এম.এ আজিজ রাসেল:

ফ্রান্সের ল্যাকটালিস কোম্পানির উৎপাদনকৃত শিশুখাদ্য বেবি মিল্ক ফর্মুলা) বেবিকেয়ারে পাওয়া গেছে ক্ষতিকারক জীবাণু “সালমোনেলা এগোনা”। এটি শিশুর দেহে ক্ষতিকর জীবাণু সংক্রমণের শংকা রয়েছে। এ জন্য ‘বেবী কেয়ার-১’ ও ‘বেবী কেয়ার-২’ বাজারজাত বন্ধ করা ও বাজার থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এক গণবিজ্ঞপ্তিতে নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ এর ধারা ৪৩ অনুসরণপূর্বক এই শিশুখাদ্য আমদানি এবং ব্যবহার না করার জন্য সবাইকে অনুরোধ করা হয়েছে।

বাংলাদেশে এই পণ্যের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান জেইএস ইন্টারন্যাশনাল। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নিতে গত ১০ জানুয়ারি স্বাস্থ্য বিভাগ থেকেও আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ থেকেও সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। এতে জানানো হয়, ফ্রান্সের ল্যাকটালিস কর্তৃক উৎপাদনকৃত শিশুখাদ্য ‘বেবী কেয়ার-১’ ও ‘বেবী কেয়ার-২’ এ ‘সালমোনেলা এগোনা’ নামের জীবাণু সংক্রমণের বিষয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ইনফোসেন (ওহভড়ংধহ) এবং উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লেকটালিসের মাধ্যমে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ অবগত হয়েছে। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক, সরবরাহকারী, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা, গ্রাহক, অভিভাবক ও শিশু চিকিৎসকদের এই শিশুখাদ্যগুলো আমদানি, বিক্রি এবং ব্যবহার না করার জন্য সতর্ক করা হলো। আমদারিকারক প্রতিষ্ঠান জেইএস ইন্টারন্যাশনালকে জরুরি ভিত্তিতে এসব পণ্য বাজার হতে প্রত্যাহার করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

জানা যায়, বাংলাদেশে প্রচলিত শিশুখাদ্য গুঁড়া দুধের মধ্যে ফ্রান্সের ল্যাকটালিস কম্পানির বেবি মিল্ক ফর্মুলার কয়েকটি ধাপের ‘বেবি কেয়ার’ পণ্যটি বেশ জনপ্রিয়। এই শিশুখাদ্যে সম্প্রতি ‘সালমোনেলা এগোনা’ জীবাণুর উপস্থিতি শনাক্ত হওয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে এর বাজারজাত বন্ধ করেছে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশেও এই শিশুখাদ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তা বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের দুটি গোডাউন সিলগালা করা হয়েছে। নজরদারি বাড়ানো হয়েছে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও। বিশ্বের ১৪টি দেশে পরিবেশিত শিশুখাদ্য বেবি কেয়ারের বড় বাজার বাংলাদেশ। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান পরিবেশকদের মাধ্যমে দেশব্যাপী খুচরা পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট ব্যাচের এই শিশুখাদ্য বিক্রি করে আসছে। তবে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটি বিএফএসএ) তৎপরতায় পণ্যটির পরিবেশক জেস ইন্টারন্যাশনাল স্থানীয় পরিবেশকদের মাধ্যমে খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে পণ্যটি তুলে নিচ্ছে। পরিবেশকরাও নিজ খরচে পণ্য সংগ্রহ করে প্রধান পরিবেশকের কাছে ফেরত পাঠাচ্ছে।

জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন করা বেবি কেয়ার-১, বেবি কেয়ার-২, বেবি কেয়ার-৩, বেবি কেয়ার-এমএফ, মিলুমেল, পিকট ও সেলিয়া ব্র্যান্ডের গুঁড়া দুধ বাজার থেকে তুলে নেওয়া হচ্ছে। কক্সবাজার থেকেও এই পণ্য তুলে নেয়া হচ্ছে বলে জানান এখানকার প্রতিনিধি নয়ন পাল। পন্যগুলো যাতে কোনোভাবেই দেশে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দিয়ে অবহিত করেছে বিএফএসএ। বিএফএসএ ও জেস ইন্টারন্যাশনাল সূত্র জানায়, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ফ্রান্সের হেলথ অথরিটি ল্যাকটালিস কম্পানির বেবি মিল্ক ফর্মুলায় ক্ষতিকর জীবাণু ‘সালমোনেলা এগোনার’ উপস্থিতি খুঁজে পায়। ওই কম্পানির উৎপাদিত আটটি ব্যাচের পণ্যে এই জীবাণু পাওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গেই পণ্যটি ফ্রান্সে নিষিদ্ধ করা হয়। একই সঙ্গে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানটির সরবরাহ করা ১৪টি দেশে এ বিষয়ে সতর্কতা জারি করা হয়। বিশ্বজুড়ে ফুড সেফটি নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ‘ইনফোসান’ প্রথমে চিঠির মাধ্যমে বিএফএসএকে বিষয়টি অবহিত করে। পরে ‘ল্যাকটালিস’ প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললে তারাও বিষয়টি নিশ্চিত করে চিঠি দেয়। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরপরই বিভিন্ন পত্রিকার মাধ্যমে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। একই সঙ্গে পরিবেশক কম্পানিকে বাজার থেকে পণ্যটি তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী জেস ইন্টারন্যাশনাল পণ্যটি বাজার থেকে তুলে নিচ্ছে। এ বিষয়ে তারাও একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।

জানা গেছে, গত বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশে ল্যাকটালিস কম্পানির বেবি মিল্ক ফর্মুলার আটটি ব্যাচের পণ্যের মধ্যে চারটি বাজারজাত শুরু হয়। বাকি চারটি ব্যাচের পণ্য বাংলাদেশে আসার আগ মুহূর্তে আটকে দেওয়া হয়। তবে চারটি ব্যাচের মাধ্যমে এরই মধ্যে ২৪ থেকে ২৫ হাজার কার্টন (প্রতি কার্টনে ২৪টি) আমদানি হয়ে গেছে। এর অর্ধেকটাই এরই মধ্যে বাজারে বিতরণ করা হয়েছে। এমনকি বিতরণ হওয়া পণ্যের ৩০ শতাংশ ভোক্তার হাতেও চলে গেছে। তবে এই দুধপানের কারণে কেউ সালমোনেলা এগোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে কি না সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা যায়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রয়োজনীয় পরীক্ষার সরঞ্জাম না থাকায় এবং চিকিৎসক পর্যায়ে বিষয়টি না জানায় সংক্রমণের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।

এ ব্যাপারে জেস ইন্টারন্যাশনালের কক্সবাজারের মেডিকেল ডেলিগেট নয়ন পাল বলেন, কক্সবাজার থেকে এই ব্যাচের পণ্যগুলো তুলে নেয়া হয়েছে।

জেস ইন্টারন্যাশনালের পার্টনার জাওয়াদুল হক বলেন, ‘ল্যাকটালিস কর্তৃপক্ষ পণ্যটি বাংলাদেশে রপ্তানি করলেও এ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার বিষয়ে জেস ইন্টারন্যাশনালকে কোনো তথ্য অবহিত করেনি। বিএফএসএ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরই বিষয়টি জানতে পারি। তখন নির্দেশনা অনুযায়ী গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। আমাদের দুটি গোডাউন সিলগালা অবস্থায় রয়েছে এবং প্রতিদিনই সারা দেশ থেকে পণ্যগুলো আমাদের কাছে ফেরত আসছে।’

বিএফএসএর সদস্য (জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি) মঞ্জুর মোর্শেদ আহেমদ বলেন, ‘ইনফোসানের কাছ থেকে আমরা প্রথমে বিষয়টি জানতে পারি। পরবর্তী সময়ে পণ্যটির উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ল্যাকটালিস চিঠির মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করে। সঙ্গে সঙ্গেই পদক্ষেপ নিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছি। এখন সারা দেশেই মনিটরিং কার্যক্রম চলছে। এরই মধ্যে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের গোডাউন সিলগালা করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ের খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে পণ্যটি সংগ্রহ করা হচ্ছে।’

মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, ‘বেবি মিল্ক ফর্মুলা অত্যন্ত সংবেদনশীল শিশুখাদ্য। উল্লেখিত বেবি ফর্মুলায় মারাত্মক ক্ষতিকর জীবাণু সালমোনেলা এগোনার উপস্থিতি জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক, সরবরাহকারী, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা, গ্রাহক, অভিভাবক, শিশু চিকিৎসকদের এসব শিশুখাদ্য পরিহারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’