মং জার্নি

অধ্যাপক অমর্ত্য সেন উন্নয়নকে চমৎকারভাবে ‘স্বাধীনতা’ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় ‘উন্নয়ন’ শব্দটি তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অমর্ত্য সেন যখন অধ্যাপনা করতেন, তখন তাঁর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিলেন মিয়ানমারের বর্তমান কার্যত সরকারপ্রধান অং সান সু চি। অমর্ত্য সেনের সেই ছাত্রীটি নিশ্চয়ই ‘উন্নয়ন’-এর মানে বোঝেন। এ কারণে তিনি তাঁর রাখাইনবিষয়ক উপদেষ্টামণ্ডলী এবং আন্তর্জাতিক মিত্রদের গণহত্যাকে ‘উন্নয়নের ঘাটতি’ হিসেবে তুলে ধরতে পরামর্শ দিয়ে রেখেছেন। তাঁরাও সমানে এই কথা বলে যাচ্ছেন। কিন্তু সু চি শিবিরের এই প্যাঁচানো কথার সত্যতায় গলদ রয়ে গেছে। সেটা হলো: (অর্থনৈতিক) উন্নয়নের অনুপস্থিতির কারণে কখনো গণহত্যা হয় না, মানবতাবিরোধী অপরাধও হয় না। সাধারণত সুশিক্ষিত ও সচ্ছল গোষ্ঠী ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে গণহত্যা চালায়। হিটলারের ঘনিষ্ঠ সহচরদের প্রায় সবাই হার্ভার্ড ও হামবুর্গ থেকে পাস করা উচ্চশিক্ষিত নাৎসি ছিলেন এবং ওয়াল স্ট্রিটের আইকন হিসেবে পরিচিত ধনকুবেরদের সঙ্গে তাঁরা খানাপিনা করতেন।

অশিক্ষিত এবং না খাওয়া লোকজন খিদের জ্বালায় কিংবা অস্তিত্বসংকট থেকে বড়জোর রাস্তাঘাটে ছিঁচকে অপরাধ করে বেড়ায়। কিন্তু গণহত্যার অর্থ ব্যাপক। পরিকল্পিত ছক অনুযায়ী রাষ্ট্র যখন সংখ্যালঘুদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য শুদ্ধি অভিযানের মতো নৃশংস অভিযান চালিয়ে মানুষ মারতে থাকে, তখন সেটিকে গণহত্যা বলা যেতে পারে। কেউ যদি সু চির মিত্রদেশ যুক্তরাজ্যের কিংবা সু চির উপদেষ্টা দলের মধ্য থেকে আসা নীতিবিষয়ক ঘোষণাগুলোর দিকে লক্ষ করেন, তাহলে দেখতে পাবেন সু চির এই সরকার পুরো মাত্রায় কর্তৃত্ববাদী। গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও এ সরকারে নেই। তাঁরা আত্মপ্রতারণার মতো বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে বলছেন, উন্নয়নই হচ্ছে রাখাইন সমস্যার একমাত্র সমাধান।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সেনারা রাখাইনে ‘নিরাপত্তাজনিত উচ্ছেদ অভিযান’ শুরু করার পর রোহিঙ্গাদের যে অবস্থা হয়েছে, সেটিকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে সু চির ক্ষমতার অন্যতম অংশীজন সিনিয়র জেনারেল মিন অং লাই কয়েক দিন আগে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে যে লড়াই হয়েছিল, সেই লড়াইয়ের ‘অমীমাংসিত বিষয়’ হচ্ছে এখনকার সহিংসতা।

ক্ষমতার জন্য লালায়িত এসব বার্মিজ আমলা স্বীকারই করেন না মিয়ানমারে গণহত্যা কিংবা জাতিগত নিধন চলছে। ব্রিটিশ সরকারও তাদের স্বার্থ রক্ষায় সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকা অক্সফোর্ড পড়ুয়া সু চির পক্ষে জোর প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। রাখাইনে চালানো গণহত্যার দায় থেকে সু চিকে বাঁচানোর জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যরা সব ধরনের চেষ্টা করছেন। কিন্তু তারপরও শান্তিতে নোবেলজয়ী সু চিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের দৃষ্টিসীমার বাইরে রাখা সম্ভব হয়নি। নোবেলজয়ী পরিচয় ছাপিয়ে ক্রমেই তিনি ‘গণহত্যার সহযোগী’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠছেন।

তবে ব্রিটেনের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড সম্প্রতি সু চিকে ‘মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক উত্তরণের অধিনায়ক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বার্মা সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে পৌঁছাতে আমি মনে করি এই অবস্থাতেও দেশটির গণতান্ত্রিক উত্তরণযাত্রাকে যুক্তরাজ্যের সমর্থন জানাতে হবে এবং দেশটির স্বাধীনতা, সহিষ্ণুতা ও বৈচিত্র্যকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করতে হবে।’

এফসিওর (ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস) অবসরপ্রাপ্ত মাননীয় কর্মকর্তা (মার্ক ফিল্ড), ‘দীর্ঘমেয়াদি সমাধান’ বলতে আপনি কী বোঝাতে চান? রোহিঙ্গাদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য আজ থেকে ৪০ বছর আগে ১৯৭৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমার সরকার যে অভিযান শুরু করেছিল, তার ধারাবাহিকতাকেই কি আমরা ‘দীর্ঘমেয়াদি সমাধান’ হিসেবে ধরে নেব?

সম্প্রতি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে একটি শুনানি হয়েছে। সেখানে মিয়ানমারে গণতন্ত্রের উন্নয়নে আর্থিক সহায়তাদানকারী ওয়েস্টমিনস্টার ফাউন্ডেশন ফর ডেমোক্রেসির প্রতিনিধিদের বক্তব্য শোনা হয়। সেখানে ওই প্রকল্পের দুজন কর্মকর্তা স্বীকার করতে বাধ্য হন, তাঁদের এই প্রকল্প মিয়ানমারের কয়েক শ এমপির মধ্যে একজন এমপিও সৃষ্টি করতে পারেনি, যিনি রোহিঙ্গাদের পক্ষ নিয়ে কথা বলতে পারেন।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রাতিষ্ঠানিক নীতি হিসেবে ‘নো মুসলিম অফিসার’ নীতি মেনে চলে। সু চিও সেই নীতি অনুসরণ করে ইতিমধ্যে তাঁর দল এনএলডিকে মুসলিম প্রতিনিধিমুক্ত করে ফেলেছেন। মিয়ানমারে আধুনিক আইনসভা চালুর পর এবারই প্রথমবারের মতো মুসলিমবিহীন পার্লামেন্ট চলছে এবং এটির নিয়ন্ত্রণে আছে শান্তির দূত সু চির দল এনএলডি। পরিহাসের বিষয় সাবেক জেনারেল থেইন সেইনের আমলে মিয়ানমারের সুশীল সমাজ যতটা প্রকাশ্য হতে পারত, এখন সু চির আমলে তারা সেটুকুও পারে না। তবু যুক্তরাজ্যের মতো দেশের কর্মকর্তারা অবিরাম বলছেন, সু চিই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। এ কারণে তাঁরা তাঁর পাশে থাকবেন।

ইংরেজি থেকে অনূদিত।
মং জার্নি: মিয়ানমারের নির্বাসিত মানবাধিকারকর্মী