বিদেশ ডেস্ক:
মিয়ানমারের সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিং অনের তীব্র সমালোচনা করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্থনিও গুয়েতেরেস। অতীতের ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি আবারও রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয় অস্বীকার করে তাদের বাঙালি আখ্যা দেন। জাতিসংঘ মহাসচিব মিয়ানমারের সেনা নেতৃত্বকে ঘৃণাবাদী সংস্কৃতির বাইরে আসার তাগিদ দিয়েছেন। মিয়ানমার তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দিনকে দিন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অসম্ভব করে তুলেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রোহিঙ্গারা রাখাইনে থাকলেও মিয়ানমার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। উগ্র বৌদ্ধবাদকে ব্যবহার করে সেখানকার সেনাবাহিনী ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে স্থাপন করেছে সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাসের চিহ্ন। ছড়িয়েছে বিদ্বেষ। ৮২-তে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনে পরিচয়হীনতার কাল শুরু হয় রোহিঙ্গাদের। এরপর কখনও মলিন হয়ে যাওয়া কোনও নিবন্ধনপত্র, কখনও নীলচে সবুজ রঙের রশিদ, কখনও ভোটার স্বীকৃতির হোয়াইট কার্ড, কখনও আবার ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড’ কিংবা এনভিসি নামের রং-বেরঙের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষকে। ধাপে ধাপে মলিন হয়েছে তাদের পরিচয়। ক্রমশ তাদের রূপান্তরিত করা হয়েছে রাষ্ট্রহীন বেনাগরিকে। তাদের আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘বাঙালি’ নামে।
সোমবার এক সেনা সমাবেশে অতীতের ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি এক সেনা সমাবেশে মিয়ানমারের শীর্ষ জেনারেল মিং অন আবারও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের অধিবাসী হিসেবে মানতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি তাদের বাঙালি আখ্যা দেন। বলেন, মিয়ানমারের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের চরিত্রের কোনও মিল নেই। কোচিনের সেনা সমাবেশে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান রোহিঙ্গাদের বাঙালি আখ্যা দিয়ে দাবি করেন, তাদের নাগরিকত্বের দাবিই চলমান সংকটের কারণ। বিপরীতে গুয়েতেরেস এক বিবৃতিতে জানান, সেনাপ্রধানের এই বক্তব্যে তিনি মর্মাহত। রোহিঙ্গাদের প্রতি ঘৃণাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে আসতে মিয়ানমারের নেতৃত্বকে তিনি সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন। আহ্বান জানান, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে রক্ষা করার।

রাখাইনের বিভিন্ন গ্রামে সেনাবাহিনী কর্তৃক বুলডোজার চালিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের আলামত নষ্ট, সামরিক ঘাঁটি নির্মাণসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ‘আদর্শ বৌদ্ধ গ্রাম’ নির্মাণ চলমান থাকা সত্ত্বেও এখনও মিয়ানমার বলে যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় তৎপরতা চলমান রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, রোহিঙ্গাদের একাংশকে ফিরিয়ে নিলেও মিয়ানমার তাদের রাখাইনে তাদের স্থায়ী আবাস নিশ্চিত করবে না। নতুন করে নির্মিত আশ্রয়শিবিরগুলোই হবে তাদের চিরস্থায়ী আবাস। তবে মংডু জেলার প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইয়ে হটুট সাংবাদিকদের বলেছেন, রোহিঙ্গাদেরকে ওইসব শিবিরে ‘চিরতরে’ থাকতে হবে না। তাদের মূল গ্রাম কিংবা কাছাকাছি এলাকায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে দাবি করেন এ কর্মকর্তা। মূল গ্রামের কাছাকাছি নির্মাণাধীন তেমন একটি পুনর্বাসন কেন্দ্র সরেজমিন পরিদর্শনকালে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি সম্প্রতি দেখেছে, কাজের গতি খুব ধীর। সেখানকার কর্মকর্তারা বলেছেন, এগুলো রোহিঙ্গাদের জন্য বানানো হচ্ছে না। এএফপি মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে মিয়ামার কর্তৃপক্ষের এই ভূমিকাকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন-প্রস্তুতির ‘ভেঁপু বাজানো’ আখ্যা দিয়েছে।
গুয়েতেরেস তার বিবৃতিতে বলেছেন, পরিস্থিতি এমন করে রাখা হয়েছে যে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ নিশ্চিত করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গা সংকট তদন্তে মিয়ানমারে প্রবেশাধিকার চাইলেও নেপিদো কর্তৃপক্ষ এখনও তাদের অনুমতি দেয়নি। জানুয়ারিতে সম্পাদিত ঢাকা-নেপিদো প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়া শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বাংলাদেশের পাঠানো প্রথম ৮ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা নিয়েই শুরু হয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। এর ফরম্যাট বদল করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে মিয়ানমার। পালিয়ে আসা প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে ৩৭৪ জনকে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় অপরিহার্য শর্ত হিসেবে চাওয়া হয়েছে বৈধ কাগজপত্র। অথচ বেশিরভাগ রোহিঙ্গা পুড়ে যাওয়া সম্বল ফেলে পালিয়ে এসেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রত্যাবাসন চুক্তিকে মিয়ানমারের ধোঁকাবাজি আখ্যা দিয়েছে।