আহমদ গিয়াস:
কক্সবাজার বঙ্গোপসাগরে গত মাসাধিককাল ধরে অভাবনীয়ভাবে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে ইলিশ। বর্তমানে ইলিশ ধরতে কক্সবাজারের ৫ সহস্রাধিক যান্ত্রিক নৌকা নিয়ে প্রায় এক লাখ জেলে সাগরে আসা যাওয়া করছে। ইলিশের আনাগোনায় শহরের প্রধান মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ফিশারীঘাট সরগরম রয়েছে। এখান থেকে দৈনিক গড়ে ৫০ টন ইলিশ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে যাচ্ছে। শীতের শেষে এসে এই ধরনের ইলিশ ধরা পড়ার ঘটনা গত এক যুগে এই প্রথম বলে জানান মৎস্য ব্যবসায়ীরা। তবে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আহরিত ইলিশ দেশের বিভিন্নস্থানে পৌঁছে দিতে গিয়ে চরমভাবে পুলিশী হয়রানির শিকার হচ্ছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে শহরের প্রধান মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ফিশারীঘাটে গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি ট্রলার সাগর থেকে ইলিশের ঝাঁপি নিয়ে ঘাটে ফিরছে। আর আগে ফেরা কিছু ট্রলার নতুন করে রসদ নিয়ে পূনরায় বঙ্গোপসাগরে রওয়ানা দিচ্ছে। ফিশারীঘাট মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে জেলে-শ্রমিক ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের আনাগোনায় দারুণ প্রাণচঞ্চল রয়েছে। এখানে ঘাটের শ্রমিকরা নৌকা থেকে ইলিশ তুলে ডাঙ্গায় নিচ্ছে আর মৎস্য ব্যবসায়ীরা তা পাইকারী দরে বড় ব্যবসায়ীদের বিক্রি করছে। কিছু ব্যবসায়ী পাইকারী বাজার থেকে ইলিশ কিনে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে সরবরাহ করছে। এখান থেকে দৈনিক গড়ে ৫০ মেট্রিক টন ইলিশ রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে যাচ্ছে বলে জানান মৎস্য ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় বাজারেও সাগরের তাজা ইলিশের সহজ প্রাপ্যতা রয়েছে।

কক্সবাজার শহরের বাসিন্দা কামরুন নেছা বলেন, গত বছর থেকে মনভরে ইলিশের স্বাদ নিতে পারছি। তবে আগের বছরের তুলনায় এবছর ইলিশের স্বাদ বেশি।

কক্সবাজার বঙ্গোপসাগরে গত মাসাধিককাল ইলিশের সহজপ্রাপ্যতা সৃষ্টি হওয়ায় বাজারে দামও সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রয়েছে।

শহরের প্রধান বাজারগুলো ঘুরে জানা গেছে, কেজিতে তিনটি বা ৩শ থেকে সাড়ে তিন শ গ্রাম ওজনের ইলিশের দাম প্রতি কেজি সর্বেচ্চ ৩শ টাকা। চারশ গ্রামের চেয়ে বড় ইলিশের দাম চারশ থেকে পাঁচশ টাকা। আকার ভেদে ইলিশের দাম আরো বেশি।

তবে বঙ্গোপসাগরে ইলিশ পড়ার ঘটনায় জেলে বহদ্দাররা এবার লাভের আশায় বুক বাঁধলেও পুলিশী হয়রানির কারণে মৎস্য ব্যবসায়ীরা শান্তিতে ব্যবসা করতে পারছেন না বলে জানান কক্সবাজার ফিশারীঘাটস্থ মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির পরিচালক জুলফিকার আলী।

কক্সবাজার ফিশারীঘাটস্থ মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আলহাজ্ব নুরুল ইসলাম চিশতি বলেন, কক্সবাজার থেকে দেড়-দুই টনের ইলিশ বোঝাই একটি পিকআপকে ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে পুলিশকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিলে গাড়িতে ইয়াবা ঢুকিয়ে দিয়ে চালান দেওয়ার হুমকী দেওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন চেকপোস্টে অহেতুক ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। যে কারণে বাজারে যথাসময়ে পৌঁছাতে না পেরে ব্যবসায়ীরা লোকসানের শিকার হন।

গাড়ি চালক সোনা মিয়া বলেন, হাইওয়ে পুলিশই সবচেয়ে বেশি হয়রানি করে মাছের গাড়িকে। এরমধ্যে লোহাগাড়া, পটিয়া মইজ্জারটেক, শাহ আমানত সেতুর দুই প্রান্তে, মিরসরাই থানার সামনে ও দাউদকান্দি ব্রিজের আগে চেকপোস্ট বসিয়ে পুলিশ চাঁদাবাজি করে বলে তিনি জানান।

তিনি আক্ষেপ করে দৈনিক আজাদীকে বলেন, শীতের শেষে এসে এই ধরনের ইলিশ ধরা পড়ার ঘটনা গত এক যুগে এই প্রথম হলেও ব্যবসায়ীরা পুলিশী হয়রানির সরকারের উপর ক্ষুব্দ হয়ে ওঠছেন। তবে এই সুযোগে কক্সবাজারের কিছু বড় ব্যবসায়ী আগামী পহেলা বৈশাখকে টার্গেট করে এখন থেকেই কম দামে ইলিশ কিনে জমাতে শুরু করেছে বলে জানান।

সরকারের মৎস্য বিভাগের মতে, দেশের মুক্ত জলাশয় বা বঙ্গোপসাগরে ইলিশ উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। গত বছর ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা শুধু ছাড়িয়েই যায়নি, ১৮ বছরের রেকর্ডও ভঙ্গ করে। গত বছরের তুলনায় এ খাতে প্রায় ১৫ ভাগ প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। সমুদ্রসীমা বিজয়ের পর সমুদ্র সম্পর্কিত অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমি জোরদারের লক্ষ্যে সরকারের গৃহীত নানামুখী পদক্ষেপের কারণে বঙ্গোপসাগরে ইলিশ উৎপাদন বাড়ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত কয়েক বছর ধরেই দেশে ইলিশের উৎপাদন ৩ থেকে ৪ লাখ মেট্রিক টনের মধ্যে উঠানামা করছে। এর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন। তবে ইলিশের গড় উৎপাদন ধরা হয় সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু চলতি বছর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল সাড়ে ৪ লাখ মেট্রিক টন। এই লক্ষ্যমাত্রা ইতোমধ্যে অর্জিত হয়েছে বলে জানান মৎস্য আহরণকারী-বিপননকারীসহ সংশ্লিষ্ট সরকারী দপ্তরের কর্তারা। তাদের ধারণা, এ বছর দেশে ইলিশের উৎপাদন ৫ লাখ মেট্রিক টনের কাছাকাছি ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। চলতি মৌসুমের আগে গত বছরও দেশে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়েছিল বলে জানায় মৎস্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞানীরা। এরআগে এই ধরনের ইলিশ ধরা পড়ে ১৯৯৮ সালে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, বিশ্বে প্রতিবছর ৬ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ আহরিত হয়। এর ৭০ শতাংশই বাংলাদেশে। বিশ্লেষকদের ধারণা, চলতি বছরে ইলিশের বাণিজ্য ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বিজ্ঞানীদের মতে, ইলিশের বিচরণক্ষেত্র ব্যাপক এবং এদের সাধারণত সমুদ্র, মোহনা ও নদীতে দেখা যায়। ইলিশের বিচরণক্ষেত্র বঙ্গোপসাগর থেকে পারস্য উপসাগর, লোহিত সাগর, আরব সাগর, ভিয়েতনাম ও চীন সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। শাতিল আরব, ইরান ও ইরাকের ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস, পাকিস্তানের সিন্ধু, ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলীয় নদীসমূহ, মিয়ানমারের ইরাবতী এবং বাংলাদেশের উপকূলীয় বিভিন্ন নদীসহ পদ্মা, যমুনা, মেঘনা ও কর্ণফুলি নদী ইলিশের আবাসস্থল। বাংলাদেশে মোট মৎস্য উৎপাদনে এককভাবে ইলিশের অবদানই প্রায় ১৩ শতাংশ। আর মোট দেশজ উৎপাদনেও (জিডিপি) এ খাতের অবদান ১ দশমিক ১৫ শতাংশ। এই খাতে আরো অনেক সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে বিশ্বে ইলিশের নতুন বাজার তৈরির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এমনকি প্রতিবেশী দেশের শহর কলকাতার বাজারেও বাংলাদেশী ইলিশের জনপ্রিয়তা এখন শীর্ষে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আমাদের সমুদ্র তটরেখা ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ। অর্থনৈতিক এলাকা ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। মোট সামুদ্রিক জলসম্পদের আয়তন ১৬৬ লাখ হেক্টর, যা দেশের মোট জলসম্পদের ৭৮.৩৯ শতাংশ। কিন্তু অতীতে আমাদের এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে কম। তবে ২০১১ সালে সমুদ্রসীমা বিজয়ের পর সমুদ্র সম্পর্কিত অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমি জোরদারের লক্ষ্যে সরকারের গৃহীত নানামুখী পদক্ষেপের কারণে বঙ্গোপসাগরে ইলিশ উৎপাদন বাড়ছে।

কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ও বিশিষ্ট মৎস্য বিজ্ঞানী ড. মঈনউদ্দিন আহমদ বলেন- সরকারের পরিকল্পিত কর্মসূচির কারণেই এ মৌসুমে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। ইলিশ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার গত কয়েক বছর ধরে প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি, জাটকা ধরার বিরুদ্ধে অভিযানসহ নানা কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। সরকারের এসব কর্মসূচী কক্সবাজারসহ অন্যান্য উপকূলীয় জেলাগুলোতে কঠোরভাবে পালিত হয়েছে। ফলে প্রধান প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সাগর ও নদী মোহনায় নির্বিঘ্নে ডিম ছাড়ার সুযোগ পেয়েছে। মূলত এ কারণে চলতি মৌসুমে ইলিশের উৎপাদন প্রায় ১৫ শতাংশ বেড়েছে।

বিজ্ঞানীদের মতে, ইলিশ একটি উচ্চ উৎপাদনশীল প্রজাতির মাছ। বড় আকারের একটি ইলিশ ২০ লক্ষ পর্যন্ত ডিম পাড়তে পারে। ইলিশ সারা বছর ডিম পাড়লেও সবচেয়ে কম পাড়ে ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসে এবং সবচেয়ে বেশি পাড়ে সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরে। ইলিশ প্রজননের উদ্দেশ্যে স্বাদু পানির ¯্রােতের উজানে অগভীর পানিতে উঠে আসে এবং ডিম ছাড়ে। মুক্ত ভাসমান ডিম থেকে পোনা বের হওয়ার পর ধীরে ধীরে অপ্রাপ্তবয়স্ক মাছে (জাটকা) পরিণত হয়। এরপর নদীর ভাটিতে নেমে সমুদ্রে পৌঁছে বড় হয়। প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রজননক্ষম হয়ে জীবনচক্র পূর্ণ করার জন্য আবার নদীতে বা সাগর মোহনায় ফিরে আসে। ইলিশ মূলত প্লাঙ্কটনভোজী। নীল-সবুজ শৈবাল, ডায়াটম, ডেসমিড, কোপিপোড, রটিফার ইত্যাদিও খেয়ে থাকে। তবে এদের খাদ্যাভ্যাস বয়স ও ঋতুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।

বিজ্ঞানীদের মতে, মূলত ইলিশের বংশবদ্ধি নির্বিঘ্ন করার চেষ্টা বা মাছের অভয়ারণ্য বাস্তবায়নের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে মা ইলিশ ও ডিম বাড়ছে এবং মাছও বাড়ছে।

মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০০৯ সালে সাগর-নদী উপকূলীয় এলাকা চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ভোলা ও পটুয়াখালীর ২১ উপজেলায় জাটকা নিধন বন্ধ, মা ইলিশ রক্ষা ও ইলিশের বংশবিস্তারের জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। পরবর্তী সময়ে এ কর্মসূচি ছড়িয়ে দেয়া হয় দেশের ২৫ জেলায়। এর সুফলই এখন পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমানে সারা দেশে ইলিশ মিলছে। আর দামও সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রয়েছে।

বিজ্ঞানীদের মতে, আমাদের সামুদ্রিক এলাকায় বা বঙ্গোপসাগরে রয়েছে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ। যার মধ্যে কেবল ৬৫ প্রজাতির মাছ আহরণযোগ্য। তাছাড়া আছে ৩৬ প্রজাতির সামুদ্রিক চিংড়ি, ৩ প্রজাতির লবস্টার, ২৫ প্রজাতির কাছিম ও ১১ প্রজাতির কাঁকড়া। এরমধ্যে ইলিশ বাংলাদেশের উন্মুক্ত জলাশয়ের অতি গুরুত্বপূর্ণ ও এককভাবে সর্বাধিক সংগৃহীত মাছ। মূলত বিশ শতকের চল্লিশের দশকের শেষে ইলিশের প্রধান জীবতাত্ত্বিক পরিমাত্রাগুলি নির্ধারণের প্রচেষ্টার ফলে এ মাছ সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক আগ্রহ ও আহরণ বৃদ্ধি পায়। ইলিশ মাছে মেধা বৃদ্ধিকারক ডিএইচ থ্রি নামের এক ধরনের ফ্যাটি এসিড রয়েছে।

বঙ্গোপসাগরে এতদিন ইলিশের উৎপাদন কমে যাওয়ার পেছনে মা ইলিশ ধরা ও জাটকা ধরাকে প্রধানত দায়ী করা হলেও আরো কিছু কারণে বঙ্গোপসাগরে ইলিশের প্রাচূর্য কমে গিয়েছিল বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। এরমধ্যে গঙ্গা নদীর পানির গতিপথ পরিবর্তনের জন্য ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণের পর থেকে ডিম ছাড়ার জন্য উজানে পরিযায়ী হওয়ার পূর্বেই উপকূলীয় অঞ্চল ও মোহনায় ইলিশ ধরা।