এম.আর, মাহমুদ, চকরিয়া:
কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সম্পদ ভান্ডার হিসেবে খ্যাত চকরিয়া উপকূলের চৌয়ারফাঁড়ির বাজারে গিয়েছিলাম মহিষের দই কিনতে। পথে দেখা হল চিরচেনা একজন লবণ চাষীর সাথে। কুশল বিনিময়ের পরে জানতে চাইলাম- লবণের মওসুম কেমন যাচ্ছে। ওই লবণ চাষি চেহারা মলিন করে জবাব দিলেন উৎপাদন ভাল হচ্ছে, তবে কাঙ্খিত মূল্য পাওয়া যাচ্ছেনা। একমন লবণ বিক্রি করে ছোট মানের ২৫০ গ্রাম চিংড়ীর ও ৩ কেজি চালও ক্রয় করা যাচ্ছেনা। পরিবার পরিজন নিয়ে শান্তিতে নেই। লবণ চাষি আবু বকর শত কষ্টের মাঝেও রসিকতা করে বলতে ভুলেনি- “জাল টানে যদু, মাছ খায় মধু”। এ ধরণের উক্তি শুনে জানতে চাইলাম সমস্যার কথা। তিনি বললেন মাঠ পর্যায়ে চাষিরা ৪৩/৪৫ কেজি লবণ বিক্রি করে মূল্য পাওয়া যাচ্ছে ২৫০ টাকা। প্রতি কেজির মূল্য দাড়ায় সাড়ে ৫ টাকা। অথচ কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় এলাকায় উৎপাদিত লবণ ক্রয় করে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানী গুলো প্রতি কেজি প্যাকেট জাত লবণ বিক্রি করছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। সেজন্যই লবণ চাষি দুঃখ করে বলেছেন “জাল টানে যদু, মাছ খায় মধু”। কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের ৮টি উপজেলার উৎপাদিত লবণ নিয়ে দেশের লবণের চাহিদা মিঠানো হচ্ছে। প্রাকৃতিক বৈরী আচরণের কারণে গত বছর লবণ উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় অজুহাত দেখিয়ে বিদেশ থেকে লবণ আমদানী করেছে বেশির ভাগ মিল মালিক। তাদের গুদামে এসব বিদেশী লবণ এখনো মওজুদ আছে। ফলে দেশে উৎপাদিত লবণ কিনতে তারা তেমন একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেনা। মাঠ পর্যায়ে কিছু ব্যবসায়ী লবণ ক্রয় করে নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন মোকামে নিয়ে গেলেও ১ লক্ষ টাকার লবণ বিক্রি করে পাচ্ছে মাত্র ১০ হাজার টাকা। বাকী টাকা পরে দেয়া হবে বলে আশ্বাসের বাণী শুনানো হচ্ছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে দরিদ্র চাষিরা উৎপাদিত লবণ বিক্রি করতে না পেরে লবণ উৎপাদন করতে রীতিমত হিমশিম খাচ্ছে। কে শুনে কার কথা। সমাজে কেউ কান্নাকাটি করে পায়ের জন্য, আবার কেউ কান্নাকাটি এক জোড়া সেন্ডেলের জন্য। মন্তব্য করার কিছুই নেই। প্রতিষ্ঠিত কোম্পানী গুলো আয়োডিন মিশ্রিত লবণের নাম দিয়ে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করলেও সরাসরি লবণ উৎপাদন কাজে জড়িত চাষিদের পেটে ঠিকমত মোটাচালের দু’ বেলা ভাতও জোটছেনা। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এসব প্রতিষ্ঠিত কোম্পানীগুলো শত শত কোটি টাকার ঋণ নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে গেলেও লবণ চাষিরা কোন ধরণের ব্যাংক ঋণ পায়না বললেই চলে। আগামী মাস পর্যন্ত লবণ উৎপাদন অব্যাহত থাকলে দেখা যাবে, ১৮ লাখ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করবে। কিন্তু প্রাকৃতিক দূর্যোগ হলেই ওইসব প্রতিষ্ঠিত কোম্পানী গুলো লবণ উৎপাদনের ঘাটতি দেখিয়ে বিদেশ থেকে লবণ আমদানির তোড় জোড় শুরু করবে। বিদেশ থেকে লবণ আমদানী করলেই মাঠ পর্যায়ে উৎপাদিত লবণ মাঠের গর্তেই পড়ে থাকে। গত বছর লবণের বাজার মূল্য ভাল ছিল বলে বেশিরভাগ চাষি লাভের আশায় ব্যাপক লবণ চাষ করেছে। কি জানি শেষ পর্যন্ত লবণ চাষিদের ভাগ্য কোন দিকে গড়ায়। প্রতিদিনের মত বাড়ী থেকে আসার পথে একজন কৃষকের সাথে দেখা হলে জানতে চাইলাম- সে কোথায় যাচ্ছে। জসিম নামের ওই কৃষক জবাব দিলেন বিলে যাচ্ছি টমেটো তুলতে। টমেটোর দাম জানতেই বলল- ৪০ কেজি টমেটো বিক্রি করে ১শ থেকে ১শ ২০ টাকা পাই। বর্তমানে প্রতিমন টমেটো বিক্রি করে যে টাকা পাই সে টাকা দিয়ে তিন কেজি চাউলও জুটেনা। ফলে চাষ করেও লাভবান হচ্ছেনা কৃষক সমাজ। অপরদিকে তামাকচাষী শাহ্ আলম জানালেন, তামাক চাষ করে দাদনের টাকা না নিলে চাষীরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়না। কারণ, আলোচিত কয়েকটি কোম্পানী তাদের নির্ধারিত চাষিদের উৎপাদিত তামাক গুলো ক্রয় করে। তবে তামাকের ফলন বেশী হলে ওইসব কোম্পানীও চাষিদের সাথে প্রতারনা যে করেনা তা নয়। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তারপরও তামাক চাষ বন্ধ করা যাচ্ছেনা। তামাক চাষের আগ্রাসনের কারণে গত তিন যুগে বেশিরভাগ বন এলাকার বনজ গাছপালা ও লোকালয়ের ফলজ, বনজ বৃক্ষরাজি শেষ হয়ে যাচ্ছে। তারপরও রাষ্ট্রীয় ভাবে তামাক চাষ বন্ধের কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেনা। ব্রিটিশ আমেরিকা ট্যোবাকো কোম্পানীসহ দেশীয় কোম্পানী গুলো তাদের চাষ অব্যাহত রাখার জন্য প্রশাসনের বড় কর্তাদের ম্যানেজ করতে ভুল করেনা।