নেপালে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সংবাদ সম্মেলন

* মঙ্গলবার দেশে ফিরছে ১৬জন বাংলাদেশীর লাশ- রাষ্ট্রদূত
* প্লেন সাভাবিক ভাবে ল্যান্ড করেনি -ত্রিভূবন বিমান বন্দরের মহাব্যবস্থাপক
* পাইলটসহ কেবিন ক্রুদের লাশের ১২ রকমের বিশেষ পরীক্ষা -বাংলাদেশের তদন্ত দলের সদস্য

মইন উদ্দীন, কাঠমান্ডু (নেপাল) থেকে ॥
নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে ইউএস বাংলা প্লেনের দূর্ঘনায় নিহত ৪৯ জনের লাশ হস্তান্তর শুরু হচ্ছে আগামী মঙ্গলবার। কাঠমান্ডর ত্রিভুবন ইউনিভার্সিটি (টিইউ) টিচিং হাসপাতালে গতকাল শুক্রবার নিহত সকলের লাশের ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে। নেপালে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস, ত্রিভুবন ইউনিভার্সিটি (টিইউ) টিচিং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সোহেল আহমেদ সাংবাদিক সম্মেলন করে এ তথ্য জানিয়েছেন।
রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস বলেছেন, আগামী মঙ্গলবার লাশ হস্তান্তর করা হবে। সে হিসেবে মঙ্গলবার দেশে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে নিহত বাংলাদেশী ১৬ জনের লাশ। এদিকে নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরের মহাব্যবস্থাপক রাজ কুমার ছত্রী বলেন, উড়োজাহাজটি নরমাল পজিশনে ল্যান্ড করেনি। এমনভাবে ল্যান্ড করলে বরাবরই দূর্ঘটনা ঘটে। এটা কেন হয়েছে সেটাই হচ্ছে দূর্ঘটনার প্রধান কারন। এটা বের করতে পারলে দূর্ঘটনার কারন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে। তবে ইউএস-বাংলার বিমানটির বিধস্ত হওয়ার জন্য কন্ট্রোল রুম দায়ী নয়। কারন কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে ককপিটের যে কথা হয়েছে তার মধ্যে কোন ধরনের ভুল বোঝাবুঝি নেই। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, নেপাল সরকার এ দূর্ঘটনা তদন্তে অনেক গুরুত্ব দিয়েছে। তাই আশা করা যায় আগামী এক মাসের মধ্যে দূর্ঘটনার মুল কারন জানতে পারা যাবে।
গতকাল নেপালের ত্রিভুবন ইউনিভার্সিটি (টিইউ) টিচিং হাসপাতালে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে নেপালে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদুত মাশফি বিনতে শামস বলেন, শনিবার থেকে শনাক্তকরণের কাজ শুরু হবে। শনিবার সরকারি ছুটি রয়েছে। ফলে এদিন তেমন কোনও কাজ হবে না। তবে আমরা আশাবাদী, রবিবার বা সোমবার নাগাদ মরদেহগুলো শনাক্ত হবে। তিনি বলেন, যেসব মৃতদেহ খালি চোখে দেখে শনাক্ত করা সম্ভব হবে সেগুলো আগামী মঙ্গলবারের মধ্যে একযোগে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় দেশে পাঠানো হবে। নিহতদের আত্মীয়-স্বজনেরাও লাশের সাথে দেশে ফিরবেন।
এসময় সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে আসা তদন্ত দলের সদস্য ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ এর ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেল আহমেদ বলেন, যেসব মৃতদেহ দেখে শনাক্ত করা সম্ভব হবে না সেগুলোর ডিএনএ প্রোফাইলিং করা হবে। এজন্য এসব মৃতদেহের দাঁত, চুল, নখ বা পোশাকের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। আগামীকাল রোববার ঢাকার সিআইডির ডিএনএ ল্যাবে গিয়ে নিহতদের আত্মীয়-স্বজনদের যোগাযোগের জন্য অনুরোধ করা হয়।
তবে দেশে পাঠাতে আরও দেরি হতে পারে পাইলটসহ ক্রুদের মরদেহ। কারণ পরিচয় জানার পর তাদের জন্য অন্তত ১২ ধরনের বিশেষ পরীক্ষার কথা শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে অ্যালকোহল পান, হৃদরোগ, উত্তেজিত থাকা, শারীরিক ফিটনেস, স্বভাবিক ওজন উল্লেখযোগ্য। এসব রিপোর্ট তদন্ত কমিটির কাছে সরবরাহ করার কথা রয়েছে।
নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের মহাব্যবস্থাপক রাজ কুমার ছত্রীর সাথে কথা হলে তিনি জানান, আমি সিসি টিভির ফুটেজ দেখেছি। ল্যান্ড করার সময় উড়োজাহাজটির অ্যালাইনমেন্ট ঠিক ছিল না। এটা স্বাভাবিক ল্যান্ডিং ছিল না। উড়োজাহাজটি রানওয়েতে সোজা না নেমে এক পাশ থেকে ল্যান্ডিং করেছিল। এরপর সেটি স্কিড করে রানওয়ের পাশের ড্রেন পার যায়। এরপর উড়োজাহাজটিতে আগুন জ্বলে ওঠে।
তিনি বলেন, পাইলট ল্যান্ডিংয়ের গাইডলাইন যথাযথভাবে অনুসরণ করেননি। ল্যান্ড করতে সমস্যা মনে হলে তিনি চাইলেই ল্যান্ড না করে উড়ে যেতে পারতেন। তিনি আরো বলেন, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে আমি সেখানে দ্রুত গিয়েছি। আমাদের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আমি পৌছানের আগেই দ্রুত আগুন নেভাতে শুরু করে এবং যাত্রীদের উদ্ধার করতে থাকে।

নেপাল ত্রিভূবণ এয়ারপোর্ট জিএম
নেপাল ত্রিভূবণ এয়ারপোর্ট জিএম

বিমানটির ল্যান্ডিংয়ের ব্যাপারে তিনি আরও বলেন, ত্রিভুবন বিমানবন্দরে নব্বই শতাংশ ফ্লাইট দক্ষিণ দিক থেকে ল্যান্ড করে। সেকারনে কন্ট্রোল রুম থেকে ইউএস-বাংলার ফ্লাইটকেও দক্ষিণ দিক থেকে ল্যান্ড করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু পাইলট সাউথ রানওয়ে ক্রস করে নর্থ রানওয়ের দিকে চলে যায়। তখন সঙ্গে সঙ্গে কন্ট্রোল রুম থেকে পাইলটকে জিজ্ঞেস করা হয়। আপনাকে দক্ষিণ দিকে (টু-জিরো) নামতে বলা হয়েছে কিন্তু আপনি উত্তর দিকে চলে গেলেন কেন? উত্তরে পাইলট বলেছেন, আমি শুনেছি জিরো-টু (মানে, উত্তর দিক)। পরে তাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলা হয়। এরপর কন্ট্রোল রুম থেকে জানতে চাওয়া হয়, আপনি কি রানওয়ে দেখতে পাচ্ছেন। পাইলট জানান, না দেখা যাচ্ছে না। তারপরে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল থেকে জিরো-টু ও টু-জিরো দুই রানওয়েই উম্মুক্ত করে দেয়। একই সাথে আকাশে উড়তে থাকা সকল উড়োজাহাজকে বিমানবন্দর এলাকা থেকে দুরে অবস্থান করতে বলা হয়। এরপর কন্ট্রো থেকে পাইলটকে আবার জানতে চাওয়া হয়, তখন পাইলট জানান, রানওয়ে দেখা যাচ্ছে।
ছত্রী আরো বলেন, ল্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে পাইলটের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল শুধু গাইড দেয়। কিন্তু চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত থাকে পাইলটের হাতে। পাইলট যদি বলেন ল্যান্ড করবো না, তাহলে সেটাই ফাইনাল। পাইলেটরে শেষ কথায় হচ্ছে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।
তিনি বলেন, ওই উড়োজাহাজ থেকে জীবিত উদ্ধার হওয়া এক নেপালি যাত্রীর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন। ওই যাত্রী তাকে জানিয়েছেন, উড়োজাহাজটি ল্যান্ড করা আগেই অস্বাভাবিক ভাবে জাম্প করছিল। ঝাঁকুনি দিচ্ছিল, তখন সবাই চিৎকার ও কান্না শুরু করেন। বিমানটি ল্যান্ড করার আগেই বাঁচাও বাঁচাও বলে যাত্রীদের কান্নার রোল উঠেছিল বলে জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ইউএস-বাংলার বিমানটির কন্ডিশন খারাপ ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা তেমন কোনও রিপোর্ট কখনও পাইনি। আর এটা বাংলাদেশের দায়িত্ব। বিমানের কোনও ক্রুটি আছে কিনা, আকাশে ওড়ার আগে পাইলট স্বাভাবিক আছেন কিনা, এসব চেক করার দায়িত্ব বাংলাদেশের। তবে যতটুকু জেনেছি সব ঠিক ছিল।
এদিকে গতকাল বিকালে দেশে ফিরেছেন সৈয়দা কামরুন্নাহার স্বর্ণা, আলমুন নাহার অ্যানি ও মেহেদি হাসান। তারা কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (কেএমসি) চিকিৎসাধীন ছিলেন। সরকারি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ বিমানের উড়োজাহাজ বিজি-০৭২ ফ্লাইটে তারা ঢাকায় ফেরেন। এখন ভর্তি আছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এর আগে আহত যাত্রী রিজওয়ানুল হককে সিঙ্গাপুরে ও শাহরিন আহমেদকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। শাহরিন এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ণ ইউনিটে চিকিৎসাধীন।
বর্তমানে নেপালে আহত পাঁচজন বাংলাদেশির মধ্যে চারজন কেএমসিতে ও আরেকজন নরডিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এরমধ্যে এমরানা কবির হাসি, কবির হোসেন, শেখ রশিদ রোবায়েত ও শাহীন বেপারি আছেন কেএমসিতে। আর নরডিক হাসপাতালে আছেন ইয়াকুব আলী। এদের মধ্যে আহত যাত্রী হাসির অবস্থা আশঙ্কাজনক। ইয়াকুব আলীকে ভারতের দিল্লিতে নেওয়ার কথা ছিল।

মইন উদ্দীন, কাঠমান্ডু, নেপাল।
মোবাইল নং:- +৯৭৭৯৮২৩২৪৮৭৮৯