ডেস্ক নিউজ:

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়েছেন- তাতে জাতি হতাশ, বিস্ময়-বিমূঢ় এবং উদ্বিগ্ন। এ ভাষণে বিদ্যমান জাতীয় সংকট নিরসনে স্পষ্ট কোনো রূপরেখা নেই।

শনিবার বিকেলে চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে এ সম্মেলন ডাকা হয়।

মির্জা ফখরুল বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন তা খুবই অস্পষ্ট, ধোঁয়াশাপূর্ণ এবং বিভ্রান্তিকর। জাতি আশা করেছিল তার প্রধানমন্ত্রীত্বের এ মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার এক বছর আগেই তিনি যে ভাষণ দেবেন, সে ভাষণে থাকবে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা, জাতীয় সংকট নিরসনে একটি স্পষ্ট রূপরেখা এবং জনগণের উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য থাকবে বিভ্রান্তির বেড়াজালমুক্ত কর্ম পদক্ষেপ।

‘পাকিস্তানের স্বৈর সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান তার শাসনের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে জাঁক-জমকপূর্ণভাবে উন্নয়ন দশক পালন করেছিলেন। গণতন্ত্রহীন তথাকথিত উন্নয়ন জনগণ গ্রহণ করেনি। পরিণতিতে তার মতো ‘লৌহমানব’কে ক্ষমতা থেকে গণঅভ্যুত্থানের মুখে বিদায় নিতে হয়েছিল।

তিনি বলেন, বর্তমান সরকারও ‘উন্নয়নমেলা ’ করছে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস পাকিস্তানি আমলের স্বৈরশাসকের মতো আঁকড়ে রাখার জন্য যে ধরনের চমকের আশ্রয় নিয়েছিলেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকারও সেই একই পথে হাঁটছে। এ দেশের সচেতন জনগণ সবকিছু জানে ও বোঝে। সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের কোনো মন্তব্য বাহুল্যই হবে মাত্র।

বিএনপির মহাসচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী ভাষণে তার শাসনামলে উন্নয়নের এক চোখ ধাঁধাঁনো বয়ান পেশ করেছেন। বিশেষ করে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে তাদের দাবির সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানও একমত হতে পারেনি। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস থেকে জানা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.৩ শতাংশের বেশি হবে না। অথচ অর্থমন্ত্রী দাবি করেছিলেন এ প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের নিচে হবে না। অন্যদিকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য সরকারের জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭.২ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে বিশ্বব্যাংক মনে করে। অথচ সরকার এ অর্থবছরে ৭.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে।

‘এভাবে প্রায় প্রতি বছরই প্রবৃদ্ধি-সংক্রান্ত সরকারি প্রাক্কলেনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থাগুলো দ্বিমত পোষণ করে আসছে। আমাদের প্রশ্ন হলো, জনগণ কোন তথ্য বিশ্বাস করবে।’

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে অন্যান্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকের একটি সহসম্পর্ক থাকার কথা। কিন্তু আমদানি-রফতানি, বৈদেশিক রেমিট্যান্স, ঋণ প্রবাহ প্রভৃতির সঙ্গে সরকারের প্রবৃদ্ধি-সংক্রান্ত প্রাক্কলনের সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় না। পরিসংখ্যানের তেলেসমাতি করে সরকার বরাবরই জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। প্রধানমন্ত্রীও তাই করলেন-বলেন মির্জা ফখরুল।

মির্জা ফখরুল বলেন, ব্যাংকিং সেক্টরে দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার বেইল আউট প্রোগ্রামের আশ্রয় নিয়েছে। বেইল আউট প্রোগ্রামের ফলে বাড়তি করের বোঝা সাধারণ মানুষের ওপর চাপানো হচ্ছে। অন্যদিকে ব্যাংকিং সেক্টরের লুটপাট থেকে লাভবান হচ্ছে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি। এসব লুটপাটের সঙ্গে দেশ থেকে অর্থ পাচারের যোগসূত্র রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। যা কখনও কোনো দেশে ঘটেনি সে রকম ঘটনাই ঘটেছে বাংলাদেশে।

‘বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভের ৮০৮ কোটি টাকা সমমানের বৈদেশিক মুদ্রা লোপাট হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। কেন প্রকাশ করা যাচ্ছে না সে ব্যাপারেও সরকার গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। দেশের সর্বোচ্চ আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি এভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে তা হলে দেশের টেকসই উন্নয়নের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনোক্রমেই আশাবাদী হওয়া যায় না।’

তিনি বলেন, আর্থিক খাতে যখন এ রকম নৈরাজ্য চলছে, তখনই সরকার ব্যাংকগুলোতে পরিচালনা পর্ষদে ঊর্ধ্ব পদে একই পরিবারের ৪ সদস্যকে ঠাঁই করে দেয়ার যে সুযোগ করে দিয়েছে, এতে ব্যাংকিং খাত আরও নাজুক হয়ে পড়বে। সরকার খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পন্নতার দাবি করলেও ২০১৭ সালে লাখ লাখ টন খাদ্য আমদানি করতে হয়েছে। তাহলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলো কীভাবে? ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বন্যার ফলে খাদ্য উৎপাদনে যে ঘাটতি হয়েছে তা পূরণের জন্য যথাসময়ে পদক্ষেপ না নেয়ার ফলে বাজারে চালসহ খাদ্যশস্যের দাম সব সময়ের রেকর্ড অতিক্রম করেছে। বাজারে পেঁয়াজ, ডাল ও সবজিসহ প্রত্যেকটি খাদ্যদ্রব্যের দাম অসহনীয়ভাবে বেড়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী ২০১৮ সালের শেষদিকে একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কীভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তা আমাদের সংবিধানে সম্পূর্ণভাবে বলা আছে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে। সেই সরকার নির্বাচন কমিশনারকে নির্বাচন পরিচালনায় সহায়তা দিয়ে যাবে।’

‘প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য নির্বাচনকে ঘিরে বিদ্যমান সংকটকে আরো ঘনীভূত করে তুলেছে। সংবিধানে “নির্বাচনকালীন সরকার” সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো বিধান নেই। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী যদি সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তা হলে সেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। কারণ সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় নির্বাচনকালীন সরকারও হবে বিদ্যমান সরকারেরই অনুরূপ। সংবিধানে নির্বাচনকালীন সরকার কেবল রুটিন ওয়ার্ক করবে- এমন কিছু উল্লেখ নেই। সংবিধানের ১৫তম ও ১৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের শাসনকে পাকাপোক্ত করার একটি ব্যবস্থাই হয়েছে মাত্র। সংবিধান ও গণতন্ত্র সবসময় সমর্থক বা সমান্তরাল হয় না। তাই যদি হতো তা হলে হিটলার ও মুসোলিনির শাসনকেও গণতান্ত্রিক বলা যেত। কারণ তাদের শাসনও সংবিধান অনুযায়ীই ছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী যদি আন্তরিকভাবে নির্বাচনকালীন সরকার সম্পর্কে নতুন কিছু ভেবে থাকেন তা হলে তার উচিত হবে এ নিয়ে সব স্টেক-হোল্ডারদের সঙ্গে সংলাপের উদ্যোগ নেয়া। আমাদের দল মনে করে একটি আন্তরিক ও হৃদ্যতাপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে ২০১৮-এর নির্বাচন সম্পর্কে অর্থবহ সমাধানে আসা সম্ভব। নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা কেমন হতে পারে, তা নিয়ে আমাদের দলের একটি চিন্তা-ভাবনা আছে।’

‘একটি সুন্দর পরিবেশে সংলাপটি অনুষ্ঠিত হলে জাতির মনে যে অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে আমরা আস্থা রাখতে চাই।’