বিদেশ ডেস্ক:
১০০০ মার্কিন টোমাহক-রকেট ইরাকের আকাশের দখল নিয়েছিল ২০০৩ সালের আজকের দিনটিতে। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ ‘চূড়ান্ত ইনসাফ প্রতিষ্ঠা’র (অপারেশন ইনফিনিট জাস্টিস) ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মাথায় মাঝরাতের (ভোর চারটা) বাগদাদ জেগে উঠেছিল বিস্ফোরকের সশব্দ আতঙ্কে। সেই ইরাক আগ্রাসনের ১৫ বছর অতিক্রান্ত হলো আজ মঙ্গলবার (২০ মার্চ, ২০১৮)। গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার মিথ্যে অভিযোগে প্রত্যক্ষ আগ্রাসন শুরু করেছিলেন বুশ নেতৃত্বাধীন জোট। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বুশ বলেছিলেন, ইরাকী জনসাধারণকে মুক্ত করতে এবং বিশ্বকে মহাবিপদ থেকে মুক্ত করতে তিনি এই যুদ্ধ শুরু করেছেন। আর যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী তার জেনারেল বলেছিলেন, মরদেহ গোনা তাদের কাজ নয়। বুশের মুক্তির লড়াই আর তার জেনারেলের অবজ্ঞার স্রোতে গত ১৫ বছরে হারিয়ে গেছে আনুমানিক ১৫ থেকে ৩৪ লাখ লাখ তাজা প্রাণ। ডেমিওগ্রাফিক পদ্ধতি ব্যবহার করে নির্ভরযোগ্য ও স্বনামধন্য কয়েকটি জরিপ প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে একজন মার্কিন রাজনীতি বিশ্লেষক এবং একজন মানবাধিকার সংগঠক তাদের এক অনুসন্ধানে গত ১৫ বছরে ২৪ লাখ ইরাকির মৃত্যুর সম্ভাব্যতা হাজির করেছেন।
ইরাক যুদ্ধের ১৬তম বর্ষে পদার্পণ

৯৬ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেডলিন অরব্রাইট তাদের দেওয়া অর্থনৈতিক অবরোধে ৫ লাখ ইরাকি শিশুর মৃত্যুকে স্বাভাবিক আকারে বর্ণনা করেছিলনে সাংবাদিকদের সামনে। বলেছিলেন, সিদ্ধান্তটা কঠোর বটে, তবে যে লক্ষ্যে এটা নেওয়া হয়েছে তার মূল্য হিসেবে এটা (৫ লাখ শিশুর জীবন) অস্বাভাবিক নয়। আগ্রাসনের সময়ে ইরাকের দায়িত্বে থাকা জেনারেল টমি ফ্র্যাঙ্কস বলেন, ‘মরদেহের সংখ্যা গুনে রাখাটা আমাদের কাজ নয়’ তবে গত দেড় দশকে অবিরত বেড়েছে মৃতের সংখ্যা। ক্রমাগত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে মরদেহের মিছিল।। মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ ও আন্দোলন সংস্থা ওয়ার্ল্ড বিয়ন্ড ওয়ারের মতে, এই সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছেই। ইরাক যুদ্ধ বইয়ের পাতায় লেখা ইতিহাস হয়ে উঠেনি এখনও। এখনও এটি চলমান বাস্তব।

গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার ‘নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য’ সঙ্গে আছে দাবি করে ইরাকে আগ্রাসন শুরু করে বুশ নেত্বত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী জোট। যুদ্ধ শেষে অনেক মার্কিন ও ব্রিটিশ কর্মকর্তাই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াকে ভুল সিদ্ধান্ত ছিল বলে স্বীকার করেন। কিন্তু এই ভুলটি আগ্রাসন শুরু হওয়ার আগেই বুঝতে পেরেছিলেন বাগদাদে নিযুক্ত জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শক সংস্থা ‘আনমোভিক’ এর প্রধান হ্যান্স ব্লিক্স। সিএনএন নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হ্যান্স ব্লিক্স বলেন,আগ্রাসন শুরুর তিন সপ্তাহ আগে সম্ভাব্য হামলার খবর পাই আমরা। কিন্তু এটা যে অনেক বড় ধরনের ভুল ছিল সেটা জেনেও কাউকে বোঝাতে পারিনি!” ব্লিক্স বলেন, “কেন ঐ ভয়ংকর ভুলটি করা হয়েছিল তা এখন পর্যন্ত বোধে আসে না আমার। জাতিসংঘের আইন লঙ্ঘন করা হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নীরবতা ছিল সত্যিই বিস্ময়কর।”

যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সংখ্যা বিবেচ্য না হলেও একটি মৃত্যু সংখ্যা কেবল নয়। মৃত মানুষটি কারও সন্তান, বাবা-মা, ভাই-বো কিংবা স্বামী-স্ত্রী কিংবা কোনও হারানো স্বজন। তাদের গণবিধ্বংসী অস্ত্র সংক্রান্ত ভুল অনুমানের বলি হয়েছে অন্তত ২৪ লাখ ইরাকি, এক বিশ্লেষণে বলতে চেয়েছেন দুই রাজনীতি বিশ্লেষক। তারা হলেন উইমেন ফর পিস ও গ্লোবাল এক্সচেঞ্জ নামের দুটি মানবতার পক্ষের সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মেদেয়া বেঞ্জামিন এবং মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির বিশ্লেষক নিকোরাস ডেভিস। বেঞ্জামিন ও ডেভিস বলছেন, ২০০১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের নিয়ে যেসব দেশে হামলা করেছে, সে সব দেশের অনেক গুলোতেই ডেমোগ্রাফিক জরিপ পদ্ধতি ব্যবহার করে হতাহতের সংখ্যা নিরুপণ করা হয়েছে। একই পদ্ধতিতে হতাহতের সংখ্যা নিরুপন করা হয়েছে অ্যাঙ্গোলা, বসনিয়া, কঙ্গো, গুয়াতেমালা, কোসোভো, রুয়ান্ডা, সুদান ও উগান্ডাতে। সাংবাদিক, এনজিও ও সরকারি তথ্য অনুযায়ী তৈরি করা এই জরিপে সব দেশের ক্ষেত্রেই ঘোষিত সংখ্যার ৪/৫ গুণ মৃত্যুর ভয়াবহতা উঠে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্র অন্য দেশের বেলায় এই জরিপ পদ্ধতিকে স্বীকৃত মনে করে, তবে নিজেদের আগ্রাসনের শিকার হওয়া অঞ্চলের বেলায় তারা একে ‘অগ্রহণযোগ্য গবেষণা পদ্ধতি’ নামে ডাকে। অবশ্য ব্রিটিশ সরকারি কর্মকর্তারা গোপনে স্বীকার করেছেন সেই প্রতিবেদনটির তথ্য সঠিক হয়ে থাকতে পারে। তবে রাজনৈতিক কারণে এগুলো প্রকাশ্যে অস্বীকার করছেন তারা। ২০১৫ সালে ফিজিশিয়ান ফর সোশ্যাল রিসপন্সিবিলিটি কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন আবারও সামনে আনে ইরাক যুদ্ধে নিহতের প্রকৃত সংখ্যার প্রশ্নটি। ‘বডি কাউন্ট: ক্যাজুয়ালটি ফিগারস আফটার টেন ইয়ারস অব দ্য ‘ওয়ার অন টেরর’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ল্যানসেটে প্রকাশিত জরিপটি অন্যান্য যেকোনও গবেষণা প্রতিবেদনের চেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ল্যানসেটে প্রকাশিত ওই গবেষণাটি করা হয় ১১ বছর আগে। ৪০ মাসের ওপর করা ওই প্রতিবেদনেই বোঝা গিয়েছিলো ইরাক যুদ্ধের শেষ খুব কাছে নয়।

জাস্ট ফরেন পলিসি নামক অলাভজনক সংস্থার ইরাক যুদ্ধে হতাহতর পরিসংখ্যান সংক্রান্ত কর্মসূচি ইরাকি ডেথ এস্টিমেটর এবং ব্রিটিশ এনজিও ইরাক বডি কাউন্ট তাদের সম্মিলিত গবেষণায় ২০১১ সালের সেপ্টম্বর পর্যন্ত সাড়ে চৌদ্দ লাখ সম্ভাব্য মৃত্যুর পরিসংখ্যান হাজির করেছে। অপিনিয়ন বিজনেস রিসার্চ ২০০৭ পর্যন্ত ১৩ লাখ ৩০ হাজার প্রাণহানির সম্ভাব্য পরিসংখ্যান দিয়েছে। বেঞ্জামিন ও ডেভিস ওআরবির পরিসংখ্যানে জাস্ট ফরেন পলিসির পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন। ইরাকি বডি কাউন্টের সবশেষ পরিসংখ্যানকে উপজীব্য করে ওই পদ্ধতি প্রয়োগ করে তারা ২৪ লাখ ইরাকির মৃত্যুর সম্ভাব্যতা খুঁজে পেয়েছে।