক্তভোগী, এজাহারকারী বা বাদী যদি মনে করে রাষ্ট্রপক্ষ অহেতুক তাদের মামলাটি প্রত্যাহার করে নিয়েছে, সে ক্ষেত্রে ক্ষেত্র বিশেষ দায়রা জজ আদালত কিংবা হাইকোর্ট বিভাগে রিভিশন দায়ের করতে পারে।

আদালতে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার (নালিশি (সিআর) মামলা প্রত্যাহার

আপস-অযোগ্য ও পেটিন্যাচারের সিআর মামলা সহজেই প্রত্যাহার করা যায়। তদন্তধীন সিআর মামলা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়। মামলার পক্ষগণের মধ্যে সমঝোতার কারণে মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত আসতে পারে। আর সিআর মামলায় নালিশকারী বা তাঁর পক্ষ থেকে নিযুক্ত আইনজীবী মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করতে পারেন ফৌজদারি কার্যবিধির ২৪৮ ধারার অধীনে। ফৌজদারি কার্যবিধির ২৪৮ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনো মামলার চূড়ান্ত আদেশ হওয়ার আগ পর্যন্ত বাদী যদি ম্যাজিস্ট্রেটের সন্তুষ্টি বিধান করতে পারেন যে, তাঁকে নালিশ প্রত্যাহারের অনুমতি দেয়ার পর্যাপ্ত কারণ রয়েছে, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে সেই নালিশ প্রত্যাহারের অনুমতি দেবেন এবং আসামিকে খালাস দেবেন। এই ধারাটি শুধু নিষ্পত্তিযোগ্য মামলার ক্ষেত্রে, যা ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪৫ ধারায় বর্ণনা করা হয়েছে। সে জন্য অভিযোগকারী এই ধারা অনুসারে নালিশ প্রত্যাহার করতে পারেন।

দেওয়ানি মামলা প্রত্যাহার

দেওয়ানি কার্যবিধির ২৩ আদেশের এক নিয়মানুসারে, দেওয়ানি মামলা হওয়ার পর যে কোনো সময়ে বাদী সব বা যে কোনো বিবাদীর বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করতে বা আংশিক দাবি পরিত্যাগ করতে পারেন। যে ক্ষেত্রে আদালত এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, কোনো পদ্ধতিগত ত্রুটির জন্য মোকদ্দমাটি ব্যর্থ হতে বাধ্য এবং মামলার বিষয়বস্তুর জন্য কিংবা কোনো দাবির অংশের জন্য নতুনভাবে মোকদ্দমা করার জন্য বাদীকে অনুমতি দেওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, সে ক্ষেত্রে আদালত উপযুক্ত শর্তে বাদীকে তার মোকদ্দমা প্রত্যাহার করে অথবা তার আংশিক দাবি পরিত্যাগ করার অনুমতি দিতে পারবেন এবং ওই মোকদ্দমার বিষয়বস্তু সম্পর্কে বা ওইরকম আংশিক দাবি সম্পর্কে পুনরায় মোকদ্দমা করার অনুমতি মঞ্জুর করতে পারেন। আদালতের উল্লিখিত অনুমতি ছাড়া যে ক্ষেত্রে বাদী মোকদ্দমা প্রত্যাহার করেন বা আংশিক দাবি পরিত্যাগ করেন, সে ক্ষেত্রে বাদী আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে মোকদ্দমার খরচার জন্য দায়ী হবেন এবং ওই বিষয়বস্তু বা আংশিক দাবি সম্পর্কে নতুনভাবে কোনো মোকদ্দমা দায়ের করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। এই নিয়মের কোনো বিধানবলে আদালত কয়েকজন বাদীর মধ্যে একজনকে অন্যান্য বাদীর সম্মতি ছাড়া মোকদ্দমা প্রত্যাহার করার অনুমতি দিতে পারেন না।

জনসচেতনায়

মো. সাব্বির রহমান

পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত), বাঞ্ছারামপুর মডেল থানা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।