(পূর্বে প্রকাশের পর)

শহীদুল্লাহ্ কায়সার ॥

মোঃ আলী হোসেন, কক্সবাজার জেলার একটি নাম এবং ইতিহাসের একটি অংশ। জেলার সর্বস্তরের মানুষ থেকে শুরু করে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত যাঁকে সম্মান প্রদর্শন করেছেন। কর্মবীর এই মানুষটিকে সমীহ করেন না জেলাপ্রশাসক কার্যালয়ে এমন কর্মকর্তা-কর্মচারী দেখা মেলা ভার। অনেকেই পরোক্ষে তাঁর সমালোচনা করেন। কিন্তু একটি কথা বলতে কার্পণ্য করেন না। এই একজন মানুষ কক্সবাজার জেলার জন্য রাতদিন পরিশ্রম করে চলেছেন।

২০১৭ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের ৬ তারিখে প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার সফরে এসেছিলেন। ওই দিন দুপুরে শহরের শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন তিনি। কিন্তু জনসভার আগেই জেলার গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি প্রকল্প এবং স্থাপনার ভিত্তি প্রস্তরের ফলক উন্মোচন করতে হয় তাঁকে।

ওই দিন দুপুরে একটি কালো রঙের মার্সিডিজ বেঞ্জে চড়ে প্রধানমন্ত্রী আসেন জনসভাস্থলে। মঞ্চে উঠার আগেই ভিত্তি প্রস্তরের ফলক উন্মোচনের কাজ সারতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। আর ওই অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব বর্তায় জেলাপ্রশাসক মোঃ আলী হোসেনের উপর। তিনি একে একে প্রকল্প এবং স্থাপনাগুলোর নাম বলে যাচ্ছিলেন। আমি তখন জেলাপ্রশাসকের ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে। সংবাদ সংগ্রহ করা ছিলো আমার প্রধান লক্ষ। কিন্তু পরক্ষণে যা দেখলাম তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। যাঁকে কেন্দ্র করে এটি হলো তিনিও যে প্রস্তুত ছিলেন না সেটি একটু পরেই বুঝতে পারলাম।

ঘোষণার পর জেলাপ্রশাসক মোঃ আলী হোসেন প্রধানমন্ত্রীকে সুইচ টিপে ফলক উন্মোচনের অনুরোধ জানান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কিছুতেই সুইচে টিপ দিচ্ছিলেন না। এ কারণে সেখানে উপস্থিত সবাই হতবাক। দেশের সরকার প্রধান কি তাহলে অনুষ্ঠানে কোন ত্রুটি দেখতে পেয়েছেন? কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছিলেন না। পরক্ষণেই সবাই বুঝতে পারলেন প্রধানমন্ত্রী হাতের ইশারায় কাউকে ডাকছেন। জেলাপ্রশাসক মোঃ আলী হোসেন তখন ঘাবড়ে যান। সামনে, পেছনে আর আশপাশে তাঁর চোখ ঘুরপাক খাচ্ছিল। তিনি বোঝার চেষ্টা করছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হাতের ইশারায় কাকে ডাকছেন।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী হাতের ইশারা তখনো অব্যাহত। ফলক উন্মোচনের কাজও রয়েছে থমকে। এক পর্যায়ে মোঃ আলী হোসেন বুঝতে পারলেন প্রধানমন্ত্রী তাঁকেই ডাকছেন। এরপরপরই তিনি দৌঁড়ে চলে যান প্রধানমন্ত্রীর সামনে। প্রধানমন্ত্রীর পাশে তখন দেশের প্রথম সারির কয়েকজন পূর্ণমন্ত্রী। তিনি তাঁদের একটু দূরে সরিয়ে দিয়ে মোঃ আলী হোসেনকে তাঁর পাশে নিয়ে যান। এরপরই ফলক উন্মোচনের সুইচে টিপ দেন।

দেশের সরকার প্রধানের এই ধরনের সম্মান জানানো প্রশাসকের কক্সবাজারে দায়িত্ব পালনের শুরুটা মোটেও সুখকর ছিলো না। তিনি যখন এই জেলার দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন কক্সবাজার জেলা প্রশাসন চরম বিতর্কিত। মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করেই ছিলো এই বিতর্কের সূত্রপাত। তাঁর পূর্বসূরির বিরুদ্ধে এই অভিযোগে আদালতে মামলা চলছে। ওই সময়ে চারিদিকে কানাঘুষা চলতে থাকে প্রধানমন্ত্রী নিজে পছন্দ করে একজন সৎ কর্মকর্তাকে কক্সবাজারের জেলাপ্রশাসক নিযুক্ত করেছেন।

আমি তখন দৈনিক আজকের দেশ বিদেশ পত্রিকায় কর্মরত। জেলাপ্রশাসক কার্যালয়ের বিট কাভার করার দায়িত্ব আমার। ফলে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমাকে ছুটে যেতে হতো জেলাপ্রশাসক কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে। যাতে কোন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ বাদ না যায়। এ কারণে মোঃ আলী হোসেনের নিযুক্তির বিষয়টি আমি একটু আগেই জেনেছিলাম।

তিনি কক্সবাজার এসেই প্রথম যে সমস্যার সম্মুখীন হন তা হলো কক্সবাজারে কর্মরত সংবাদকর্মীদের একটি অংশ আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। বিষয়টি মোঃ আলী হোসেনের কাছে বিব্রতকর হলেও সেটি তিনি বুঝতে দেননি। পরবর্তীকালে জেলায় কর্মরত সব সংবাদকর্মীর অতি আপনজন হয়ে উঠেন। সংবাদের ব্যাপারে জাতীয় পত্রিকার চেয়ে স্থানীয় পত্রিকাগুলোকে দিয়েছেন অধিক গুরুত্ব। অনেক সময় স্থানীয় পত্রিকার সংবাদকর্মীদের নিজ কক্ষে নিয়ে গিয়ে সংবাদের বিষয়বস্তু সহজভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের চেয়েও বড় রোহিঙ্গা সমস্যাকে মোকাবেলা করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। তাঁর সময়ে বিশ^ব্যাপী আলোচিত রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়টি সামাল দেয়া জেলাপ্রশাসক হিসেবে তাঁকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছেন।

যে বিষয়টি জেলার রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সুধীজনদের করার কথা সেটিও তাঁকেই করতে হয়েছে। এক সময় ক্ষোভের সঙ্গে তাঁকে বলতে শুনা গেছে, “সবাই শুধু রোহিঙ্গাদের কথা বলছে। স্থানীয়দের কথা কেউই ভাবছে না।”

মোঃ আলী হোসেন শুধু ভূমি আইনে দক্ষ নন। তিনি ভূমি আইনের একজন সু-পন্ডিত। চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাপ্রশাসকদের নিয়ে কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত “ভূমি জোনিং ম্যাপিং” শীর্ষক কর্মশালায় ভূমি আইনের উপর তিনি যে বক্তব্য রেখেছিলেন সেটি সেখানে উপস্থিত সকলেই কান খাড়া করে শুনেছেন। ভূমি আইনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়গুলো তিনি তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেছিলেন।

এ জেলার শিক্ষা বিস্তারের বিষয়ও তিনি তাঁর অনেক বক্তব্যে তুলে ধরেছিলেন। আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন, জেলার শিক্ষা ব্যবস্থার ক্রমাবনতি দেখে। চেয়েছিলেন কক্সবাজারের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনে কাজ করতে। কিন্তু সময় তাঁকে সেই সুযোগ করে দেয়নি।

যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন সময়ে তিনি জান-মাল রক্ষায় যে পদক্ষেপ নিতেন শুধু কক্সবাজার জেলা নয়। সারাদেশ এমনকি বিশে^র প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত রাষ্ট্রগুলোর জন্যও তা অনুকরণীয় হতে পারে।

এক রাতে কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে গিয়েছিলাম তাঁর বাসভবনে। তিনি বাসভবনের যে কক্ষটিতে দাপ্তরিক কাজ কর্ম সারেন সেখানে আমাদের নিয়ে যান। বেয়ারাকে বলেন, আমাদের জন্য চা-নাস্তার ব্যবস্থা করতে। এরই ফাঁকে তিনি আমাদের সঙ্গে রীতিমতো বন্ধুসুলভ আড্ডায় মেতে উঠেন। বিশেষ করে কতো চাপ সহ্য করে তাঁকে কাজ করতে হয় সেটিই বলতে থাকেন। একপর্যায়ে বলেন, “আমি ঘুষ খাই না।” এর একটু পরে এক মন্ত্রীর সঙ্গে স্বাক্ষাৎ করতে তিনি আমাদের তাঁর বাসভবনে রেখে যান। আর বলেন, “আপনারা অবশ্যই চা-নাস্তা খেয়ে যাবেন।”

এমন মানুষেরা যদি দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন তাহলে বুঝতে হবে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রে গলদ রয়েছে। আমাদের গবেষণাপূর্বক সেই গলদ খুঁজে বের করে দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মোঃ আলী হোসেনরা জাতির সম্পদ। তাঁর উত্তরসূরি পূর্বসূরির অনুসৃত পথ অবলম্বন করবেন। সেটিই জেলাবাসীর প্রত্যাশা।

লেখক : সংবাদকর্মী।