সিবিএন ডেস্ক:
বিশ্বে প্রতি আটশত শিশুর মধ্যে একজন ডাউন সিনড্রোম শিশু (প্রকৃতির খেয়ালে তৈরি বিশেষ প্রকৃতির শিশু) জন্ম নেয় বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও)। আর বাংলাদেশে প্রতি বছর ৫ হাজার ডাউন সিনড্রোম নিয়ে শিশু জন্মায়। সে হিসাবে প্রতিদিন ডাউন ডিনড্রোম নিয়ে জন্ম নেয় ১৫ শিশু। বর্তমানে দেশে প্রায় ২ লাখ শিশু এ সমস্যায় ভুগছে। এই অবস্থা থেকে শিশুকে রক্ষা করতে সচেতনতা জরুরি বলে মনে করছেন ডাউন সিনড্রোম নিয়ে গবেষকরা।

গবেষকদের মতে, ডাউন সিনড্রোম একটি শিশুর বংশানুগতিক সমস্যা, যা শরীরে ক্রোমোজোমের একটি বিশেষ অবস্থা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুণ্ডু বলেন, ‘১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের সারে শহরের একটি মানসিক প্রতিবন্ধী আবাসনের সুপারিন্টেন্ডেট জন ল্যাংডন ডাউন খেয়াল করেন, প্রতিবন্ধীদের মধ্যে একাংশ চেহারায় অন্যদের থেকে একটু আলাদা। তার তাদের মুখ একটু চ্যাপ্টা, ঘাড়টা ছোট। তিনি এদের মোঙ্গলয়েড নাম দেন। এরপর থেকে এটি ডাউন’স সিনড্রোম বা শুধু ডাউন সিনড্রোম বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্থান পায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘ডাউন সিনড্রোম জন্মের আগেই শনাক্তকরণসহ প্রতিরোধই সর্বোত্তম পন্থা। প্রতিটি মা-বাবার উচিত, সঠিক বয়সে সন্তান ধারণ করা। বিশেষত মা বেশি বয়সে সন্তান ধারণ করলে এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই এ ব্যাপারে সাবধান হওয়াই এ রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র উপায়। সন্তান মায়ের পেটে আসার ১০ থেকে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে এ রোগ শনাক্ত করা যায়। যেমন—আল্ট্রাসোনোগ্রামের মাধ্যমে, মায়ের রক্ত নিয়ে (ম্যাটারনাল সেরাম) বা মায়ের পেটের পানি নিয়ে পরীক্ষা (এমনিওসেটেসিস), ভ্রূণের টিস্যু নিয়ে পরীক্ষা করা (সিভিএস) ইত্যাদি।

ডা. গোপেন কুমার কুণ্ডু বলেন, ‘মানবদেহে ডিএনএ বা ক্রোমোজোমের অসামঞ্জস্য দেখা দিলে নানা রকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এই শিশুদের মাংসপেশীর শিথিলতা, কম উচ্চতা, চোখের কোনা ওপরের দিকে ওঠানো, চ্যাপ্টা নাক, ছোট কান, হাতের তালুতে একটি মাত্র রেখা ও জিব বের হয়ে থাকা, এসব বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এছাড়া কানে কম শোনা, কথা বলতে দেরি হওয়া, কম বুদ্ধি ইত্যাদি জটিলতা দেখা দেয়। অনেক সময় ডাউন সিনড্রমের সঙ্গে হার্টের সমস্যা, থাইরয়েডের সমস্যাও থাকতে পারে। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসার মাধ্যমে এ সমস্ত উপসর্গ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, সময়মত পরিচর্যা ও চিকিৎসার মাধ্যমে শারীরিক সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। উপযুক্ত পরিবেশ ও বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে বড় করতে পারলে ডাউন শিশুরা কর্মক্ষম হয়ে অর্থবহ জীবন-যাপন করতে পারে।

ব্রাউন ইউনিভার্সিটি, ইউএসএর আইএমএন অ্যান্ড ইজিবি প্রজেক্টের গবেষণা সহযোগী, পেশাদার মনোবিজ্ঞানী ও আন্তর্জাতিক উন্নয়নকর্মী সেলিনা শিরীন শিকদার বলেন, ‘‘বিভিন্ন গবেষণার আঙ্গিকে বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, সন্তানকামী দম্পতিরা যদি সচেতন হয়ে ওঠেন, তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘ডাউনসসিড্রম’-এর প্রাদুর্ভাব কমিয়ে আনা সম্ভব। এ বিষয়ে তিনটি পরামর্শ রয়েছে। প্রথমত, বেশি বয়সে গর্ভধারণ এড়িয়ে চলা। মায়ের বয়সজনিত ঝুঁকি নিয়ে নয়-এর দশকে যুক্তরাজ্যের গালানো একটি গবেষণায় দেখেছেন ৫৮ ভাগ ‘ডাউন সিনড্রম’-এর ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে, নয়-এর দশকেই স্টেন ও রুটকোস্কি তাদের গবেষণায় দেখেছেন, বাবা-মা উভয়েরই যদি অধিক বয়সে সন্তান ধারণ করেন ‘ডাউন সিনড্রম’-এর ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই ঝুঁকি কমে আসে মা যদি বয়সে বাবার তুলনায় তরুণ হন। সুতরাং নারীর হাতে গর্ভধারণের বয়স নিয়ে ভাববার একটি সুযোগ রয়েছে।

দ্বিতীয়ত, যে সব দম্পতি এটির এর উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, তাদের জেনেটিক ডায়গনোসিস করা। এই প্রক্রিয়ায় প্রাক-গর্ভকালীন এবং গর্ভধারণের পরে গর্ভজাত এমব্রায়োর জেনেটিক প্রোফাইল তৈরি করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় বাবা-মা যখনই জানতে পারছেন, তাদের স্বাভাবিক সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা কম, বরং গর্ভজাত শিশুটির ‘ডাউন সিনড্রম’-এর সম্ভাবনা বেশি, দম্পতিটির হাতে তখন গর্ভপাতের অপশনটি থাকে। এটিও মাধ্যমিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা।

তৃতীয়ত, ফলিক এসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহন করা। প্রাণ-রসায়নিক, আণুবিকবিজ্ঞান ও মহামারি-বিদ্যার কিছু গবেষণায় দেখা গেছে ফোলেইট ও মিথাইল মেটাবলিজমেরত্রুটির সঙ্গে ‘ডাউন সিনড্রম’-এর একটি সম্ভাব্য যোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে ফলিক এসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করার কথা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু এই প্রতিরোধ ব্যবস্থার বিষয়ে খুব জোরালো ও সর্বজনীন উপাত্ত-প্রমাণ এখনও প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি। তবে আশার কথা এই, বিশ্বব্যাপি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে-সঙ্গে এ নিয়ে গবেষণা চলছে। মধ্য আয়ের দেশ বাংলাদেশেও গবেষণার পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

এই রোগটি নিয়ে এখনও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি উল্লেখ করে সেলিনা শিরীন শিকদার বলেন, ‘‘এর অন্যতম কারণ এই বিশৃঙ্খলার মূল কারণ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এখনও অপর্যাপ্ত। তবে মাধ্যমিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে রয়েছে, সেগুলো হলো—‘মা-বাবার বয়সজনিত ঝুঁকি’ এবং সে সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত, প্রাক-গর্ভ জেনেটিক রোগ নির্ণয় ও ফলিক এসিড সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ।’’

এই রোগ বাংলাদেশে প্রতিরোধ প্রসঙ্গে সেলিনা শিরীর শিকদার বলেন, ‘আমরা জানি, এটি খুব সাধারণ একটি জেনেটিক বিশৃঙ্খলা, যা মাতৃগর্ভেই নির্ধারণ হয়ে যায়। তখন একটি ‘ডাউনস’ শিশু মানসিক ও শারীরিক—দুই ধরনের অনগ্রসর অবস্থা নিয়েই পৃথিবীতে আসে। বাংলাদেশে আমরা যদি এটি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠি, অনেক ক্ষেত্রেই এই বিশৃঙ্খলার প্রাদুর্ভাব থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত থাকা সম্ভব। উন্নত বিশ্বে গর্ভধারণ নিয়ে যেসব কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম আছে, সেখানে ভবিষ্যৎ বাবা-মাকে এটি সম্পর্কে সচেতন করা হয়। সচেতন করবার উদ্দেশে হ্যান্ডআউট দেওয়া হয়, ভিডিও দেখানো হয়।’ বাংলাদেশেও প্রতিটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে এই ধরনের প্রোগ্রাম চালু করা জরুরি বলে করেন তিনি।