ডেস্ক নিউজ:
সৌদি আরবে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় থাকা বাংলাদেশিরা শিগগিরই মহাবিপদে পড়তে চলেছেন। সম্প্রতি সৌদি শ্রম মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছে যে, দেশটির ১২ ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিদেশিরা আর করতে পারবেন না। আগামী সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে অর্থাৎ নতুন হিজরি সনের ১ মহরম থেকে এই আইন কঠোরভারে বাস্তবায়ন করবে সৌদি সরকার। এতে সে দেশে প্রায় ৭০ হাজার বাংলাদেশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে তাদের মূলধন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ফেলে দেশে ফিরে আসতে হবে এবং এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় দেড় লাখ বাংলাদেশি তাদের চাকরি হারাতে পারেন।
সৌদি আরবে বাংলাদেশি এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, তিনি একটি মুদি দোকানে তিন লাখ রিয়াল বিনিয়োগ করেছেন। তার দোকানে মোট ২০ লাখ রিয়ালের মালামাল রয়েছে। কিন্তু সৌদি সরকার ১২ ধরনের ব্যবসায় বিদেশি নাগরিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয়ায় বিরাট সংকটে পড়েছেন। কারণ, তার মুদি দোকানটি এখন কেউ এক লাখ রিয়ালেও কিনতে রাজি হচ্ছে না। যেহেতু কোনো বিদেশি এসব ব্যবসা আর করতে পারবে না, তাই কোনো বিদেশি নাগরিক কিনতে চান না। আবার এসব দোকানের লাইসেন্স যেহেতু সৌদি নাগরিকের (কফিল) নামে নিতে হয়, কাজেই সব মালামাল সেপ্টেম্বর থেকে সেই কফিলকে দিয়ে খালি হাতে দেশে ফিরতে হবে।
সৌদি আরবে তার মতো আরো প্রায় ৭০ হাজার বাংলাদেশি ব্যবসায়ী রয়েছেন, যাদের বিনিয়োগ এক থেকে ৫ লাখ রিয়াল পর্যন্ত। এই হিসাবে কমপক্ষে ২০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের, যা হারিয়ে আগামী সেপ্টেম্বরে দেশে ফিরতে হবে। এ ছাড়া এসব ব্যবসায় কর্মরত প্রায় দেড় লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক তাদের কাজ হারাতে পারেন। যদি দোকানের লাইসেন্স মালিক অর্থাৎ কফিলরা এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাংলাদেশিদের ছাঁটাই না করেন, তাহলে কিছুটা রক্ষা হতে পারে।
সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ ফোনে মানবকণ্ঠকে জানান, সৌদি আরবে বিদেশিদের কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেয়ার নিয়ম নেই। শুধুমাত্র সৌদি নাগরিকদের নামেই ব্যবসার লাইসেন্স দেয় সে দেশের সরকার। কাজেই কেউ শ্রমিক হিসেবে গিয়ে ব্যবসা শুরু করলে তা বেআইনি। আর সৌদি সরকার সম্প্রতি ১২ ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাতে বিদেশিদের ওপর যে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছে তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে বলেই মনে হয়।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ শ্রমিক প্রেরণকারী দেশগুলো থেকে প্রথমে সৌদি আরবে যান শ্রমিক হিসেবে। পরে বেশি টাকা আয় হলে তারা কোনো এক সৌদি নাগরিকের (কফিল) নামে লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। এতে লাভের পরিমানও বেশি। এক্ষেত্রে লাভের একটি অংশ ওই কফিলকে দিয়ে দিতে হয়। এভাবে সৌদি আইনি সুযোগ নিয়ে প্রায় চার দশক ধরে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। কিন্তু সৌদি সরকার সম্প্রতি ঘোষণা দেয় ১২ ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাতে পারবেন না বিদেশিরা। এতে কপাল পুড়েছে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদেরও।
এসব ব্যবসাগুলোর মধ্যে আছে-ঘড়ি, চশমা, চিকিৎসা যন্ত্রাংশ, গাড়ির যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী, ভবন নির্মাণ সামগ্রী, কার্পেট, গাড়ি ও মোটরসাইকেল, আসবাবপত্র, তৈরি পোশাক ও প্রসাধনসামগ্রী, পেস্ট্রি ও গৃহস্থালির টুকিটাকি জিনিস। সূত্র জানায়, বাংলাদেশিরা এই ১২ ধরনের ব্যবসার সঙ্গেই অধিকাংশ জড়িত। সৌদি সরকারের এই ঘোষণায় বাংলাদেশিদের মধ্যেও নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সৌদি আরবে বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১২ ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাতে বিদেশিদের ওপর সৌদি সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অধিকাংশ শ্রমিক কাজ হারাবেন। কারণ, সৌদি আইনে বিদেশ থেকে শ্রমিক আনতে অর্থ না নেয়ার কথা থাকলেও সৌদি নাগরিকরা তা মানছেন না। শুধু ব্যক্তি পর্যায়েই নয়, সৌদি বড় বড় কোম্পানির উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাংলাদেশের এজেন্সিগুলোর সঙ্গে আঁতাত করে মোটা অর্থে ভিসা বিক্রি করেন। ফলে অভিবাসন ব্যয়ও বেড়ে যায়।
কিন্তু এই আইনটি বাস্তবায়ন হলে বিদেশিদের ফেলে যাওয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অর্থের বিনিময়ে ফের কর্মী নিয়োগ শুরু হবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কর্মরত বিদেশি শ্রমিকরা, আর লাভবান হবে ভিসা কেনা-বেচায় জড়িতরা। বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, একটি ভিসা পেতে এক থেকে দুই লাখ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এজেন্সিও মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে দাঁড়াচ্ছে। ফলে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ে যাচ্ছে সৌদি আরব যেতে। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জোরালো ভূমিকা রাখা উচিত। সৌদি আরবে কারো বিরুদ্ধে ভিসা কেনা-বেচার অভিযোগ প্রমাণিত হলে ১৫ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু অপরাধটির দিকে নজরদারি নেই।প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন বলেন,
সরকারের বেঁধে দেয়া অর্থের বাইরে কয়েক গুণ বেশি টাকা নিয়ে সৌদিতে কর্মী পাঠানো হচ্ছে।এ জন্য বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেছি। অনেক ক্ষেত্রে তাদের জামানতের টাকাও কেটে রাখা হয়। ভিসা কেনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিশেষ করে সৌদিতে গৃহকর্মী ভিসার ক্ষেত্রে টাকা দিয়েও নাকি ভিসা কিনে থাকে। সৌদি আইন অনুযায়ী সৌদির কোনো ব্যক্তি এটা করতে পারে না। উল্টো সৌদি মালিককে শ্রমিক নিতে হলে বিমানভাড়াসহ যাবতীয় খরচ বহন করেই নেয়ার কথা। কিন্তু উল্টো তাদের টাকা দিয়ে ভিসা কেনা হচ্ছে। যার ফলে অভিবাসন ব্যয় অনেক বেশি পড়ে যাচ্ছে। এটা বন্ধ করতে আমাদের দূতাবাসকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়া আছে।
এদিকে বিদেশগামী কর্মীদের জন্য বাংলাদেশ সরকার অভিবাসন ব্যয়ের হার বেঁধে দিলেও এজেন্সিগুলো তা মানছে না। সরকারের নির্ধারিত এ ব্যয় হচ্ছে সৌদি আরবে ১ লাখ ৬৫ হাজার, মালয়েশিয়ায় ১ লাখ ৬০ হাজার, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১ লাখ ৭ হাজার, কুয়েতে ১ লাখ ৬ হাজার, ওমানে ১ লাখ, ইরাকে ১ লাখ ২৯ হাজার, কাতারে ১ লাখ,জর্ডানে ১ লাখ ২ হাজার, মালদ্বীপে ১ লাখ ১৫ হাজার ও ব্রুনাইতে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। বেশি অর্থ নেয়া ঠেকাতে সার্ভিস চার্জসহ সব অর্থ ব্যাংকের (চেক, ড্রাফট, পে অর্ডার) মাধ্যমে লেনদেন করার কথা থাকলেও হাতে হাতে টাকা নিয়ে থাকে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। দেয়া হয় না রসিদও।