– সিকদার গিয়াসউদ্দিন 

তথাকথিত পাকিস্তান জমানায় ‘মুসলিম বাঙ্গালা শিক্ষা’,’হিন্দু বাঙ্গালা শিক্ষা’ও সর্বোপরি ‘সবুজ সাথী’আমার মা ও গৃহশিক্ষকরা পরম যত্নে আমাকে ঘরে বসেই পড়ান।আমার মামা শাজাহান মনির তখন কক্সবাজার কলেজের অধ্যাপক।নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন।পার্শ্ববর্তি বিখ্যাত জমিদার ঈশান পাল আমার মা’কে অত্যধিক স্নেহ করতেন।উনার অনুরূধে পাশের স্কুল বাদ দিয়ে ঈশান পালের বাড়ীর পাশের রাজারকুল প্রাইমারী স্কুলে ৩য় শ্রেনীতে ভর্তি করিয়ে দিলেন।এদিকে মামা শাজাহান মনির বদলি হয়ে সিলেট এম সি কলেজে চলে যান।মামা ছিলেন নিভৃতচারীদের একজন।উনি সিলেট থেকে প্রতিমাসে চিঠি লিখতেন।আমিও জবাব দিতাম।উনি আমার চিঠির সকল ত্রুটিবিচ্যুতি ধরিয়ে দিতেন।মামার নানা উপদেশ আমাকে পরবর্তি জীবনে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে।একবার সিলেট থেকে ছুটিতে আসার পর আমার জন্য একটা ভারী প্যাকেট নিয়ে আসেন।আমিতো মহাখূশী।তখনো জানিনা প্যাকেটে কি আছে!ঘরের ভেতর আমার এদিক সেদিক ঘোরাফেরা ও পায়চারী দেখে মা ও মামার মুচকি হাঁসি আমার এখনো মনে পড়ে।পরে মামা সন্ধ্যার পর হারিকেনের আলোতে প্যাকেটটি খূলে একগাদা বই ধরিয়ে দিলেন।সবগুলো ছোটদের জন্য বড় বড় অক্ষরে লেখা মহামানব ও বিখ্যাত লোকদের জীবনী।প্রতিটি বই বিশ থেকে ত্রিশ পাতার।সংখ্যায় তিনশত।হযরত মোহাম্মদ (স:),গৌতম বুদ্ধ,ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,রাজা রামমোহন রায়,বঙ্কিমচন্দ্র,মহাত্মা গান্ধী,শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক,হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি,নেতাজী সূভাষ বোস,পন্ডিত নেহেরু,মওলানা আবুল কালাম আজাদ,মওলানা ভাসানী,মওলানা মোহাম্মদ আলী,মওলানা শওকত আলী,খান আবদুল গাফফার খান,মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ,লিয়াকত আলী,রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,কবি নজরুল ইসলাম,স্যার সৈয়দ আহমদ,বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন,সুলতানা রাজিয়া,রাবেয়া বসরী,কামাল পাশা,আব্রাহাম লিঙ্কন,সম্রাট অশোক,মাষ্টারদা সূর্যসেন,তিতুমীর,মোগল সম্রাট বাবর,আকবর,শাজাহান,সম্রাট বাহাদুর শাহ,খাজা নাজিমুদ্দিন,নওয়াব সলিমুল্লাহ,সরোজিনী নাইডু,সর্দার বল্লবভাই প্যাটেল,মাইকেল মধুসূদন দত্ত,আল্লামা ইকবাল,জামাল আবদুল নাসের,সক্রেটিস,প্লেটো,এরিস্টটল ইত্যাদি।সিলেট থেকে মামা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে যোগ দেন।বিভাগীয় প্রধান হয়েছিলেন।একজন বিশিষ্ট বাংলা ব্যাকরণবিদ হিসাবে সুনাম কুড়িয়েছিলেন।ছাত্রাবস্থায় কবিতা ও সাহিত্যের প্রতি একটা ঝোঁক ছিলো।হাইস্কুলে বন্ধু স্বপন চক্রবর্তী ও আমি মিলে দেয়াল পত্রিকাও সম্পাদনা করার কথা মনে পড়ে।ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়লে কবি সাহিত্যিক হওয়ার খায়েস আপনাআপনিই হাওয়াই মিলিয়ে যাই।তবে সময় পেলে এখনো বই পড়ি।বন্ধু স্বপন চক্রবর্তি ইতিমধ্যেই কবি ও কথাসাহিত্যিক হিসাবে বেশ সুনাম কুড়িয়েছে।তবে দীর্ঘ কয়েক যুগের ব্যবধানে আমার লেখায় নানা ধরণের বিচ্যুতি লক্ষনীয়।
ছোটবেলায় এসব বই পড়ে আমার বিশ্বাস-দেশের প্রতি,দেশের মানুষের প্রতি,মা ও মাটির প্রতি যে মমত্ববোধ তৈরী হয়ে গিয়েছিলো,দূর্ণীতিমুক্ত সমাজ ও দেশের প্রতি যে ভালোবাসা হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলো-তাতে আমার বিশ্বাস জন্মেছে ছোটবেলা থেকেই দেশপ্রেমের প্রশিক্ষনের বিষয়টি খূবই জরুরী।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘ কয়েক যুগের ব্যবধানে ১৯৭১’সাল পরবর্তি সময়ে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর বর্বরতম হত্যাকান্ডের পর থেকেই যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তারা তাদের মতো করেই স্বাধীনতার ইতিহাস তৈরী করার চেষ্টা করেছে।এখনো চলছে।স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে ১৯৭১’সাল পরবর্তি প্রজন্ম কনফিউজড।অর্ধসত্য,তথ্যসূত্রবিহীন ইতিহাস দেশপ্রেমহীন বৈষম্যমূলক সমাজ তৈরীর মধ্য দিয়ে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দূর্ণীতির যে বিষবাস্প ইতিমধ্যেই তৈরী হয়ে গেছে-তা থেকে মুক্তির একমাত্র পথ ছোটবেলা থেকেই বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ জনযুদ্ধের সকল নায়ক,সংগঠক,সেক্টর কমান্ডারসহ সকলের জীবনী ছোটদের উপযোগী করে লিখে তা স্কুল ও ঘরে পড়ানোর ব্যবস্থা ও আবহ তৈরী করা।এভাবে দেশ ও জাতির সত্যিকার ইতিহাস পঠনপাঠনের মধ্য দিয়ে যে প্রজন্ম গড়ে উঠবে-সেই দেশপ্রেমিক প্রজন্ম আগামীর বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে।আশাবাদের বিকল্প নেই।
আমাদের স্মরণ রাখা দরকার যে,এভারেষ্ট শৃঙ্গকে সমুন্নত রাখতে হলে হিমালয়ের চতুর্পার্শ্বের পর্বতগুলোকেও সূশোভিত করে তুলতে হবে।শহর বন্দরের রাস্তাগুলোকেও সাজিয়ে তুলতে হবে।গ্রাম গন্জের পাশের পাহাড়গুলোকেও সূসজ্জিত করে তুলতে হবে।স্বাধীনতা আন্দোলন ও জনযুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত সকলকে দলীয় বিবেচনায় না নিয়ে আদর্শগত বিরোধ থাকলেও যে বা যাঁরা অবদান রেখেছেন-তাঁদের সকলের সংক্ষিপ্ত জীবনী ছোটদের উপযোগী করে লেখার ব্যবস্থা গ্রহন করা জরুরী।মনে রাখতে হবে জীবিতদের বা প্রয়াতদের অনেককে নিয়ে বিশ্বাস ও আদর্শের মতপার্থক্য থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়।তাই রাষ্ট্রীয় বা বিভিন্ন আধা সরকারী কিংবা অলাভজনক জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্টানের মাধ্যমে স্কুল,মাদ্রাসা সহ ছোটদের বিভিন্ন প্রতিষ্টানে এসব বই সরবরাহের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারলে আগামী জমানার সন্তানদের মাঝে দেশপ্রেমের নীরব বিপ্লব অসম্ভব কিছু নয়।আমার বিশ্বাস মহানায়ক বঙ্গবন্ধু তখন আরো বেশী করে জনমনে স্থায়ী আসন তৈরী করে নেবে।
যাঁদের জীবনী স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকে জানার জন্য ছোটদের দেশপ্রেমে উদ্ভূদ্ধ করবে যথাক্রমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম থাকবে সকলের আগে।জাতিকে হাজার বছরের পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্য তিনি বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। অত:পর যথাক্রমে:
সিরাজুল আলম খান,শেখ ফজলুল হক মনি,আবদুর রাজ্জাক,তোফায়েল আহমেদ,কাজী আরিফ আহমেদ,চার খলিফা খ্যাত আ স ম আবদুর রব,আবদুল কুদ্দুস মাখন,নূরে আলম সিদ্দিকী,শাজাহান সিরাজ,
আওয়ামী লীগের এম এ আজিজ,তাজউদ্দিন আহমদ,সৈয়দ নজরুল ইসলাম,বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর খ্যাত খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ এইচ এম কামরুজ্জামান,ড:কামাল হোসেন।
অবশেষে বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত বেগম ফজিলতুন্নেসা মুজিব।
অন্যান্যরা:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,কবি নজরুল ইসলাম,কমরেড মোজাফ্ফর আহমদ,জীবনানন্দ দাশ,নেতাজী সূভাষ বোস,মহাত্মা গান্ধী,শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক,হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি,মওলানা ভাসানী,কমরেড মনি সিংহ,মোহাম্মদ ফরহাদ,মনোরঞ্জন ধর,অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ,কর্ণেল (অব:) এম এ জি ওসমানী, কাদেরিয়া বাহিনীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী(বাঘা সিদ্দিকী),মমতাজ বেগম,ফোরকান বেগম,সকল সেক্টর কমান্ডারবৃন্দ,বীর শ্রেষ্ঠ,বীর উত্তম,বীর প্রতীকবৃন্দ,কাজী জাফর,সিরাজ শিকদার,রাশেদ খান মেনন,বেগম মতিয়া চৌধূরী,হাসানুল হক ইনু,স্বপন কুমার চৌধূরী,হায়দার আকবর খান রণো,আ ফ ম মাহবুবুর হক,কামরুল আলম খান খসরু,সহ আরো অনেক বাহিনীর অধিনায়কদের,জাহানারা ইমাম ও শহীদ বুদ্ধিজীবিবৃন্দ।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভাষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার হিসাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি সহ স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রক্রিয়ায় কবিয়াল শফি,আবু সাঈদ চৌধূরী,আহমদ ছফা,এম আর আকতার মুকুল সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গোপনে প্রকাশিত “জয়বাংলা”ও “প্রতিরোধ”য়ে যাঁরা লিখতেন তাঁদের বের করে তাঁদেরও জীবনী প্রকাশ জরুরী।
তাছাড়াও শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী,জেনারেল মানেক’শ,ইষ্টার্ণ কমান্ডের জেনারেল অরোরা,সূর্যসেন,প্রীতিলতা,কল্পনা দত্ত সহ কবি সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবিদের অন্তর্ভূক্তির বিষয়টি দরকারী।অবশ্য যাঁদের স্বাধীনতা আন্দোলন সহ জনযুদ্ধে অবদান আছে।তবে খলনায়ক হিসাবে জেনারেল ইয়াহিয়া খান,জুলফিকার আলী ভূট্টো,জেনারেলটিক্কা খান,নিয়াজী,গোলাম আজম সহ যুদ্ধাপরাধের বিচারে শাস্তিপ্রাপ্তদের বিষয়টিও ভাবা যেতে পারে।
আগামী জমানার সন্তানদের দেশপ্রেমিক হিসাবে গড়ে তোলার স্বার্থে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও চেতনাকে সর্বগ্রহনযোগ্য করে তোলার জন্য আসুন অর্ধ সত্য না বলে দলীয় বিবেচনায় বিচার না করে জাতীয় স্বার্থে দূর্ণীতিমুক্ত দেশপ্রেমিক জাতি গঠনে আগামী জমানার সন্তানদের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করি।
৮’ই মার্চ,২০১৮
লাস ভেগাস,যুক্তরাষ্ট্র।

ছবি ও কৃতজ্ঞতা:গুগল,রশিদ তালুকদার,সুমন মাহমুদ ও লিনু হক।