– পীর হাবিবুর রহমান

রাজনীতি নিয়ে এ সপ্তাহের কলাম যখন লিখতে যাব ঠিক তখন ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি বিমান যাত্রীসহ নেপালের ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে দুর্ঘটনাকবলিতই হয়নি, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। নেপালের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেখানে ছুটে গেছেন। সেনাবাহিনী উদ্ধার অভিযান চালিয়েছে। বিশ্ব গণমাধ্যমে খবরটি প্রচার হচ্ছে। সারি সারি লাশের ছবি দেখে আমাদের বুক ভেঙে যাচ্ছে। অধিকাংশ যাত্রী ছিলেন বাংলাদেশের। উল্লেখযোগ্য যাত্রী ছিলেন নেপালের। হতাহতের সংখ্যা এতটাই বাড়ছে যে, সবার হূদয় ব্যথিতই হয়নি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা গ্রাস করেছে আমাদের। একটি ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায় যাদের জীবন নিভে গেছে তাদের আত্মার শান্তি কামনা করলেও শোকার্ত পরিবার ও স্বজনদের সমবেদনা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। রহস্যময় মানব জীবনে মৃত্যুই একমাত্র নির্মম সত্য। কিন্তু অকাল বা আচমকা দুর্ঘটনাকবলিত মৃত্যুর ঝাঁকুনি বড় বেশি প্রবল হয়। এই দুর্ঘটনা তা-ই ঘটিয়েছে। এসব ঘটনা থেকেও আমরা উপলব্ধি করি না, জীবন কতটা অনিশ্চিত আর মৃত্যু কতটা নিশ্চিত। ক্ষমতা, অর্থবিত্তসহ নানামুখী লোভের লড়াইয়ে আমরা নিয়ত যুদ্ধ করি। কিন্তু একবারও ভাবি না, আর একমুহূর্ত পর বেঁচে আছি কিনা!

এদিকে নানা জল্পনা-কল্পনার পর অবশেষে বিলম্বে নথি আসার কারণে উচ্চ আদালতে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জামিন চাওয়ার পর মহামান্য আদালত চার মাসের জামিন দিয়েছেন। কিন্তু আরেকটি মামলায় কুমিল্লায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, জামিনের বিরুদ্ধে আপিল করবেন। যদ্দুর বোঝা যাচ্ছে, উচ্চ আদালত জামিন দিলেও অন্য মামলায় গ্রেফতারের নির্দেশের কারণে বেগম খালেদা জিয়া এখনই মুক্তি পাচ্ছেন না।

আদালতের বিচারাধীন বিষয়টি নিয়ে কথা না থাকলেও সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও চলমান ঘটনা নিয়ে কিছু বলতে হয়। সম্প্রতি এককালের গণতন্ত্রের দ্বীপখ্যাত জাতীয় প্রেস ক্লাবের অভ্যন্তরে সাদা পোশাকের গোয়েন্দা পুলিশ যেভাবে প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন করে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা শফিউল বারী বাবুকে আটক করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ফিল্মি স্টাইলের এই পাকড়াও অভিযান জাতীয় প্রেস ক্লাবের অভ্যন্তরে আতঙ্কের সৃষ্টিই করেনি, মর্যাদার বুকে আঁচড়ই বসায়নি, উচ্চ আদালতের নির্দেশনাকেও লঙ্ঘন করেছে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সাংবিধানিক সরকার যখন ক্ষমতায় এবং উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন এবং জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা সেই দলের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রধান, সেখানে এ ধরনের ঘটনা গণতন্ত্রকামী শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের হূদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। নিজের অজান্তেই প্রশ্ন আসে, সরকার কি অগণতান্ত্রিক? আর বিএনপি কি একটি নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল যে, তাদের নেতা-কর্মীকে এভাবে আটক করতে হবে? শান্তিপূর্ণ কালো পতাকা কর্মসূচিতে জলকামান দিয়ে গরম পানি ছিটিয়ে এবং লাঠিপেটা করে পণ্ড করে দিতে হবে? লিফলেট বিতরণ ও পোস্টার লাগানোয় বাধা দিতে হবে?

সরকারি দল আওয়ামী লীগ ঢাকঢোল পিটিয়ে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের শুভদিনে ইতিহাসের আলোকিত ময়দান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা ডেকে জনজোয়ার সৃষ্টি করতে পারলে, উৎসবমুখর পরিবেশে জনসমুদ্রতুল্য মহাসমাবেশ করতে পারলে বিএনপি নামক দলটি কেন সেখানে সমাবেশের অনুমতি পাচ্ছে না? একসময় আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলের মিছিল থেকে পুলিশ কোনো কর্মীকে আটক করতে গেলে নেতারা জাপটে ধরে আগলে রাখতেন। সেসব নেতার মুখ এখন ক্ষমতাসীন দলের মসনদে শোভা পাচ্ছে। কিন্তু সেদিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের বুক থেকে ছাত্রদলের এক কর্মীকে পুলিশ যেভাবে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে নিয়েছে তাতে মনে হয়েছে, আমাদের রাজনীতির অতীত গৌরবের, বর্তমান বেদনার, ভবিষ্যৎ উদ্বেগের। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই সমাবেশ করে না; সরকারের শরিক ছোট ছোট দলগুলোও করে। এদের সাংগঠনিক শক্তি কতটা শক্ত গোটা দেশের মানুষ জানে। এরশাদের জাতীয় পার্টিও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি পেয়েছে। শুধু পায়নি বিএনপি।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দীই নন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার পথে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে নির্বাসিতই নন, আদালত দ্বারা দণ্ডিতই নন, নির্বাচনের জন্যও অযোগ্য ঘোষিত। তিনি দেশে ফিরে আন্দোলন-সংগ্রাম করবেন, নেতৃত্ব দেবেন এমন সম্ভাবনাও নেই। বিএনপি নেতা-কর্মীর নামে হাজার হাজার মামলা রয়েছে। আইনের পথে আদালতমুখী বিএনপি নেতা-কর্মীদের চাইলে সরকার পুলিশের হয়রানির মধ্যে দৌড়ের ওপর রাখতে পারে। কিন্তু নেতৃত্বহীন বিপদগ্রস্ত অসহায় পরিস্থিতির মুখে পতিত রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রতি এত ভয় কেন যে, তাদের কোথাও সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া হবে না, দাঁড়াতেও দেওয়া হবে না? বিভাগীয় শহরগুলোতেও বিএনপি সমাবেশ করতে চাইছে। খুলনার হাদিস পার্ক তাদের কপালে জোটেনি। আওয়ামী লীগের খেয়ে-পরে নাদুসনুদুস হয়ে চলাফেরা করা একদল বুদ্ধিজীবী দেখা যায়। একদল গণমাধ্যমের লোকজন ঘুরেফিরে পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন থেকে শুরু করে টেলিভিশন টকশো হয়ে নানান রাউন্ড টেবিলে তারা তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন এই বলে যে, বঙ্গবন্ধুর খুনি ও একাত্তরের ঘাতকদের ফাঁসির সময় বিশ্ব মোড়লরা টেলিফোন করলেও বেগম খালেদা জিয়ার দুর্নীতির মামলায় কারাদণ্ডের পর পৃথিবীর কোথাও থেকে কোনো টেলিফোন বা চাপ আসেনি। একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে সংবিধান, আইন ও বিধিবিধানবলে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। সংবিধান যেখানে সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের অধিকার নিশ্চিত করেছে, সেখানে পুলিশের দোহাই দিয়ে একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে না দেওয়া নিয়ে তারা কোনো কথা বলেন না। বিএনপি যদি নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল হতো, তাহলে তার সভা-সমাবেশের ওপর বাধা বা পুলিশ দ্বারা পণ্ড করা নিয়ে কোনো কথা উঠত না। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কথা বলবেন, সাংবিধানিক উত্তরাধিকার বহনের কথা বলবেন এবং জাতীয় নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ আশা করবেন, অথচ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি রাজনৈতিক দলকে রাজনীতির ময়দানে নির্বিঘ্নে সভা-সমাবেশসহ তাদের সাংবিধানিক অধিকার দেবেন না— তা হতে পারে না।

ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গেও পর্দার অন্তরালে আপস-সমঝোতা হচ্ছে। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে দমননীতির পথে প্রতিরোধ বা নিশ্চিহ্ন করার যে চেষ্টা চলছে তা কতটা যৌক্তিক এবং সাফল্য অর্জনে সহায়ক সেই বিবেচনাবোধ শাসকগোষ্ঠী কীভাবে করছে বুঝতে পারছি না। দৃশ্যমান রাজনীতিতে শক্তি দুটি। একটি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ। আরেকটি আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতির মঞ্চ হিসেবে পরিচিত বিএনপি। জামায়াতকে নিয়ে ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি সরকার আওয়ামী লীগকে কঠোরভাবে দমনই করেনি, গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনাসহ দলের শীর্ষ নেতাদের উড়িয়ে দেওয়ার পৃষ্ঠপোষকতাই দেয়নি, বোমা ও সন্ত্রাসকবলিত দেশে সেদিন আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতাদের হত্যা করে খুনিরা পার পেয়েছে। দুঃশাসনের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল তারা। তবে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা যায়নি।

বিএনপিকে ১১ বছর ধরে করুণ পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ মানবসভ্যতার ইতিহাসে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে রচিত নীলনকশায় বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে নৃশংসভাবে খুনই করা হয়নি। তাঁর নামটি রীতিমতো নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের জেলের অন্ধকারে হত্যা করা হয়েছিল। দলের হাজারো নেতা-কর্মীকে অত্যাচার-নির্যাতনই করা হয়নি, বছরের পর বছর কারাবন্দী রাখা হয়েছিল।

সামরিক শাসনের গর্ভ থেকে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপিকে নিজেদের অবস্থা শক্তিশালীকরণে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের জন্য নেমে এসেছিল বিষাক্ত খড়্গ। বঙ্গবন্ধুর নাম নিষিদ্ধ করে তাঁর খুনিদের কখনো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কূটনীতির চাকরি, কখনো বা রাজনীতিতে পুনর্বাসন করা হয়েছে। সেই দুঃসময়েও খুনির মঞ্চে সাপ ফণা তুলেছে, গণতন্ত্রের রাজনীতিতে তাদের ঠাঁই হয়নি।

অনেকে বলেন, বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসা মানে একুশের গ্রেনেড হামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র, প্রতিহিংসার খুনের রাজনীতির প্রত্যাবর্তন। বিএনপি ক্ষমতায় আসা মানেই একাত্তরের পরাজিত শক্তির উগ্রমূর্তি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ওপর বর্বর আক্রমণ। এই অভিযোগ সত্য হলেও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সংবিধান ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হলে জনগণকে সঙ্গে নিয়েই রাজনৈতিকভাবে ব্যালটের লড়াইয়ে পরাস্ত করার অগ্নিপরীক্ষায় জয়ী হওয়ার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। যুগে যুগে পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে দমননীতি কোনো শাসকের জন্য সুফল বয়ে আনেনি। দমননীতি একটি জনপ্রিয় সরকারকেও জনবিচ্ছিন্ন করে দেয়।

শেখ হাসিনার সরকার ইতিহাসের অনেক অমীমাংসিত ঘটনার মীমাংসাই করেনি, দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়েছে এটি সত্য। কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের হূদয় জয় করার পথ পরিহার করে দমন-পীড়নের পথ আওয়ামী লীগ কেন নেবে? আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাসের গৌরব এই উপমহাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল কংগ্রেসেরও নেই।

মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ও গণতন্ত্রের মহান নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এই দলের জন্মের সময় জড়িত থাকলেও কার্যত বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে এই দলটির চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই দলের নেতা-কর্মীরা গোটা জাতিকে স্বাধিকার-স্বাধীনতার মোহনায় মিলিত করেছেন। শুধু গণতান্ত্রিক সংগ্রামই নয়, বঙ্গবন্ধুর ডাকে মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে। একালের হাইব্রিড ছাড়া এই দলে এমন কোনো আদর্শিক নেতা-কর্মী নেই, যিনি কোনো স্বৈরশাসকের আমলে জেল খাটেননি, পুলিশের লাঠিপেটা খাননি কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হননি।

সামরিক শাসকরা যেমন ক্ষমতায় এসে অনেক মন্ত্রী-নেতা জন্ম দিতেন ওপর থেকে, তেমনি আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী দল আর শেখ হাসিনার মতো ৩৭ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রামের পোড় খাওয়া নেত্রীর শাসনামলে দেখতে হয়, ওপর থেকে একদল নেতাই নয়, বুদ্ধিজীবীও তৈরি হয়। একদল দলদাস এখন সরকারের চাটুকারিতায় নাকে খত দিয়ে এতটাই হামাগুড়ি খায় দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীরাও দূর থেকে দেখে বিদ্রূপের হাসি হাসেন। তথাকথিত মুখচেনা এসব বুদ্ধিজীবী বিএনপি জমানায়ও মান্নান ভূঁইয়াদের বাড়িতে রাত নামলে প্রবেশ করেছে। ওয়ান-ইলেভেনেও অনেক কুশীলবের সঙ্গে দূরে থাক, তাদের আদিষ্ট লোকজনের সঙ্গে নৈশভোজে গদগদ হয়ে টকশোয় তাদের গান গেয়েছে। আওয়ামী লীগের নয় বছর খেতে খেতে এরা ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। কেউ কেউ প্লট নিয়েছে, টিভি নিয়েছে এমনকি শ্যালিকার জন্য মাথা গোঁজার ঠাঁই করেছে। যদ্দিন আওয়ামী লীগ তদ্দিন একটি প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালকসহ নানা সরকারি পদে থেকে আয়েশের জীবন কাটাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাগজের চেয়ে এডিটরের সার্কুলেশন বেশি এমন কোনো কোনো মতলববাজ গাজীপুরেই বিশাল সাম্রাজ্য গড়েছে। একদল হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। আরেক দল লুটে নিয়েছে ব্যাংকিং খাত। কেউ লুটেছে শেয়ারবাজার। ব্যাংকিং খাতে চরম রুগ্নদশা। শেয়ারবাজার মুখ থুবড়ে পড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান দেখভাল করতে সরকার যাদের দায়িত্ব দিয়েছে, তারা খেয়ে-দেয়ে এখন মোটাতাজা হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে সরলে এসব নিম্নশ্রেণির সুবিধাভোগীর অতীতে যেমন পাওয়া যায়নি, ভবিষ্যতেও পাওয়া যাবে না।

আওয়ামী লীগের মতো দল যখন ক্ষমতায়, বঙ্গবন্ধুর মতো ভুবনজয়ী বিশ্বনন্দিত উদার গণতন্ত্রী নেতার কন্যা শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতায়, তখন সব দলের সভা-সমাবেশের অধিকার আমরা চাইতেই পারি। অনেকে বলেন বিএনপির অপশাসনের কথা। তাদের দুর্নীতি, বোমাসন্ত্রাস, গ্রেনেড হামলা, ক্ষমতার অপব্যবহার সবকিছুর বিচার করুন। মানুষের সমর্থন রয়েছে। জনগণ কখনো অন্যায়-অপরাধ সমর্থন করেনি। সাময়িকভাবে জনগণকে দাবিয়ে রাখা যায়। পঁচাত্তরের পর দাবিয়ে রাখা গিয়েছিল। কিন্তু ২১ বছর পর জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা খুনিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। জনসমর্থনের কারণে ওয়ান-ইলেভেনে কারাদহন থেকে বেরিয়ে ব্যালট বিপ্লবে ক্ষমতায় অভিষিক্ত হয়ে একাত্তরের পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসর, যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল, তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা অর্থনৈতিক মুক্তি দিচ্ছেন। আমরা খুশি। কিন্তু এ দেশের মানুষের পরনে যখন কাপড় ছিল না, পেটে ভাত ছিল না, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, অর্থনীতিতে, যোগাযোগে এতটা অগ্রসর ছিল না, তখনো বঙ্গবন্ধুর ডাকে মানুষ তার অধিকারের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য জীবন দিতে কার্পণ্য করেনি। গণতন্ত্রের বসন্ত উৎসবের মধ্য দিয়েই এ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তি চায়। মানুষ চায় যাকে খুশি তাকে ভোট দিতে। মানুষ চায় বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করতে, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে। তার বিবেক ও চিন্তার স্বাধীনতা থেকে কথা বলতে।

আমাদের দেশের স্বাধীনতায় লাখো মানুষ রক্ত দিয়েছে। লাখো মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছে। আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস রক্তে ভেজা গৌরবেরই নয়, গভীর বেদনারও। এই স্বাধীন দেশে ন্যায়বিচার মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। কত মানুষ বিনা বিচারে নিহত হয়েছে। কত মানুষ নিখোঁজ হয়েছে। যারা ফিরেছে তারাও বলতে পারেনি কোথায় ছিল! আওয়ামী লীগের শাসনামল দমবন্ধ পরিস্থিতির হতে পারে না। বঙ্গবন্ধুকন্যার শাসনামল হবে বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার। ৭ মার্চের মিছিলে আসা একদল ভাড়াটে বিকৃত পুরুষের হাতে লাঞ্ছিত ভিকারুননিসা নূন কলেজের তার্কিক তরুণী অদিতি বৈরাগীর মতো চিৎকার করে প্রতিবাদ করার। অদিতির প্রতিবাদকে গোটা দেশ সমর্থন দিয়েছে। গোটা দেশ তার পাশে দাঁড়িয়ে বলেছে, স্বাধীন দেশে সাহসী মেয়ে এমনই হবে। সে বেদনার সঙ্গে বলেছিল, শুয়োরদের এই দেশে সে থাকবে না। মানুষ বলেছে, অদিতিই থাকবে। শুয়োরদের জায়গা এখানে হবে না। জঙ্গি-লুটেরা, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, ডাকাতের জন্য বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ অভয়ারণ্য হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের উত্তরাধিকারিত্ব বহন করা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিকশিত অসাম্প্রদায়িক আদর্শিক রাজনৈতিক শক্তি, আদর্শিক মানুষ ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারী-পুরুষের জন্য সমঅধিকার ভোগ করা মানুষের জন্য অভয়ারণ্য হবে এই দেশ। নির্বাচন হবে কালো টাকা ও পেশিশক্তিমুক্ত অবাধ-নিরপেক্ষ। প্রশাসন হবে দলীয়করণমুক্ত। বিচার বিভাগ হবে স্বাধীন। জনগণই হবে ক্ষমতার মালিক। সংসদ হবে জবাবদিহিমূলক সব আলোচনা বিতর্কের তীর্থস্থান।

সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন