তাজুল ইসলাম পলাশ, চট্টগ্রাম:

উন্নয়নের নামে যখন তখন সড়কে খোঁড়াখুড়ি ও সংস্কার থেকে সৃষ্ট ধুলোর কারণে চট্টগ্রাম শহর এখন পরিণত হয়েছে ধুলোর নগরী। এ অবস্থায় পথচারিদের চলাচল করতে মাস্ক পড়ে। আবার অনেকে নাকে মুখে হাত চেপে ধরে রাস্তা পার হচ্ছেন। তাছাড়া সড়কের পাশে ব্যবসায়ীরা পড়েছেন আরো বিপাকে। সড়কের পাশে থাকা গাছ গাছারি আর যানবাহনও হয়ে গেছে ধুলোময়। এই হলো চট্টগ্রাম শহরের বর্তমান চিত্র। নগরবাসির মতে, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও যত্রতত্র ইটবালি সিমেন্টসহ নানা নির্মাণ সামগ্রী সড়কে ফেলে রাখার কারণে সৃষ্টি হচ্ছে প্রচুর ধুলিকণা। আর এই সব মিশে গিয়ে দুষিত হচ্ছে বাতাস। আর এসব দুষিত বাতাসে বাড়ছে রোগবালাই। এসব ধুলোবালিতে বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারীরা শ্বাসকষ্টসহ নিত্য নতুন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। চিকিৎসকেরা বলছেন, ধুলোবালি শ্বাস কষ্টের জন্য মারাত্ত্বক। ধুলোবালির কারণে চোখের রোগ, ব্রঙ্কাইটিস, যক্ষ্মা, পেট ফাঁপা, বদহজম ও অ্যালার্জিসহ ভাইরাসজনিত নানা রোগে আক্রান্তহওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া দীর্ঘদিন ধুলোবালির পরিবেশে থাকার ফলে ফুসফুসে ক্যান্সার ও কিডনিতে সমস্যা হতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ওয়াসা, বিদ্যুৎ বিভাগসহ, সিটি কর্পোরেশন (চসিক)সহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার কাজ চলছে নগরীতে। বর্ষা মৌসুমে সৃষ্টগর্তগুলো সময়ে ঠিক করা হয়নি। এছাড়া অধিকাংশ সড়কের কার্পেটিং উঠে গিয়ে প্রচুর ধূলিকণার উৎপত্তি হচ্ছে। সেসব ধূলিকণা যানবাহনের চাকার সাথে লেগে বাতাসে উড়ছে, ফলে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করাটাও যেন দায়। তাছাড়া সড়কের পাশে বহুদিন ধরে ফেলা রাখা হয়েছে নির্মাণ সামগ্রী। অতচ পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশনায় রয়েছে, যেখানে নির্মাণ সামগ্রী অথবা ধুলো উড়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে নিয়মিত পানি ছিটাতে হবে। এবং নির্মাণ সামগ্রীগুলো ঢেকে রাখতে হবে। কিন্তু কে শুনে কার কথা ?

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শাহ আমানত তৃতীয় সেতু মোড়, রাজাখালি, তুলাতুলি, কালামিয়া বাজার, রাহাত্তার পুল, ১ কিলোমিটার এলাকা ছাড়াও বহদ্দারহাট থেকে মুরাদপুর ও ২নম্বর গেইট পর্যন্ত ধুলো আর ধুলো। তাছাড়া মুরাদপুর থেকে আতুরার ডিপু হয়ে অক্সিজেন, বহদ্দারহাট থেকে বাস টার্মিনাল, সিএন্ডবি, কাপ্তাই রাস্তার মাথা পর্যন্ত সর্বত্রই ধুলোই দুষিত।

চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো. ওসমান গনি বলেন, গাড়ি নিয়ে বের হলেও গ্লাস খুলতে পারিনা। এতো ধুলো চলাফেরা দায় হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যেতে ধুলো থেকে পরিত্রাণ পেতে মাস্ক পড়াতে হয়। এসব দেখার কি কেউ নেই ?

কালামিয়া বাজার এলাকার এক দোকানদার বলেন, দীর্ঘদিন থেকে কাজ চলছে। কি-যে ধুলো তা আপনি নিজের চোখে দেখছেন। এভাবে কি ব্যবসা করা যায়। কয়েদিন দেখলাম রাতে গাড়ি এসে পানি ছিটাচ্ছে। কিন্তু রাতে’তো আর ব্যবসা করিনা।

মুরাদপুর এলাকায় গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে থাকা ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আল আমিন বলেন, বর্ষায় জলাবদ্ধতা আর শুস্ক মৌসুমে ধুলো’র যন্ত্রণা। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্টরা কি এগুলি দেখছেনা। দিনে অন্তত একবার হলেও পানি ছিটালে ধুলো থেকে থেকে রেহাই পাওয়া যেতো।

বহদ্দার হাট খাজারোড এলাকায় ওয়াই ডব্লিও সি স্কুলে বাচ্ছাকে দিতে এসে কথা হয় এ প্রতিবেদকের সাথে রোকসানা রহিমের। তিনি নগরীর এশিয়ান হাউজিং সোসাইটিতে থাকেন। তিনি বলেন, যেভাবে ধুলো উড়ছে বাচ্ছাদের নিরাপদের যথেষ্ট ঝুকিঁ রয়েছে। স্কুলেতো আসতে তাই বাচ্ছাকে মাস্ক পড়িয়ে দিতে হয়। আপনার একটু ভালো করে লিখতে পারেন না। এ শহরের কোন অভিবাবক নেই ?

এক কিলোমিটার এলাকায় কথা হয় রিক্সাচালক ওমর আলী’র সাথে। বয়স ষাট ছুই ছুই। তিনি শাহ আমানত সংযোগ সেতু সড়কে গাড়ি চালায়। হাঁপানির সমস্যা তার আগে থেকেই। নিশ্বাসের উপর নিশ্বাস। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে তার। তার মতে, শরীরে ন-ফারি, কিন্তু, ক্যান গইজ্জ্যম, ভাত’তো হাইতে অইবো, এন ক্যান ধুলো, এই শহরের হ-ন মা বাপ নাই। মানুষ’তো মরি যাইবোই। ( শরীরে আর পারিনা, কিন্তু কি করবো, ভাত’তো খেতে হবে, এতো ধুলো কেন, এই শহরের কি কোন মা বাবা নেই। মানুষতো মারা যাবে।

পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, যদি বাতাসের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) মাত্রা শূন্য থেকে ৫০ পিপিএম হলে তাকে ‘সবুজ বা স্বাস্থ্যকর’, একিউআই মাত্রা ৫১ থেকে ১০০ পিপিএম হলে তাকে মধ্যম বায়ু বলা হয়, যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়। একিউআইয়ের মাত্রা ১০১ থেকে ১৫০ পিপিএম হলে সে বায়ুকে ‘সর্তকতামূলক’ বায়ু বলা হয়, যেটা মানুষের জন্য মৃদু ক্ষতিকর। একিউআইয়ের মাত্রা ১৫০ থেকে ২০০ পিপিএম হলে তা অস্বাস্থ্যকর। ২০১ থেকে ৩০০ পিপিএম হলে তা খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং মাত্রা ৩০১ থেকে ৫০০ পিপিএম হলে তা চরম পর্যায়ের অস্বাস্থ্যকর বায়ু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

এরকম সারা দেশে ১১ টি সার্বক্ষণিক বায়ুমান পরিক্ষণ স্টেশন চালু রয়েছে। সেখানের মধ্যে চট্টগ্রামে রয়েছে দুটি।

এ বিষয়ে চানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক আজাদুর রহমান মল্লিক বলেন, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় উন্নয়ন কাজ হচ্ছে। বিশেষ করে ওই সব এলাকায় ধুলোবালির মাত্রা বেশি। এছাড়া শুষ্ক মৌসুম হওয়ায় এর মাত্রা আরো বেড়েছে। নগরবাসী এ ধুলো থেকে পরিত্রাণের কোন উপায় আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, যারা এসব কাজ করছে তারা পরিবেশগতভাবে কোন ধারনা নেই। পরিবেশ ছাড়পত্র নিতে তারা আমাদের কাছে আসেও না। অন্যদিকে ফ্লাইওভারের নির্মাণ সামগ্রী কিভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, এ ব্যপারে বিধিমালাতে কিছু নেই।

পরিবেশবিদ বখতিয়ার উদ্দিন জানান, যেভাবে পুরো নগরীতে ধুলো উড়ছে তাতে করে আগামী প্রজন্ম স্বাস্থ্য ঝুকিতে পড়বে এটা নি:সন্দেহে বলা যায়। কর্তৃপক্ষের উচিত সকাল বিকেল একবার করে দৈনিক পানি ছিটাতে। নিত্য ধুলোবালির কারণে বায়ু দুষণজনিত রোগবালাই বৃদ্ধিও আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন তিনি বলেন, ঢাকার দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন এ কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে, এখানে কেন হচ্ছেনা প্রশ্ন রাখেন তিনি।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সহকারি অধ্যাপক ডা. মোস্তফা মাহফুজুল আনোয়ার বলেন, ধুলাবলির সাথে অতিমাত্রায় ক্ষতিকর পদার্থ মিশ্রিত শ্বাসনালী ও ফুসফুসের ক্যান্সার হতে পারে। এর চোখের ওপরও প্রভাব পড়তে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গভেষণা সংস্থার হেলথ ইনফেক্টস ইনষ্টিটিউটের মতে দেশে প্রতিবছর বায়ু দুষণের কারনে ১ লাখ ২২ হাজার মানুষ মারা যায়।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাসির উদ্দীন বলেন, ‘নানা সীমাবদ্ধতার কারণে ধুলাবালি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব হচ্ছে না ।

চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো আজিজুর রহমান বলেন, ধুলোবালির কারণে ফুসফুসে জমে থাকা প্রদাহ সৃষ্টি করে চোখের রোগ, আ্যজমা, যক্ষ্মা, অ্যালার্জিসহ নানা ধরেনের জটিল হতে পারে। তাছাড়া এর দীর্ঘদিন ধরে থাকলে ফুসফুসে ক্যান্সার ও কিডনিতে সমস্যা হতে পারে। তাছাড়া মাথায় ধুলোবালি জমে থাকার কারনে চুল পড়ে যেতে পারে।

ধুলোবালিতে পানি ছিটানো প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা শফিকুল মান্নান সিদ্দিকী বলেন, নগরীর যেখানে ধুলোবালি আছে সেখানে প্রতিদিন পানি ছিটানো হচ্ছে।