– মাহ্ফুজুল হক 
এবারের এসএসসি পরীক্ষা খুবই শান্তিপূর্ণ ও ছাত্র-ছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরিক্ষার্থীরা খুবই খুশি এজন্য যে, তারা তাদের মনের মতো করে সব কিছু গুছিয়ে লিখতে পেরেছে। প্রায় শতভাগ পরিক্ষার্থী ফুল এনসার করতে পেরে ফুরফুরে মেজাজে আছে। গড়পড়তা শিক্ষার্থী ভাবছে, ভালোই তো সারা বছর খেলাধুলা করে কাটালাম। আর পরীক্ষাও দিয়েছি হেসে-খেলে, উত্তরও শতভাগ। ইনভিজিলেটর শিক্ষকরাও বেজায় খুশি। কেননা পরীক্ষায় নকল নামক অসদূপায়ের দৌরাতœ্য নেই বলে তাঁদের আর নকলবাজ পরিক্ষার্থীদের পিছু নিতে হয় না। সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখে অভিভাবকগণ তো খুশিতে আটখানা। সন্তান-সন্ততি পরিক্ষায় শতভাগ এনসার করতে পেরেছে, কোন ঝামেলা হয়নি। পরীক্ষায় তাদের এ প্লাস পাওয়া তো একপ্রকার নিশ্চিত। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়, শিক্ষা সচিব মহোদয়, শিক্ষাবোর্ড কর্মকর্তাসহ পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা ‘সম্পূর্ণ নকলমুক্ত পরিবেশে ও উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে’ দেখে মহাখুশি। দিকে দিকে শান্তির সুবাতাস, খুশির বন্যা। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, জাতির ভবিষ্যত কর্ণধার ছাত্র-ছাত্রীরা লেখাপড়ায় শুধু অসাধারণ নয় প্রায় শতভাগ সফলতা পাচ্ছে। এর চেয়ে সুখবর একটি উদীয়মান ও সম্ভাবনাময় জাতির জন্য এবং মধ্য আয়ের দেশের জন্য আর কী হতে পারে !
বসন্তের এই মৌ মৌ গন্ধের মধ্যে কটূ দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে কিছু বটতলার উকিল আর বেরসিক বিচারক। দিকে দিকে বয়ে চলা খুশির জোয়ারকে কৃঞ্চপক্ষের ভাটায় পরিণত করার জন্য দায়ীদের নিশ্চয় বেরসিক তো বটেই ক্ষ্যাপাটে বলতেই হয়। কেন খামাখা তাঁরা বাড়া ভাতে ছাই দিতে গেলেন ? তাঁদের উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই দেশের কল্যাণ চাওয়া নয় !
এক সময় পাবলিক পরীক্ষায় নকল একটা বড় সমস্যা ছিল। পরিক্ষার্থীরা কাগজে ছোট ছোট অক্ষরে উত্তর লিখে বিভিন্ন কায়দায় শরীরের সাথে বেঁধে বা আটকিয়ে পরিক্ষার হলে নিয়ে যেতো আর ইনভিজিলেটরের চোখ ফাঁকি দিয়ে তা উত্তর পত্রে লিখে নিতো। আবার কেউ কেউ পাঠ্যবই বা নোট বইয়ের পাতা কেটে নিয়ে যেতো। ‘চোরের সাতদিন আর গৃহস্থ্যের একদিন’ এই ফর্মুলায় কেউ যদি ধরা পড়তো তো কান্নাকাটি, মারপিট, এক্সপেল বা বহিষ্কার ইত্যাদি আর হল ভর্তি শিক্ষার্থী তা দেখে ভড়কে যেতো। এখন যুগ পাল্টেছে। মান্ধাতা আমলের সেই নকল এখন সেকেলে হয়ে গেছে। কোথায় ম্যানুয়েল ল্যান্ডফোন আর কোথায় স্মার্টফোন-আইফোন। তখন মানুষ ফোনের ডায়াল রিং ঘোরাতে ঘোরাতে ক্লান্ত হয়ে পড়তো। আর এখন সেইভ করে রাখা নাম্বারে গিয়ে কল বাটনে একবার চাপ দিলেই হলো। সেল ফোন সেটটি হাতে থাকা মানে পুরো দুনিয়াটা আপনার হাতের মুঠোয়। ক্যামেরা, টিভি, ভিডিও-অডিও, ইন্টারনেট, ফেইসবুক, টুইটার, ইমো-হোয়াটস এ্যাপ মানে যোগাযোগের সর্বশেষ হেন প্রযুক্তি-প্রোগ্রাম নেই যা ঐ একটি ছোট্ট মুঠোফোনে সংযুক্ত নেই। যখন-তখন, যে কারো কাছে, যা ইচ্ছে পাঠানো যায় আবার নেওয়াও যায়। এমনি অবস্থায় ঢাকা শহরের যে কুঠরিতে বসেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি বা সংরক্ষণ করা হোক না কেন তা একটা ¯েœপেই (ঝহধঢ়) দেশময় ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব। আর হচ্ছেও তাই। সংরক্ষিত কুঠরিতে অতি গোপনীয় জিনিসটি আর গোপন থাকছে না ; মুহূর্তে তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। আর এক টাকা দু’টাকা করে প্রেরকের হিসাবে জমা পড়ছে কাড়ি কাড়ি টাকা। বাহ্ ! কী সুন্দর ও অভিনব ব্যবসা। ইনভেস্টমেন্ট নেই, মার্কেটিং নেই, প্রচার-প্রপাগান্ডা ছাড়া বিনা পুঁজিতে ব্যবসা আর অতি স্বল্প সময়ে কোটি টাকা রোজগার। আলাদিনের চেরাগও হার মেনে যায় যেন।
দুষ্টজন বলেন, সর্ষেতে ভূত থাকার কথা। কথাটা বিশ্বাস করা কঠিন। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় একজন ক্লিন ইমেজ (?) বা পরিচ্ছন্ন ব্যক্তি হিসেবে মন্ত্রী পরিষদে গত দুই টার্ম ধরে বহাল তবিয়তে আছেন। সেখানে ভূত ! শুনতে লাগে বড়ই অদ্ভুত ! ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮, বুধবার তারিখ পত্রিকায় প্রকাশিত খবর দেখুন, ‘সম্প্রতি রাজধানীর পৃথক দুই এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় শিক্ষামন্ত্রীর পিও মোতালেব এবং মন্ত্রণালয়ের উচ্চমান সহকারী নাসির উদ্দিনকে। এই দুই কর্মচারীকে গ্রেফতার করার পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায় তারা কোটি কোটি টাকার মালিক। বাড়ি-গাড়ি, নামে-বেনামে বিপুল সম্পদের মালিক তারা। এমনকি নাসির তার শ্বশুর বাড়ি এলাকায় একটি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। এদের সাথে মন্ত্রণালয়ের একটি বিশাল সিন্ডিকেট রয়েছে। যারা দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষায় জালিয়াতিসহ নানা অসৎ কর্মকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে অভিযোগ উঠে আসে। মন্ত্রণালয় ও শিক্ষাবোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট অনেক দফতরের কিছু অসাধু লোককে নিয়ে তাদের সিন্ডিকেট রয়েছে।’
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম গত ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮ তারিখ বুধবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনে বলেন, ‘আগে একটি দু’টি প্রশ্ন মোবাইলে, ফেসবুকে পাওয়া যেত, এবার বাসভর্তি প্রশ্ন পাওয়া গেল, প্রশ্ন ফাঁসের পুরো বিষয়টি সরকারের নাগালের বাইরে চলে গেছে।’ সংসদে স্থিরচিত্র দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘শ্যামলী বাসে যেসব যাত্রী ছিল সবার কাছেই প্রশ্ন ছিল, এ পর্যন্ত ৭টি বিষয়ের সব প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘শিক্ষার পদে পদে ঘুষ বাণিজ্য, নানা নামে নানা কৌশলে বিভিন্ন অংকের টাকা লেনদেন হচ্ছে।’
১৭.০২.২০১৮ তারিখ এক কলামে ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী লিখেছেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস করছেন বহু ক্ষেত্রে শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা, ছাপাখানার কর্মচারী-কর্মকর্তা এবং সরকারের আপনজন ছাত্রলীগ। ফাঁস হতে হতে এমন কোনো পাবলিক পরীক্ষা নেই, যার প্রশ্নপত্র এখন আর ফাঁস হয় না। এখন এসএসসি পরীক্ষা চলছে। প্রতিদিন প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। মন্ত্রী কিছুদিন তড়বড় করলেন। প্রশ্ন ফাঁস হলেই পরীক্ষা বন্ধ। ধরিয়ে দিতে পারলে পাঁচ লাখ টাকা পুরষ্কার। তারপর একেবারে চুপ মেরে গেছেন। এখন বলছেন, ‘প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো যাবে না।’ কেন যাবে না ? এ বিষয়ে তার কাছে কোন জবাব নেই। তার সচিব বলে বসলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস যখন ঠেকানো যাবে না, বই খুলে পরীক্ষা দেয়ার বিধান করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এসব শুনে বলতে হয়, অশিক্ষিত গাছে ধরে না, এটাও অশিক্ষারই ফল।’
শিক্ষামন্ত্রীকে নিজ থেকেই তার পদ ছেড়ে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চেীধুরী ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮, শুক্রবার বলেন, ‘একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন ফাঁসের নায়ক কারা মন্ত্রী সাহেব কিছুই জানেন না। কিন্তু আপনি দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, সে দায়িত্ব আপনি পালন করেন নাই। আপনার কি সে আসনে থাকার অধিকার আছে ? আপনি পদত্যাগ করবেন না, ঠিক আছে। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার দায়িত্ব ছিল, দেশের ছেলে-মেয়েদের ধ্বংস হচ্ছে এই অযোগ্য লোককে মন্ত্রী বানিয়ে।’
গত ৫ ফেব্রুয়ারী জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ দাবী করেন। আর তিনি সরে না দাঁড়ালে তাকে বরখাস্ত করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন রাখেন। সেদিনই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে পদত্যাগের প্রস্তাব দেন শিক্ষামন্ত্রী। তবে প্রধানমন্ত্রী তাকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ১৭ ফেব্রুয়ারী, শনিবার এক বিবৃতিতে বলেন, ‘অব্যাহতভাবে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনায় এসএসসি পরীক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের সাথে আমরা সবাই গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও উৎকন্ঠিত। প্রশ্নপত্র ফাঁস করার মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের ভবিষ্যত ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। সৎ, আদর্শবান মেধাবী নেতৃত্ব তৈরির সকল রাস্তাই সরকার বন্ধ করে দিচ্ছে। এটা জাতির জন্য আতœঘাতী। এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে হলে সবাইকে ইসলামের দিকেই ফিরিয়ে আনতে হবে।’ অধ্যাপক মুজিব আরো বলেন, ‘ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মহল থেকে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগের জোরালো দাবী উঠেছে। কিন্তু সরকার প্রধান তাকে পদত্যাগ না করতে নছিহত করে জাতির সামনে একথাই প্রমাণ করলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে যা কিছুই হয়েছে সবই তার সমর্থনেই হয়েছে।’
গত ১৯ ফেব্রুয়ারী তারিখ প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে সরকারের সমালোচনা হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘মন্ত্রী কি নিজে প্রশ্নপত্র ফাঁস করতে গেছে, নাকি সচিব গেছে ? দেখুন, প্রশ্নপত্র ফাঁস- এটা কোনো নতুন কিছু না, এটা কিন্তু সব সময় যুগ যুগ ধরেই চলে এবং কখনো প্রচার হয়, কখনো প্রচার হয় না, এটা হলো বাস্তবতা। পরীক্ষার আগে আগে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া নিয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যখন প্রশ্নপত্র যায় হলে বা যে প্রতিষ্ঠানে, সে প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার পরে সেগুলো খোলা হয়। এখন সেখানে যদি কেউ চট করে ফটো নিয়ে মোবাইল ফোনে সেটাকে ছড়িয়ে দেয়, সেটা আপনি কী করবেন ?’
ষষ্ঠ/সপ্তম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালে শুনতাম, এসএসসি/এইচএসসি পরীক্ষায় চাকু/ছোরা/গা-ন নিয়ে পরীক্ষার হলে এক শ্রেণির ছাত্র প্রবেশ করতো আর বই দেখে দেখে পরীক্ষা দিত। দায়িত্বরত শিক্ষকরা ভুলেও তাদের দিকে তাকাতেন না। তারা নির্বিঘেœ পরীক্ষা দিয়ে বীরদর্পে বেরিয়ে যেতো। আজ এই এতো বছর পর মাননীয় হাইকোর্টের বক্তব্য পত্রিকায় পড়ে সেই ইতিহাস মানসপটে জেগে উঠছে। মাননীয় হাইকোর্ট ১৫ ফেব্রুয়ারী, বৃহস্পতিবার বলেন, ‘১৯৭০ সালে যারা (এমবিবিএস) পরীক্ষা দিয়েছিল তারা উচ্চতর ডিগ্রি নিতে উন্নত দেশে যাওয়ার পরে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল। কিন্তু ১৯৭১, ৭২ এবং ১৯৭৩ সালে পরীক্ষার হলে চাকু ছুরা নিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল তাদেরকে বিদেশে কোথাও পড়ার অনুমতি দিতো না। এমনকি ভারতেও পড়ার সুযোগ দেয়া হতো না।’
‘প্রশ্নফাঁসে লন্ডভন্ড শিক্ষাব্যবস্থা’ শিরোনামে পত্রিকায় ১৬ ফেব্রুয়ারী প্রকাশিত সংবাদ : ‘২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সাল ছিল পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের হিড়িকের বছর। ২০১৪ সালে বছর জুড়ে একের পর এক পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। সমাপনী, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় প্রায় প্রতিটি বিষয়ে মুড়ি-মড়কির মতো মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র। এছাড়া ওই বছর জেএসসি/জেডিসি পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ওঠে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘নিত্যনতুন পদ্ধতি এক্সপেরিমেন্ট করে শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। ইংরেজি কারিকুলামের লেখাপড়া কত বছর পর পরিবর্তন হয়। আমাদের কেন বছর না ঘুরতে পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে ? আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় তৈরি হচ্ছে অন্তঃসারশূন্য এক প্রজন্ম। সহজে পাশের হার বৃদ্ধি এবং অধিক নম্বর পেলেও শিক্ষার্থীদের মানের উন্নতি হয়নি। জিপিএ-৫ আর পাশের হারে সরকারের রাজনৈতিক সাফল্য। এতে শিক্ষার মানের বরং অবনতি হয়েছে।’ -দৈনিক আমাদের সময় ১৭.০২.২০১৮।
গত ২৫.৪.২০১১ তারিখ দৈনিক হিমছড়ি পত্রিকায় প্রকাশিত অত্র লেখকের কলাম এর সংশ্লিষ্ট অংশ : ‘আমাদের দেশে শুধু শিক্ষা ব্যবস্থা বা নীতি নিয়ে যতো এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে দুনিয়ার কোথাও তার দৃষ্টান্ত মেলা ভার। এক্সপেরিমেন্ট হয় আবার তা বিফলেও যায়, শিক্ষানীতি হয় আবার তার কার্যকারিতা স্থগিত হয়ে যায়, সরকার আসে সরকার যায়। এ ধরণের পরীক্ষা নিরীক্ষা পরীক্ষা পদ্ধতির বেলায় যেমনি হয়, তেমনি পাঠ্যসূচী প্রণয়ন, পাঠ্য পুস্তক ছাপানো (যেমন চলতি বছর পাঠ্য পুস্তক ছাপানো হয়েছে ভারত থেকে এবং সঙ্গত কারণেই উচ্চ মূল্যে।), শিক্ষক নিয়োগ (নিয়োগে যোগ্যতার বদলে দলীয় পরিচয়ই অগ্রগণ্য) প্রভৃতি ক্ষেত্রেও তা সতত পরিদৃশ্যমান। দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের মহামূল্যবান জীবন নিয়ে এহেন এক্সপেরিমেন্টের তামাশা বন্ধ করে মাত্রাতিরিক্ত পরীক্ষার বোঝা, যা শিশুশ্রমেরই নামান্তর, তাদের কাঁধ থেকে সরিয়ে শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ তথা বেড়ে ওঠার পথ খোলাসা করা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে।’
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী বলেন, ‘এখন পরীক্ষা পাশের প্রতিযোগিতা। সে প্রতিযোগিতায় মদদ দিতে গিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আরেক দফা শিক্ষার দফারফা করেছে। পাশের হার নাকি বাড়িয়ে দেখাতে হবে। এজন্য এমন সব মন্দ পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে, যা শিক্ষার জন্য সর্বনাশ ডেকে এনেছে। এসএসসি পরীক্ষায় ‘শতভাগ পাস’ দেখানোর জন্য করা হয়েছে অমন বাজে ব্যবস্থা। সরকারের তরফ থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করে পরীক্ষকদের বলা হয়েছে, কেউ যেন ফেল না করে। যেখানে ন্যুনতম পাস মার্ক ১০০ তে ৩৩, সেখানে ২৪ পেলে পাস করানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে বিবেকের তাড়নার বহু শিক্ষক-শিক্ষিকা পরীক্ষকের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। যদি কেউ ফেল করে, তাহলে সরকারের প্রজ্ঞাপন অনুসারে এ জন্য পরীক্ষককেই লিখিতভাবে জবাবদিহি করতে হবে। এ কেমন হীরক রাজার রাজত্ব ? কোনো স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া করানো হয়নি, ক্লাসরুমের পড়াশোনা ঠিকমতো হয়নি, শিক্ষক ঠিকমতো ক্লাস নেননি কিংবা শিক্ষকের অভাব রয়েছে, সে দায়িত্ব কেন দূরবর্তী কোনো স্কুলের পরীক্ষক গ্রহণ করবেন ? কিন্তু এ মন্ত্রী সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই বাধ্য করেছেন। তারপর হাসিমুখে ক্যামেরার সামনে বলেছেন, ‘আমাদের আমলে শিক্ষার এতটাই উন্নতি হয়েছে যে, প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থীই পাস করছে।’
প্রাসঙ্গিক অত্র লেখকের গত ১৭.৭.২০১৬ তারিখ দৈনিক হিমছড়ি পত্রিকায় প্রকাশিত কলামের অংশ বিশেষ : তাই তো দেখি, পরিক্ষা গ্রহনের বা খাতা কাটার পূর্বে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের ডেকে কর্তারা অনেকটা এই ভাষায় তালিম দেন যে, পঞ্চম শ্রেণির পড়া-শোনা শেষে পাবলিক পরিক্ষার আয়োজন করা কি অপরাধ হয়েছে? আগে যখন পাবলিক পরিক্ষা ছিল না, তখন কি আপনারা (শিক্ষকেরা) পঞ্চম শ্রেণিতে বার্ষিক পরিক্ষা নিতেন না আর তাতে কেউ ফেল করলে তাকে পরিক্ষায় উত্তীর্ণ দেখিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার ব্যবস্থা করে দিতেন না? সুতরাং সবাইকে নম্বর দিয়ে পাশ করিয়ে দেবেন। এমনকি কেউ সাদা খাতা জমা দিলে তাকেও পাশ করিয়ে দেবেন। বুঝহ সুজন !
১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮, বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ এসএসসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে সংশ্লিষ্টদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন। আগামি দুই সপ্তাহের মধ্যে শিক্ষা সচিবসহ সংশ্লিষ্ট ২০জনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রুল জারির পাশাপাশি চলমান এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের তদন্ত করতে বিচার বিভাগীয় এবং প্রশাসনিক দুটি কমিটি গঠন করে আদেশ দেন। মাদকের মতো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে প্রশ্নপত্র ফাঁস। মাদক যেভাবে তরুণ সমাজকে ধ্বংস করছে প্রশ্নপত্র ফাঁসও তেমনি দেশের তরুণদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছে বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। এ সময় আদালত নিরব দর্শকের মতো বসে থাকতে পারে না।
সচিব, মন্ত্রী এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মুখেও প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে হতাশা, অপারগতা ও অক্ষমতার কথা উচ্চারিত হয় যখন, তখন লজ্জায় আমাদের মাথা হেট হয়ে আসে। কর্তাদের মুখে কথায় কথায় জিরো টলারেন্সের কথা শোনা যায়। কিন্তু জাতি বিনাশী ওই সর্বনাশা প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে সেই কথিত জিরো টলারেন্সের কথা শোনা যায় না কেন ? প্রাকৃতিক দুর্যোগের বেলায় নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশের বিষয়টিকে হয়তো মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু খুবই মুষ্ঠিমেয় কিছু দুষ্কৃতকারীকে সরকারের বিশাল বিশাল বাহিনী ধরতে পারে না, একথা কি বিশ্বাসযোগ্য ? স্বলালিত অপকীর্তি জাতির বৃহত্তর স্বার্থে রোধ করতে সংশ্লিষ্ট সকলের সুমতি হোক- এটাই প্রত্যাশা। মরণঘাতি রোগ নিরাময়ের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অপারেশন অনতিবিলম্বে, দেরী হয়ে যাবার আগে করা বাঞ্জনীয়। মাননীয় হাইকোর্টের গৃহীত ওই পদক্ষেপে আমরা আশাবাদী হতে চাই।