ডেস্ক নিউজ:

আমাদের সমাজে অনেকেই আছেন যারা পারিবারিকভাবে সচ্ছল হওয়ার পরও অভিভাবকের দায়িত্বহীনতা, নিজের আগ্রহ ও ইচ্ছেশক্তি কম থাকার কারণে লেখাপড়াসহ বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে পিছিয়ে পড়ছেন। আবার কেউ কেউ আছেন যারা সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে এগিয়ে চলছেন দূর্বার গতিতে। কোনো বাধাই যেন টেনে ধরতে পারছে না তাদের। তেমনি একজন হলেন ২৪ বছর বয়সী ইয়াছিন মির।

দু’চোখে আলো নেই তার। তবুও থেমে নেই ইয়াছিন। পড়ালেখা করছেন ঢাকা কলেজে। সেখানে বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র তিনি। ২০১১ সালে খিলক্ষেত জান-ই আলম উচ্চ বিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৩.৮৮ পেয়ে এসএসসি পাস করেন।

এরপর ২০১৩ সালে ঢাকা কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৪ পেয়ে এইচএসসি পাস করেন। থাকেন মিরপুর চিড়িয়াখানা এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে।

পড়ালেখার পাশাপাশি জীবন চালানোর জন্য ইয়াছিন হাতে সাদাছড়ি নিয়ে সারাদিন রাজধানীর মিরপুর এলাকায় হেঁটে হেঁটে ইঁদুর, তেলাপোকা ও ছাড়পোকার ওষুধ বিক্রি করেন। যা আয় হয় সেই টাকায় চলছে তার থাকা খাওয়া ও পরিবারের খরচ।

ইয়াছিনের ৭৫ বছর বয়সী বাবা আশরাফ উদ্দিন মির ও তার মা থাকেন কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার কালিকাপ্রসাদ ইউনিয়নের ঝগড়ারচর গ্রামে। ৪ ভাই ও ১ বোনের সংসারে সবাই বিয়ে করে নিজ নিজ সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও বাবা-মায়ের সকল দায়িত্ব পড়েছে ইয়াছিনের উপর। তাই আলোহীন চোখে সংসারের বোঝা মাথায় নিয়ে ছুটছেন দিকবিদ্বিক।

এসব বিষয় নিয়েই সোমবার দুপুরে মোবাইল ফোনে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা ইয়াছিনের। এই প্রথম একজন সাংবাদিকের সঙ্গে মন খুলে বললেন বলে জানালেন তিনি।

তিনি জানান, ৬ বছর বয়সে সুস্থ-স্বাভাবিক ছিলেন ইয়াছিন। একদিন সন্ধ্যায় গায়ে প্রচণ্ড জ্বর অনুভব করেন তিনি। গ্রামে থাকার কারণে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার দেখানো সম্ভব হয়নি তার। রাত যত বাড়ে ইয়াছিনের জ্বরও বাড়তে থাকে। পরদিন সকালেই চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করেন তিনি। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর জানতে পারেন টাইফয়েডে আক্রান্ত ইয়াছিন। এ কারণে তার চোখের আলো চলে গেছে।

কিছুদিন পর ইয়াছিনকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসেন তার পরিবার। বেশ কয়েকজন ডাক্তারের চিকিৎসা নিয়েও কোনো লাভ হয়নি তার। উন্নত চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্য না থাকায় বন্ধ হয়ে যায় ইয়াছিনের চিকিৎসা।

দৃষ্টিহীন চোখেই ছোট্ট ইয়াছিন সিদ্ধান্ত নেয় পড়ালেখা করবে। এরপর তাকে ঢাকায় মিরপুরের জাতীয় বিশেষ শিক্ষা কেন্দ্রে (আবাসিক) শিশু শ্রেণি ভর্তি করানো হয়। সেখানে বিশেষ ব্যবস্থায় ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েন ইয়াছিন।

ইয়াছিন বলেন, অন্ধ চোখে শিক্ষা জীবনে এতদূর আসার পেছনে অবদান আমার বাবার। শিশুকালে আমার আগ্রহ বাবা বুঝতে পেরেছিল বলেই আমি আজ একটু হলেও এগিয়েছি।

তিনি বলেন, দুই বছর আগে তিন বেলা খাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না আমার। একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম কিছু একটা করবো। কিন্তু কি করবো, ভেবে পাচ্ছিলাম না। কয়েক দিন ভাবার পর সিদ্ধান্ত নিলাম হকারি করবো ছোট ছোট পণ্যের। যেগুলো খুব সহজে ব্যাগের মধ্যে বহন করে বিক্রি করা যায়। এরপরই শুরু করে দিলাম। কখনও স্থানীয় বাজারে মালামাল ক্রয় করি। কখনও আবার চকবাজারে। সব মিলে আমার কাছে ৭শ টাকার মালামাল রয়েছে। প্রতিদিন গড়ে বিক্রি হয় ২শ টাকার মতো।

তিনি আরও বললেন, এসব মালামাল বিক্রির চেয়ে ভিক্ষা করলে হয়তো বেশি টাকা পাওয়া যেত। অনেকে এ বুদ্ধি দিলেও বিবেক করতে দিচ্ছে না। লেখাপড়া শিখে ভিক্ষা করবো, এটা হয় না। তাই ব্যবসা করছি। এজন্য গর্ব করে বলতে পারি, আমি ব্যবসা করি। ভিক্ষাবৃত্তি কোনো পরিচয়ের মধ্যে পড়ে না।

ইয়াছিন বলেন, কোনো কাজই ছোট না। পড়ালেখার পাশাপাশি সবারই উচিত কিছু করা। এতে সম্মান যায় না। বরং বাড়ে। অনেকে যখন শুনছে আমি ব্যবসার পাশাপাশি পড়ালেখা করি তখন কিছু না কেনার আগ্রহ থাকলেও কিছু না কিছু নিচ্ছে আমার কাছ থেকে। এর মানে সমাজের মানুষ কর্মজীবীদের মূল্যায়ন করে।

তিনি বলেন, দুই বছর ধরে এই ব্যবসা করতে গিয়ে অনেকবার গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আহত হয়েছি। এখনও রাস্তায় নামলে মনে হয় কোনো দিক থেকে বুঝি গাড়ি এসে এই বুঝি আমাকে চাপা দিল। এই ভয়ে থাকি সব সময়। আমার যোগ্যতা অনুযায়ী যদি একটা চাকরি পেতাম তাহলে একটু হলেও ভালো থাকতাম বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে।

তিনি নিজেই বললেন, বিভিন্ন অফিসে টেলিফোন অপারেটরের চাকরি পাওয়া যায়। এমন একটা চাকরি হলে আমার জন্য ভালো হতো। চাকরির ক্ষেত্রে ইয়াছিনকে কেউ সহযোগিতা করতে চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন তার নম্বরে ০১৮৫৮-৯০৬৭৯৩