বিশেষ প্রতিবেদক:

২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি কক্সবাজার পৌরসভার সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিজয়ী প্রার্থীদের নামে গেজেট প্রকাশ পায় ৪ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু নানা কারণে নতুন পৌরপরিষদ আড়াই বছর শপথ নিতে পারেননি। ফলে পূর্ব পরিষদ অতিরিক্ত আড়াই বছর দায়িত্ব পালনের পর ২০১৩ সালের ২০ জুলাই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে শপথ নিয়ে নতুন দায়িত্ব নেন। সে হিসেবে চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে শেষ হবে চলমান পরিষদের কার্যকাল। তখনই হতে পারে কক্সবাজার পৌর নির্বাচন।

তাই নতুন নির্বাচনী বছর শুরু হওয়ার সাথে সাথে কক্সবাজার পৌরসভায় নির্বাচনী আমেজও শুরু হয়েছে। নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, সম্ভাব্য প্রার্থীদের দৌঁড়ঝাপও ততই বাড়ছে। কক্সবাজার পৌর নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হয়ে মাঠে নামতে ইতোমধ্যে একাধিক প্রার্থী কৌশলে চষে বেড়াচ্ছেন পুরো পৌর এলাকা।

ভোটের অংকে কক্সবাজার পৌরসভা আওয়ামী লীগের জন্য বরাবরই উর্বর। কিন্তু মনোনয়ন প্রত্যাশী হেভিওয়েট প্রার্থীর সংখ্যা বেশী হওয়ায় প্রার্থী সিলেকশনে দলের হাই কমান্ডকে দ্বিধাদন্ধে পড়তে হয়। একারণে ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী মুজিবুর রহমান চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দলের রাশেদুল ইসলাম বিদ্রোহী ও নুরুল আবছার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ভোট যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ায় জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী সরওয়ার কামাল বিজয়ী হন। এবারও মনোনয়ন প্রত্যাশী বিএনপি-জামায়াত ঘরাণার প্রার্থীদের তালিকা সংক্ষিপ্ত হলেও আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা অতীতের মতোই দীর্ঘ। আগামী পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এবার যাদের নাম আলোচিত হচ্ছে, তারা হলেন কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান চেয়ারম্যান, জেলা আওয়ামীলীগ নেতা রাসেদুল ইসলাম, বর্তমান ভারপ্রাপ্ত পৌর মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরী ও জেলা আওয়ামীলীগ নেতা, সাবেক ৪ বারের পৌর চেয়ারম্যান নুরুল আবছার।

মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকা লম্বা হলেও মাঠে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ স¤পাদক মুজিবুর রহমান চেয়ারম্যান ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত পৌর মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরী। দলীয় প্রোগ্রামে মুজিবুর রহমান ও উন্নয়ন কাজ তদারকিতে মাহবুবুর রহমান ইতোমধ্যে পৌরসভার অধিকাংশ ওয়ার্ডে গিয়ে কৌশলে গণসংযোগ শুরু করেছেন।

মুজিব চেয়ারম্যান জানান, গতবার তিনি নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা তাকে ডেকে নিয়ে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। মনোনয়ন পাওয়ার পর পৌরবাসীও তাকে সাদরে গ্রহণ করে। কিন্তু দল বিরোধী কতিপয় ব্যক্তি একাট্টা হয়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করে তাকে হারিয়ে দেয়।

তার মতে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। বর্তমান সরকারের সময়ে পৌর এলাকায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। মানুষ এসব উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে। অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে এখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত। তাই এবার দলীয় মনোনয়ন পেলে কোন ষড়যন্ত্রই তার বিজয়ে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।

বর্তমান ভারপ্রাপ্ত মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরী দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী হলেও কৌশলে পথ চলছেন। মনোনয়ন প্রত্যাশার ব্যাপারে বক্তব্য দিয়েছেন কৌশলী। বলেছেন, যে কোন নির্বাচনে দুটি জিনিস দরকার। একটি জন সমর্থন অন্যটি দলীয় সমর্থন। আমার জনসমর্থন আছে, জনসমর্থন বিবেচনায় দল মনোনয়ন দিলে আমি নির্বাচন করবো। ইতিমধ্যে পৌর এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসন ও অভ্যন্তরীণ সড়কের উন্নয়নের মাধ্যমে পৌরবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি।

পৌর এলাকাভিত্তিক রাজনীতিতে শক্ত অবস্থানে থাকা অপর দু’নেতা রাশেদুল ইসলাম ও নুরুল আবছার এখনো দৃশ্যমান প্রচারণায় না এলেও তারাও দলীয় মনোনয়ন চাইবেন এটা নিশ্চিত।

স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পৌরসভায় দু’বার ভোট করেছেন রাশেদুল ইসলাম। ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকেই তিনি স্পষ্টবাদী নেতা হিসেবে তরুণ ও সূধী সমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা অনেক। কিন্তু রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কাছে তিনি বার বার হেরে আসছেন।

রাশেদুল ইলামের মতে, শত ষড়যন্ত্র ও বাধা বিপত্তির পরও পৌরবাসী তার সাথে ছিলেন। এবারও ভোট করার জন্য পৌরবাসীর চাপ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনীতিতেই জীবনটা চালিয়ে এসেছি। তাই ভোটের সময় মনোনয়ন চাইব। তবে, শুধু পৌরসভায় নয় যেখানেই দল যোগ্য হিসেবে মনোনয়ন দিবে সেখানেই ভোটকরার সামর্থ রাখি আমি। আমার ধ্যান জ্ঞান দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি মনোনয়ন দিলেই ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন বলে দৃঢ প্রত্যয় ব্যক্ত করেন জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এ নেতা।

এছাড়াও, রাশেদুল ইসলাম রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তার পিতা এডভোকেট জহিরুল ইসলাম সাবেক সাংসদ ও জেলা গভর্ণর ছিলেন। সেকারণে পুরো জেলাতেই তার একটি কর্তৃত্ব ছাত্র রাজনীতি থেকেই গড়ে তুলেছেন তিনি। তাই স্বচ্চ রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান ও রাজনীতিক হিসেবে তিনি সব সময় একটি ফ্যাক্টর হিসেবেই ধরা দেন।

অপরদিকে, কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক পৌর চেয়ারম্যান নুরুল আবছার জনগনের ভোটে পরপর চার বার পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। নানা কারণে জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটা পড়লেও এখনো তিনি ফ্যাক্টর। তাই, নুরুল আবছার বলেন, মাঠ পর্যায়ে জরিপ করে মনোনয়ন দিলে তিনি মনোনয়ন পাবেন। আর দলীয় মনোনয়ন পেলে জয়ী হওয়ার ব্যাপারে তিনি শতভাগ আশাবাদী।

এদিকে, দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এতে অনেকটা নিশ্চিত হওয়ায় পাড়ায়-মহল্লায় ও চায়ের আড্ডায় নৌকার মাঝি কে হবে বা কাকে নৌকার মাঝি বানালে দলের জন্য মঙ্গল হবে এটি নিয়ে বিশ্লেষণ করছেন ভোটাররা। তাদের মতে, গতবারের নৌকার প্রার্থী মুজিবুর রহমান চেয়ারম্যান বর্তমানে জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। সে হিসেবে তিনি আটটি উপজেলা ও চারটি পৌর কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাকে পৌর নির্বাচনে এনে সব ক্ষমতা একজনের হাতে ন্যাস্ত করবেন এমন চিন্তা দলীয় প্রধান নাও করতে পারে। এক্ষেত্রে প্রথমে দলের মনোনয়ন পেয়ে মাঠে নামার পর বার বার বঞ্চিত করায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে মাঠে নামা রাশেদুল ইসলামই নির্ভরযোগ্য প্রার্থী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারেন বলে ধারণা তাদের। কারণ পৌর এলাকার সবখানেই তাঁর সমান জনসমর্থন রয়েছে। আবার তিনবার কাউন্সিলর থাকার পাশাপাশি বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্বপালন করায় মাহবুবুর রহমান চৌধুরীও দলীয় মনোনয়ন পেতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। আর নানা ডিগবাজির কারণে সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আবছারকে দলীয় মনোনয়ের তালিকায় আনবেন এমনটি কেউ আশা করছেন না। দেশের অন্যতম পর্যটন রাজধানী হিসেবে কক্সবাজারের পৌরপিতা হতে একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকেই নৌকার টিকেট দিবেন দলীয় প্রধান এমনটিই আশা সাধারণ ভোটারদের।

তবে, কাঙ্খিত পৌর নির্বাচনে কে পাচ্ছেন নৌকার টিকেট তা দেখতে নির্বাচনী তফসীল ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

কক্সবাজার পৌরসভার সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি। ৪ ফের্রুয়ারি নির্বাচিতদের গেজেট প্রকাশিত হয়। একই বছরের ১৯ র্ফেরুয়ারি চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনের কার্যালয়ে নির্বাচিতদের শপথ গ্রহনের সময় নির্ধারিত ছিল। অন্যান্য পৌরসভার নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলররা শপথ গ্রহণ করলেও ৪ দফা সময় পরিবর্তনের পরেও এখানে নির্বাচিতদের শপথ গ্রহণ হয়নি। ফলে আগের পৌর পরিষদ দীর্ঘ আড়াই বছর বাড়তি দায়িত্ব পালন করে। এতে শপথ গ্রহণের দাবীতে ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারী নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কক্সবাজারে হরতাল পালন করে। পরে ২০১৩ সালের ২০ জুলাই নির্বাচিত পৌর মেয়র ও কাউন্সিলরদের শপথ বাক্য পাঠ করান জেলা প্রশাসক। দায়িত্ব নেয়ার পর নির্বাচিত মেয়র সরওয়ার কামাল বেশী দিন দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। তার বিরুদ্ধে একাধিক নাশকতা ও দুর্নীতির মামলার অভিযোগপ্রত্র আদালত গ্রহন করায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় মেয়র সরওয়ার কামালকে সাময়িকভাবে বহিস্কার করে। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর প্যানেল মেয়রকে দায়িত্ব গ্রহন করতে চিঠি ইস্যু করেন। প্যানেল মেয়র-১ জিসান উদ্দিন ও প্যানেল মেয়র-২ রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধেও নাশকতার মামলা থাকায় দায়িত্বভার নিতে পারেননি। প্যানেল মেয়র-৩ কুহিনুর ইসলাম বর্তমান মেয়র মাহবুবুর রহমান চৌধুরীকে সমর্থন করায় মন্ত্রণালয় মাহবুবুর রহমান চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসাবে দায়িত্ব প্রদান করেন। ১ ডিসেম্বর তিনি ভারপ্রাপ্ত মেয়র হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহন করেন। তিনি অদ্যবদি দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এ দিকে এখনো চুড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ না হওয়ায় পৌরসভার মোট ভোটারের সংখ্যা নিশ্চিত করেননি জেলা নির্বাচন অফিস। তবে ইতোমধ্যে কক্সবাজার পৌরসভার মোট ভোটার সংখ্যাছিল ৬৭ হাজার ৫৭৭ জন। এতে পুরুষ ভোটার ৩১ হাজার ২৩৪ জন ও নারী ভোটার ৩৬ হাজার ৩৪৩ জন। তবে চুড়ান্ত ভোটার তালিকায় ভোটার সংখ্যা আরো বাড়বে বলে জানায় জেলা নির্বাচন অফিস।