প্রথম আলো:
সরকার আগামী এপ্রিল থেকে জাহাজে করে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করার পরিকল্পনা নিয়েছে। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের একদম প্রবেশমুখে, কাফকো ও সিইউএফএল জেটিতে এলএনজির জাহাজ ভেড়ানো হবে। এতে সংকুচিত হয়ে পড়বে দেশের অর্থনীতির প্রাণ চট্টগ্রাম বন্দরের চ্যানেল।
চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল ব্যবহার করে এখন সমুদ্রপথে কনটেইনার পণ্যের ৯৯ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি করা হয়। এলএনজির জাহাজের কারণে যেকোনো দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বন্দর। তা ছাড়া এই বন্দরে সাবধানে জাহাজ চলাচল করতে হবে। ফলে পণ্য আনা-নেওয়ার জাহাজ বন্দরে ভিড়তে সমস্যা হবে, বাড়বে জাহাজজট। গোটা অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়তে পারে। জ্বালানি মন্ত্রণালয়, পেট্রোবাংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
দেশের গ্যাস-সংকট সামাল দিতে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নেয় সরকার। কক্সবাজারের মহেশখালীতে সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জি লিমিটেড একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করছে। টার্মিনালটি থেকে এ বছরের শেষের দিকে গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে। দিনে এখান থেকে প্রায় ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস আসবে। এ ছাড়া দেশীয় প্রতিষ্ঠান সামিট একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করছে। এটির ক্ষমতাও দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট। এটি আসবে আরও ছয় মাস পরে। তারপরও চট্টগ্রাম চ্যানেলে এলএনজি টার্মিনালগুলোর বাইরে ছোট জাহাজে করে অল্প আকারে এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দ্রুত গ্যাস-সংকটের দোহাই দিয়ে দরপত্র ছাড়াই ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ) আইন’-এর আওতায় সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে সিঙ্গাপুর-বেলজিয়ামের কোম্পানি গুনভোর ও এক্সমার মেরিন ও সিঙ্গাপুরের কোম্পানি গানভরের কাছ থেকে এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে সরকার। কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানির (কাফকো) ও চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) জেটি ব্যবহার করে বিদেশি এই দুই প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারি সংস্থা পেট্রোবাংলা গ্যাস কিনে নেবে। প্রতিদিন এখান থেকে ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হবে। চলতি মাসেই সেখানে এলএনজির জাহাজ ভেড়ার কথা ছিল। সার কারখানা কাফকোর মূল বিনিয়োগ জাপানের। চুক্তি অনুযায়ী কাফকোর জেটিতে সার রপ্তানির জন্য কেবল তাদের নিজেদের জাহাজই থাকে।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান কমোডর জুলফিকার আজিজ বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বন্দরের কিছু তথ্য চাওয়া হয়েছে। তথ্যগুলো সরবরাহ করা হয়েছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করা হলে বিশেষজ্ঞ দিয়ে সমীক্ষা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলএনজিবাহী জাহাজের কারণে বন্দরের নৌচলাচল ব্যাহত হবে, এটা আমি জানি না। বন্দর কর্তৃপক্ষ বলতে পারে। বন্দর কর্তৃপক্ষ এখনো অনাপত্তিপত্র দেয়নি, কেন দেয়নি সেটিও আমি জানি না।’

বিপজ্জনক হবে বন্দরের চ্যানেল
চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ আনা-নেওয়ার জন্য কর্ণফুলী নদীর ১৬ কিলোমিটার নৌচলাচল পাড়ি দিতে হয়। দেশের প্রধান এ সমুদ্রবন্দরের জাহাজ ভিড়তে যে কর্ণফুলী নদী ব্যবহার করতে হয়, তার গড় প্রশস্ততা ৬০০ মিটার। নদীর নাব্যতা না থাকায় বাণিজ্যিক জাহাজ এ প্রশস্ততার মাত্র ৩০০ থেকে ৩৫০ মিটার দিয়ে যেতে পারে। কাফকো ও সিইউএফএলের জেটির যেখানে এলএনজির জন্য জাহাজ ভেড়ানো হবে, সে প্রান্তে চ্যানেলের প্রশস্ততা ৩০০ মিটার। বাণিজ্যিক জাহাজগুলো এ জেটির সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করে।
জানা গেছে, প্রতিদিন দুই কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করতে হলে বছরে কমপক্ষে ২৩০ দিন জাহাজ ভেড়াতে হবে কাফকোর জেটিতে। ভাসমান স্থাপনায় যখন এলএনজি জাহাজ ভেড়ানো হবে, তখন ৩০০ মিটার প্রশস্ত চ্যানেলের ২০ মিটার ওই এলএনজির জাহাজের দখলে চলে যাবে। এলএনজি জাহাজ থেকে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের নিরাপদ দূরত্ব কমপক্ষে ১৫০ মিটার। এ হিসাবে ৩০০ মিটার প্রশস্ত চ্যানেলের ১৭০ মিটার দিয়ে কোনো বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করতে পারবে না। অর্থাৎ কাফকো এলাকায় চ্যানেল সংকুচিত হয়ে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের পথ থাকবে ১৩০ মিটার। এই অবস্থান দিয়ে পাশাপাশি দুটি জাহাজ অতিক্রম করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
বন্দরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই টার্মিনাল বসানো হলে নৌপথে বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলের পথ সংকুচিত হয়ে নৌচলাচলে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। কোনো কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে চ্যানেল বন্ধ হয়ে যাবে। খুব দ্রুত নৌচলাচলও স্বাভাবিক করা যাবে না। পণ্য পরিবহনের বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় আমদানি-রপ্তানি খাতে বিপর্যয় তৈরির শঙ্কা রয়েছে।
সার কারখানার জেটিতে এলএনজির জাহাজ থাকলে বন্দরের নৌচলাচল ব্যাহত হবে-বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বন্দরের চ্যানেলের যে প্রশস্ততা ও গভীরতা, সেখানে এলএনজি আমদানির জন্য দুটি জাহাজ পাশাপাশি রাখলে বন্দরের নৌচলাচল ব্যাহত হতে পারে। বিষয়টি আরও বিশদভাবে জানতে এটি নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান জরিপ করছে।
নসরুল হামিদ আরও বলেন, সার কারখানার অবকাঠামো ব্যবহার করে এলএনজি আমদানির কারণ হলো চট্টগ্রাম অঞ্চলে দ্রুত গ্যাস-সংকটের একটা সুরাহা করা। কারণ, এখানকার এলএনজি প্রাথমিকভাবে চট্টগ্রামে দেওয়া হবে।

আগে থেকেই ঝুঁকিতে বন্দর
দেশের প্রধান বন্দর রুটে চলাচলকারী জাহাজের বেশির ভাগই পুরোনো ও জরাজীর্ণ। নিয়মিত চলাচলকারী কনটেইনার জাহাজ রয়েছে ৭৯ টি। এর মধ্যে ২০ বছরের বেশি পুরোনো জাহাজ আছে ২৩ টি। এ রুটে ২৮ বছর বয়সী জাহাজও চলাচল করছে। সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজেরও একই অবস্থা।
বন্দরের হিসাবে দেখা যায়, প্রতিদিন জোয়ারের সময় ১৬টি বাণিজ্যিক জাহাজ আনা-নেওয়া হয় বন্দরের মূল জেটি ও বিশেষায়িত জেটিগুলোতে। এর বাইরে গভীর সাগরে মাছ ধরার ট্রলার ও লাইটার জাহাজ রয়েছে শতাধিক। ২০০৯ সালের ২১ এপ্রিল বন্দর চ্যানেলের প্রবেশমুখে ছোট আকারের একটি লাইটার জাহাজডুবির ঘটনায় চ্যানেলটি ঝুঁকিমুক্ত করতে প্রায় ১৩ দিন সময় লেগেছিল। বন্দরে এখন এমনিতেই জাহাজজট রয়েছে। কোনো কারণে দুর্ঘটনায় চ্যানেল দু-তিন বন্ধ থাকলে ভয়াবহ জট তৈরি হয়।
বন্দরের তথ্যে দেখা যায়, গত বছর বন্দর চ্যানেল ও সাগরে মোট ৩৮টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে চ্যানেলেই ছোট-বড় ১২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০১৬ সালে ৩১টি দুর্ঘটনার মধ্যে বন্দর চ্যানেলে পাঁচটি দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে রয়েছে দুই জাহাজের সংঘর্ষ, জেটিতে আঘাত, জাহাজে আগুন, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জাহাজ পানির তলদেশে আটকে যাওয়া ইত্যাদি। এর মধ্যে জাহাজের ইঞ্জিন অচল ও স্টিয়ারিং কোনো কাজ না করার মতো ঘটনা রয়েছে। জাহাজ চলাচল বাড়ার সঙ্গে চ্যানেলে দুর্ঘটনাও বাড়ছে।
বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে বাণিজ্যিক জাহাজের পাশাপাশি নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের জাহাজও বাড়ছে। কিন্তু কর্ণফুলী নদী তো বড় হচ্ছে না। চ্যানেলের পাশে এলএনজি স্থাপনা ও জাহাজ হলে কিছুটা হলেও বন্দরের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে। জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য এলএনজি দরকার আছে, তবে সেটি কর্ণফুলী চ্যানেলে না করে অন্য জায়গায় করা যেতে পারে।
বন্দরের সবচেয়ে বড় ব্যবহারকারী তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকেরা। এই শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর বন্দর ও জাহাজীকরণ-বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেন, দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের আমদানি-রপ্তানি পণ্যের সিংহভাগই এই বন্দরের মাধ্যমে পরিবহন হয়ে থাকে। ফলে এই বন্দরে জাহাজ আনা-নেওয়ার পথে স্পর্শকাতর স্থাপনা গড়ে তুলে কোনো ঝুঁকি তৈরি করা একেবারেই উচিত নয়। বিকল্প বন্দর না থাকায় কোনো দুর্ঘটনায় চ্যানেল ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশের পুরো অর্থনীতিতে সংকট তৈরি হবে।