বিদেশ ডেস্ক:
আমাদের চেনাজানা ইতিহাসে অমানবিক কর্মকাণ্ডের নজির কম নয়। তবে প্রবহমান ইতিহাসের পথে মানবিক বিবেচনার নজিরও বিরল নয়। কক্সবাজারের দুই কৃষক ৭৬টি রোহিঙ্গা পরিবারের আশ্রয় হয়ে তেমনই এক অনন্য মানবিকতার নজির গড়েছেন। এদের একজন মোহাম্মদ করিম নিজের ভূমিতে আশ্রয় দিয়েছেন ৪০টি পরিবারকে। পৃথিবীর সবথেকে বিপন্ন ওই জনগোষ্ঠীর দুর্দশায় নিশ্চুপ থাকতে পারেননি তিনি। আরেক কৃষক খালেদা বেগম আশ্রয় দিয়েছেন ৩৬টি পরিবারকে। এজন্য নিজের বাগানের দুই শতাধিক গাছ কেটে ফেলতেও দ্বিধা করেননি তিনি। মানবিক আর্তিতে সাড়া দেওয়াটাই তার আনন্দ। এই দুই কৃষক রোহিঙ্গাদের শরণার্থী থেকে রূপান্তর করেছেন প্রতিবেশিতে। যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে চারপাশজুড়ে অপরাধকর্মের ভয়, সেই সম্প্রদায়কেই নিজেদের নিরাপত্তা মনে করছেন তারা। ওই দুই কৃষকের উদ্যোগে সামিল হয়েছে জাতিসংঘসহ বাংলাদেশের সরকার ও বেসরকারি সংস্থা।

বহুদিন থেকেই পাশ্চাত্যের শিল্পায়িত দুনিয়ার কার্বন মচ্ছবে নির্মিত প্রকৃতি-বিনাশী উন্নয়নের অভিঘাত এসে আঁচড়ে পড়েছে বাংলাদেশের উপকূলে। সেই অভিঘাতেই সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও ভূমিধসের কবলে পড়ে প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। কৃষক মোহাম্মদ করিমের আবাস ছিল সেই দ্বীপেই। ‘জলবায়ু শরণার্থী’ হয়ে তিনি আশ্রয় নেন কক্সবাজারের কুতুপালংয়ে। সেপ্টেম্বরে মিয়ানমার থেকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী আসতে শুরু করে ওই কুতুপালংয়ে। নিজের সাধ্যমতোন তাদের সহায় হয়েছেন কোনও দ্বিধা ছাড়াই । বাড়ির পাশের ধানখেত, ম্যানগ্রোভ গাছপালা আর সবজি খেতের আশেপাশে ৪০ টি পরিবারকে থাকতে দেন।জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র দেওয়া সরঞ্জাম দিয়ে অস্থায়ী বাড়ি বানিয়ে নেয় শরণার্থীরা।

করিম আর তার স্ত্রীর ঘরে তিন সন্তান। তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের দুর্দশা তার কাছে ছিল সহ্যাতীত। নিজের জমিতেই তাই তাদের আশ্রয় দেন তিনি। কেবল আশ্রয় নয়। দিয়েছেন মাছ আর সবজির মতো খাদ্য সহায়তাও। কাউকে কাউকে রান্নার জন্য জ্বালানিও সরবরাহ করেছেন করিম। আশ্রিতদের একজন ২৬ বছরের আবুল মনজুর। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থিদের আক্রমণের মুখে কয়েক সপ্তাহ পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে পৌঁছায় মনজুর। বলেন, ‘এখানে কেউ আমাদের একটুও বিরক্ত করেনি। আমরা নিরাপদে আছি, ভালো আছি।’

আগস্টের শেষ সপ্তাহে রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো হওয়ার পর স্রোতের মতো আসতে থাকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষেরা। বাংলাদেশের মানুষের মানবিক বোধের কারণেই তারা ঢুকতে পেরেছেন সীমান্ত পেরিয়ে। সহিংসতার কারণে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় ৭ লাখ মানুষের খাদ্য, আশ্রয়, পোশাকের পাশাপাশি নিজ ভূমিতে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয়রাই এগিয়ে এসেছে।

করিমের বাড়ি থেকে কুতুপালং গ্রামের মেঠোপথ ধরে একটু এগোলেই খালেদা বেগমের বাড়ি। এই চার সন্তানের জননীও পালিয়ে আসা শরণার্থীদের জন্য নিজের বসতবাড়ির দরজা খুলে দিয়েছেন।‘ওরা একেবারেই খালি হাতে এসেছিল। অবস্থা দেখে আমি সত্যিই হোঁচট খাই।’ বলেন ২৬ বছর বয়সী খালেদা। ৩৬ টি শরণার্থী পরিবারের সঙ্গে খাবার, রান্নাঘর এমনকি ঘরও ভাগাভাগি করে নিয়ে থাকছেন এই নারী। বলেছেন, ‘আমি তাদের কষ্টটা টের পাই, যে পরিস্থিতি তারা পার করে এসেছে তা সহ্য করার নয়।’

নিজেদের জমির আড়াই শতাধিক ফলন্ত আম-কাঁঠাল-পেয়ারা গাছ কেটে শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছেন খালেদা। আশ্রিতাদের অনেকেই ছিল গর্ভবতী। তাদের মধ্যে চারজন আসার কয়েকদিনের মধ্যেই সন্তানের জন্ম দেন। সাফিতা বেগম (১৮)আর তার স্বামী মোহাম্মদ কাউসার (২২) এসেছেন সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে ।পাঁচদিন পরেই জন্ম নেয় তাদের সন্তান রুমি। রাখাইনের দুর্বিষহ দিনগুলো পেরিয়ে পালিয়ে আসতে পারায় ‘আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া’ আদায় করেন। এখন নিজের মেয়ের জন্য একটা ‘নিরাপদ আর সুরক্ষিত ভবিষ্যত’র স্বপ্ন দেখেন তিনি।

অর্থ আর প্রাচুর্যে ভরা কোনও উন্নত দেশ নয় বাংলাদেশ। ঘনবসতির দেশ হিসেবেও বাংলাদেশের নাম রয়েছে সামনের কাতারে। গত ছয় মাসে পালিয়ে আসা শরণার্থী স্রোত কুতুপালং ও আশেপাশের এলাকাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত করেছে।

করিম আর খালেদার মতো স্থানীয়দের উদ্যোগে সামিল হয়েছে বাংলাদেশ সরকারও। সামিল হয়েছে ও তাদের স্থানীয় ও বৈশ্বিক সহযোগিরাও। করিমের জমিতে ইউএনএইচসিআর ও তাদের প্রায়োগিক অংশীদার কারিতাস শরণার্থীদের জন্য আশ্রয়, নলকূপ, ল্যাট্রিন ও গোসলের জায়গা বানিয়ে দিয়ে তাদের জীবন মানের খানিক উন্নতি ও পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি কমিয়েছে। খালেদার ছোট বাড়িটি কেবল আশ্রয় নয়, ব্যবহৃত হচ্ছে অন্যান্য কাজেও। সেভ দ্য চিলড্রেন সেখানে শিশু সহায়ক কেন্দ্র খুলেছে। উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত একটি ক্লিনিকও রয়েছে সেখানে।

ব্র্যাকের মেডিকেল এসিসটেন্ট মোহাম্মদ নাইমুর রহমান বলেন, ‘প্রত্যেক দিন একশোরও বেশি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে থাকে। মৌলিক সেবা দেওয়া হলেও শরণার্থীদের জন্য তা খুবই প্রয়োজনীয়।’

কয়েকটি ছোট ছোট প্রকৌশল প্রজেক্টের মাধ্যমে বাঁশের তৈরি সাঁকো, সিঁড়ি, সেতু, মাটি ধরে রাখার দেওয়াল বানানোর কাজ চলছে। এছাড়া কারিতাস রাস্তায় আলো বসানোয় স্থানীয়দের পাশাপাশি নতুন আগতরাও সুবিধা পাচ্ছেন।

শরণার্থীদের এই ব্যাপক ঢেউ বাংলাদেশিদের সংকট বাড়িয়েছে। তাদের কারণে খাদ্যপণ্য, তেল, নির্মাণ উপকরণের দাম বেড়েছে। পরিবেশের ওপর চাপ বেড়েছে। সৃষ্টি হয়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। তারপরও করিম আর খালেদারা মানবিক আর্তিতে সাড়া না দিয়ে পারেন না আতিথ্যের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির ধারক এই দেশটিতে। ‘ প্রতিদিনই আমাদের বাড়িতে রোহিঙ্গা শরণার্থী নারী ও শিশুরা আসে আর আমরা এখন তা উপভোগও করি। আমার শিশুরা তাদের শিশুদের সঙ্গে খেলে। তাদের নতুন বন্ধু হয়েছে। মিয়ানমারে নিরাপদে ফেরার সুযোগ না পাওয়া পর্যন্ত তাদের থাকতে দেব।’ জানান করিম। খালেদার ভাষ্য, এরা আসার আগে আমার প্রতিবেশিরা নীরব থাকতো। চারপাশজুড়ে নতুন প্রতিবেশির বসবাসে আগের চেয়েও নিরাপদ বোধ করেন তিনি। শুনতে ভালোবাসেন শিশুদের হাসির শব্দ। ‘সর্বোচ্চ বিপন্নতায় তাদের সহায়তা দিতে পেরে আমি খুব খুশি,’ বলেন খালেদা।

সূত্র: ইউএনএইচসিআর