রহিম আব্দুর রহিম :

এক সপ্তাহের অধিক সময় ভারতে ছিলাম। গত ৩০ জানুয়ারি যাওয়া হয়েছিল, উদ্দেশ্য গ্লোবাল থিয়েটার ফেস্টিভালে অংশগ্রহণ। উড়িষ্যা রাজ্যের কটাক শহরের কলাবিকাশ কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত উৎসবে ভারতের ১২ টি রাজ্যের ৫১টি দল, আফ্রিকা মহাদেশের মরক্কো’র ১ টি এবং বাংলাদেশ থেকে একমাত্র পঞ্চগড় বিদ্রোহী শিশু কিশোর থিয়েটার এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে। হত-দরিদ্র ১৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে গঠিত দলটির দলনেতা, নাট্যকার এবং নির্দেশক হিসাবেই আমার যাওয়া হয়েছিল। উৎসবে কথা হয়েছে, ভারতের অন্যান্য রাজ্যের অংশগ্রহণকারী কর্তাব্যক্তিদের সাথে। প্রতিবছর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এধরনের নিয়মিত উৎসব করার কারণ জানতে চেয়েছি। তাঁরা জানিয়েছেন, পরস্পরের মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধন দৃঢ়করণ এবং স্বদেশের রুপ-সৌন্দর্যে আকৃষ্ট করে ভিনদেশী পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ানো। এবার আমি তাঁদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনারা কেন বাংলাদেশ ঘুরতে যান না ? উত্তরে এসেছিল, ‘শুনেছি বাংলাদেশে রেল যোগাযোগ তেমন নাই। বাসে ভিড়, সড়কে জ্যাম, ভ্রমনে মজা নেই।’ ২৮ জানুয়ারি থেকে ৮ ফেব্র“য়ারি অনুষ্ঠিত নাট্য উৎসব শেষে ভ্রমনের পালা। কটাক থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা। কটাকের রাজধানী ভুবেনশ্বরের কাছাকাছি পৌঁছালে ট্রেনে কথা হল, রবীন্দ্রনাথ মিশ্রের সাথে। তিনি জানতে চাইলেন, আমরা কোথা থেকে এসেছি, কেনো এসেছি? বললাম উৎসবের কথা। এবার তিনি আমাদের নাটকের ধারণকৃত ভিডিও দেখতে আগ্রহী। দলের বহন করা ল্যাপটপ চালু করে দেখানো হল ৭১’এর মুক্তিযুদ্ধের গোয়েন্দা কাহিনী নিয়ে নির্ভর বাংলাদেশের পরিবেশনা। নাটকের গল্প, আবহসঙ্গীত, কোরিওগ্রাফ সব মিলিয়ে তিনি মুগ্ধ। পাশেই বসা ছিলেন উড়িষ্যার ভদ্রাক নামক জায়গার বাসিন্দা, তিনিও এই নাটকটির ভিডিও দেখেছেন, যিনি গুজরাটের আহমেদাবাদ শহরে দীর্ঘদিন যাবৎ ঠিকাদারী ব্যবসার সাথে জড়িত। তিনি আমার কানে কানে বললেন, ‘আমার কাছে একটি গল্প আছে, যা দিয়ে আপনি নাটক বানাতে পারবেন।’ বললাম বলুন, ‘কিছু মনে করবেন না তো?’ বললাম, নো নো বলুন। ‘আপনারা কি পাসপোর্ট-ভিসা করে এসেছেন? বললাম অবশ্যই।

তিনি বললেন, ‘ওদের তো পাসপোর্ট-ভিসা নেই, জানতে চাইলাম ওরা কারা? তিনি বললেন, আপনার দেশের অসংখ্য তরুন যুবতীরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের বিউটি পার্লারের আড়ালে দেহব্যবসায় যুক্ত।’ আমি বললাম ওরা আমার দেশের আপনি কি করে জানলেন? তিনি বললেন, ‘আমি খদ্দের হিসাবে এক নারীর করুন কাহিনী জেনেছি। এই নারী বাংলাদেশের একটি গার্মেন্টের কর্মী ছিলো। ভারতের এক ব্যবসায়ী ওই গার্মেন্টের কর্তা ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করে এই নারীকে আরও ভাল চাকুরী দেওয়া লোভ দেখিয়ে ভারতে এনে এই নরককুন্ডে নিক্ষেপ করেছে। মেয়েটি এখান থেকে অব্যাহতি পেতে আমাকে বার বার অনুরোধ করেছে। আপনি যখন নাট্যকার, এদের নিয়ে নাটক লিখুন। এই মেয়ে অব্যাহতি না পেলেও হয়ত অসংখ্য নারী এধরনের জঘন্য মানুষদের হাত থেকে রক্ষা পাবে।’ এবার তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম এটা তো একটি ঘটনা অসংখ্য নারী কোথায়? তিনি বললেন সারা ভারতের প্রায় রাজ্যেই পতিতাবৃত্তির সাথে জড়িত ওপারের (বাংলাদেশের) নারীরা সম্পৃক্ত। তিনি যে গল্প শোনান, তাতে তিনি স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন ঘটনাটি গুজরাটের আহমেদাবাদ শহরের। তিনি তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে গুজরাট, মুম্বাই ও মহারাষ্ট্র রাজ্যের বিভিন্ন শহরের, বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রের পতিতাদের কথা তুলে ধরেছেন। তাঁর কথা আমার বিশ্বাস হয়েছে। কারণ, আমার জন্মস্থান জামালপুর জেলার তারার ভিটা গ্রামের প্রতিবেশী খোকন (৩০) নামের এক গার্মেন্ট কর্মীকে অধিক বেতনে চাকুরি দেওয়ার নামে মুম্বাইয়ে পাচার করা হয়েছিল। পাসপোর্ট-ভিসাহীন এই খোকন অনেক চরাই-উৎরাই পেরিয়ে বছর খানেক আগে দেশে ফিরেছে।

বর্তমান সরকার দেশের বিভিন্ন সেক্টরের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। এই গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধিতে সরকারের অবদান উল্লেখযোগ্য। গার্মেন্ট ফ্যাক্টরীর আড়ালে বিভিন্ন দেশে নারী শ্রমিক পাচারের ব্যবসা বন্ধে সরকারের অতি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরীতে নারী শ্রমিকদের নিয়োগ, ছাঁটাই, চাকুরীচ্যুতের ক্ষেত্রে অবশ্যই রাষ্ট্রীয় ডাটাবেজ পদ্ধতি চালু, রাষ্ট্রীয় নজরদারি এবং শ্রমিক শ্রেণির অভিভাবকদের সাথে সকল প্রকার যোগাযোগ ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করণ।

উৎসব শেষে ফেরার পথে মনে পড়লো সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহলের ওপারের (ভারতের) বাসিন্দাদের কথা, জানতে ইচ্ছে হলো কেমন আছে তারা? সাধারনের সাথে কথা না হলেও কথা বলেছি নব্য ভারতের অধিবাসী মশালডাঙ্গার জয়নুল, পোয়াতুরকুটিরের সাদ্দামের সাথে। যারা ছিটমহল বিনিময়ের গ্রন্থিমোচন আন্দোলনে সর্বকনিষ্ঠ তরুন নেতা হিসাবে অসামান্য অবদান রেখেছে। কথা বলেছি ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনের পুরোধা প্রয়াত দীপক সেনগুপ্তের ছেলে দীপ্তিমান সেনগুপ্তের সাথে। নানাবিধ প্রশ্নের উত্তরে নিশ্চিত হয়েছি, ওরা-ভালই আছে, রাস্তাঘাট, বিদ্যুতায়ন হয়েছে। নতুন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। আধার কার্ড, ভোটার কার্ড পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিনা পয়সায় চিকিৎসার জন্য এখনও স্বাস্থ্য কার্ড মেলেনি। বিনিময় হওয়া জায়গা-জমি রাষ্ট্রীয়ভাবে রেকর্ড হয়েছে বটে, তবে ভোগদখলকারীরা রাষ্ট্রীয়ভাবে এখনও কোন দলিলপত্র পায়নি। নব্যভারতীয় সাধারণরা ভাল থাকলেও বুঝতে পারছে রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যকার স্নায়ুযুদ্ধের ঝাঁল কত কঠিন! রাজনৈতিক রেষারেষিতে তাদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এক সময় সহজ-সরল, নিরীহ, রাষ্ট্রীয় অধিকার বঞ্চিত মানুষ হিসাবে যারা বাংলা এবং ভারতের মানবিক সহানুভূতির কাঙাল ছিল, তারা কেন রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়ল? এমন প্রশ্নের উত্তরে পোয়াতুকুটির নব্য ভারতীয় সাদ্দাম, যে তরুন এখন রাজ্য সরকারে সমর্থনকারী; সে বলল, ‘রাজনৈতিক আদর্শ লালন ও বিশ্বাস করা মনের ব্যাপার, প্রকাশ্যে রাজনীতি করাও অধিকার। আমরা এই অধিকারের জন্যই দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছি। রাজনীতি করা দোষেরই বা কি? তবে রাজনীতির করার ইচ্ছা ছিলনা, পরিস্থিতি বাধ্য করেছে। এক্ষেত্রে মশালডাঙ্গার তরুন জয়নুল জানালো, ‘দীপ্তিমান সেনগুপ্ত আমাদের রাষ্ট্রীয় অধিকার ফেরাতে যে আন্দোলন করেছে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই তাঁর আদর্শ ধারণ করে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনীতিতে সর্ম্পৃক্ত হয়েছি। কিন্তু এই রাজনৈতিক অধিকারে যে বিষের কাটা তা এখন বুঝতে পারছি। এব্যাপারে দীপ্তিমান সেনগুপ্তের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমি তিনটি কারনে কেন্দ্রীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছি। তার একটি হলো আদর্শের, জন্মদাতা পিতাকে যথাযথ মর্যাদা দানে ব্যর্থ সন্তান যেমন অকৃতজ্ঞ। তেমনি রাষ্ট্রীয় অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার সম্মানে ভূষিত সরকারের প্রতি সমর্থন না জানানো জ্ঞান পাপের কাজ। দ্বিতীয়ত, বিলুপ্ত ৫১টি ছিটমহলের উন্নয়নে কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষিত নয়শত আশি কোটি রুপির যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য দাবী আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া এবং তৃতীয়ত রাজ্য সরকার যাতে ছিটমহলের উন্নয়নের অর্থ লুটপাট না করতে পারে তা ঠেকানো।’ সব মিলিয়ে বুঝতে বাকি নেই উন্নয়ন যাই হোক না ে কেনো রাজনৈতির রেষারেষিতে পড়ে মানবিক উন্নয়ন যে পিষ্ট হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

–– বর্তমান বাংলাদেশ এবং ভারত সরকারের মধ্যে যে সুসম্পর্ক তাতে উভয় দেশের মধ্যে কোন প্রকার জটিলতা থাকার কথা নয়। কারণ, উভয় দেশের সরকার বিশ্ব মানবিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় ও পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুতে যে মানবিক মূল্যবোধের পরিচয় দিয়েছে তা বিশ্ব মানবিক উন্নয়নের নন্দিত অন্যতম নিদর্শন। আমরা ভৌত অবকাঠামো নয়, মানবিক উন্নয়নের উৎকর্ষতাই চাই। এক্ষেত্রে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নেতাকর্মীদের মানুষ নিয়ে রাজনীতি নয়, মানুষের জন্য রাজনীতি করার ব্রত গ্রহণই হবে মানবিক উন্নয়নের মূল সোপান।

লেখক, সাংবাদিক, কলামিস্ট ও নাট্যকার

মোবা: ০১৭১৪-২৫৪০৬৬

rahimabdurrahim@hotmail.com