ডেস্ক নিউজ:
‘খাদ্যপণ্যের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের বেশিরভাগ মানুষ কষ্টে আছেন। অনেকের জমানো সঞ্চয় হ্রাস পাচ্ছে। এই প্রবণতার প্রতিকার জরুরি। অন্যথায় দেশের স্থিতিশীলতা ব্যহত হতে পারে।’ কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জীবনযাত্রার ব্যয় সংক্রান্ত বাৎসরিক প্রতিবেদনে এসব কথা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনটি মঙ্গলবার (২ জানুয়ারি) প্রকাশ করা হয়।

গতবছর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে তিন টাকায় ডিম করার আয়োজনে ছিল মানুষের উপচে পড়া ভিড়প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে এখনও প্রায় দুই কোটি মানুষ অতি দরিদ্র। এর বাইরে দেশের সিংহভাগ জনসংখ্যা হতদরিদ্র, নিম্ন আয় এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত আয়ের শ্রেণিভুক্ত। পণ্যের দাম বাড়লে তাদের জীবনমানে বিরূপ প্রভাব পড়ে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ে। হতাশা আর অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়।

এ প্রসঙ্গে ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আয় বেড়েছে গুটি কয়েক মানুষের, অথচ ব্যয় বেড়েছে প্রায় সবারই। ব্যয় বৃদ্ধির ফলে নিম্ন ও নিম্নমধ্য আয়ের মানুষের ওপরে প্রভাব বেশি হারে পড়ছে। দেশে উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু তার সুফল নিম্ন আয়ের মানুষ পাচ্ছে না। বিশেষ করে ২০১৭ সালে এই মানুষেরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল পায়নি। এ কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে রাখার কোনও বিকল্প নেই।’

ক্যাবের প্রতিবেদনে ১০টি সুপারিশ করে বলা হয়েছে, ১২ থেকে ১৫টি অতি প্রয়োজনীয় পণ্য চিহ্নিত করে সে সব পণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি স্থিতিশীল ও দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। এছাড়া সরবরাহ ও মূল্য নামে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পৃথক একটি বিভাগ অথবা স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করতে হবে। বাড়িভাড়া কমিশন গঠনের মাধ্যমে ভাড়াটিয়াদের স্বার্থ সংরক্ষণ করার কথাও বলা হয়েছে।

ক্যাবের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ৪০.৯৯ শতাংশ ও আমদানি পেঁয়াজের দাম ৫৭.৫৪ শতাংশ। ২০১৭ সালে আগের বছরের তুলনায় সব ধরনের চালের গড় মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ২০.৪০ শতাংশ। তুলনামূলকভাবে মোটা চালের দাম সরু চালের চেয়ে বেশি বেড়েছে। শাক-সবজির গড়ে দাম বেড়েছে ২৪.২৮ শতাংশ। তরল দুধে বেড়েছে ২০.৩৬ শতাংশ, গরুর মাংস ১৯.৭২ শতাংশ। সব মিলিয়ে ২০১৭ সালে ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৮.৪৪ শতাংশ এবং পণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৭.১৭ শতাংশ। যেখানে ২০১৬ সালে জীবযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির হার ছিল ৬.৪৭ শতাংশ।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রাজধানীর ১৫টি খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবার মধ্য থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী ও ১৪টি সেবার তথ্য পর্যালোচনা করে ক্যাব এই হিসাব করেছে। এই হিসাব শিক্ষা, চিকিৎসা ও প্রকৃত যাতায়াত ব্যয়বহির্ভূত।

ক্যাবের সংবাদ সম্মেলনক্যাবের উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রা ব্যয়ের শিকার হয়েছেন দেশের স্বল্প আয়ের ১২ কোটি মানুষ। যাদের আয় দুই ডলারের নিচে। দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণে নিম্ন আয়ের মানুষদের জীবনযাত্রা ব্যয় গড়ে ৩০ শতাংশের মতো বেড়ে গেছে। দেশের গার্মেন্টসগুলোতে সাড়ে পাঁচ কোটি শ্রমিক কাজ করেন, তাদের বেতন না বাড়লেও ব্যয় ঠিকই বেড়ে গেছে।’

এদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত কয়েক মাসে শুধু চালের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে পাঁচ লাখ ২০ হাজার মানুষ নতুন করে দরিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছেন। শুধু তাই নয়, আরও অনেক মানুষ এ সীমার কাছাকাছি এসে ঠেকেছেন। ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির ত্রৈমাসিক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে এসব তুলে ধরা হয়। ২০১৭ সালে মে থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘অর্থনীতিতে জনপ্রিয় মডেল (সিজিইএম) ব্যবহার করে দেখা গেছে, চালের দাম বাড়ার কারণে দেশে ৫ লাখ ২০ হাজার মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে।’

একইভাবে স্বাধীন গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন অন্বেষণও মনে করে, নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য কাঙ্ক্ষিত সুফল বয়ে আনতে পারেনি সরকার। বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর মাসিক পর্যালোচনায় (ডিসেম্বর ২০১৭) গবেষণা সংস্থাটি এমন মতামত দিয়েছে।

উন্নয়ন অন্বেষণ বলেছে, ‘ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন হ্রাস, প্রকৃত মজুরি কমে যাওয়ার প্রবণতা ও কর্মসংস্থানের অভাব একদিকে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মানের ওপর প্রতিকূল প্রভাব সৃষ্টি করবে, অন্যদিকে দেশের সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির সম্মুখীন করতে পারে।’

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত  বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য বাড়লে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে সীমিত আয়ের মানুষ। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে বাধ্য হয়ে অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাওয়া শুরু করেন। আর যারা দরিদ্র, তাদের অনেকেই সীমার নীচে চলে যায়। উৎপাদন বাড়ানো, মজুদ বাড়ানোর মাধ্যমে সীমিত আয়ের মানুষদের জন্য সরবরাহ বাড়িয়ে জিনিসপত্রের দাম সহনীয় রাখতে হবে। তা না হলে সমাজে বৈষম্য বাড়তেই থাকবে।’