ইমাম খাইর, সিবিএন:
পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই ফসলি জমিতে অবাধে গড়ে উঠেছে অবৈধ ইটভাটা। ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি। আর ইট তৈরীতে ব্যবহার করা হচ্ছে শিশুদের। ফলে একদিকে পরিবেশ লঙ্গন অপরদিকে শিশু অধিকার আইন মানছেনা অবৈধ ইটভাটার মালিকরা।
সরেজমিন রামুর খুনিয়াপালং মীর্জা আলীর দোকান এলাকায় (ধোয়া পালং) গিয়ে দেখা গেছে, একদিকে পাহাড় ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল আরেক দিকে মানব বসতি। মধ্যখানে গড়ে ওঠেছে ইটভাটা। ‘রাইয়ান ব্রিক ফিল্ড’ নামের ওই ইট তৈরীর কারখানাতে দৈনিক কাজ করছে ২৫ জন মতো শ্রমিক। যেখানে এক তৃতীয়াংশ শ্রমিকের বয়স ১২ বছরেরও নীচে।
ইট তৈরীতে ব্যস্ত উজ্জল, তারিকুল। তাদের সঙ্গে রয়েছে আরো ৩ জন। যাদের বয়স ১২ বছরের কম। জিজ্ঞেস করলে শ্রমিকরা জানায়, ৫ মাসে ২৫ লাখ ইট তৈরীর কন্টাক্ট নিয়েছে। দৈনিক ১৮ থেকে ২০ হাজার ইট তৈরী করে। মেলপার্টিতে ১২ জন, কারিগর ৬ জন এবং ধুনার কাজে ৬ জন শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে। তারা দৈনিক ১০/১২ ঘন্টা কাজ করে। প্রতিমাসে ছোট শ্রমিকের মজুরী ৩০ হাজার এবং বড়দের মজুরী ৬০ হাজার টাকা দেয়া হয়। তাদের মঝির নাম বাবু।
রাইয়ান ব্রিক দায়িত্বরত ব্যবস্থাপক ইয়াকুব আলীর সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি কোন কিছু জানাতে অস্বীকার করেন। তিনি এটুকুই বলেন, মালিক এখানে নেই। তিনি দেশের বাইরে গেছেন। বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়েই ব্রিকফিল্ড করা হয়েছে।
পরিবেশ সংগঠন ইয়েস এর প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন সিবিএনকে জানান, কৃষিজমিতে ইটভাটা নির্মিত হওয়ায় কৃষিজমি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। অধিকন্তু ইটের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি। ফলশ্রুতিতে ফসলি জমি রূপান্তরিত হচ্ছে বদ্ধ জলাধারে যেখানে স্বাভাবিক ফসল উৎপাদন মারাত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি জানান, কক্সবাজারের অধিকাংশ ইটভাটা বনের পাশে। যার কারণে ইটভাটা নীতিমালা ২০১৩ আলোকে সম্পূর্ণ অবৈধ। এরপরও প্রশাসনের কিছু আসাধু লোকের যোগসাজসে অবৈধ ইটভাটা চালু রয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাইফুল আশ্রাব কক্সবাজার নিউজ ডট কম-সিবিএনকে জানান, মালিকানা ও নাম পরিবর্তন করে রাইয়ান ব্রিক ফিল্ড অনুমোদনের জন্য আবেদন করে। পাশে সংরক্ষিত বন ও পাহাড় থাকায় বন বিভাগের আপত্তিতে তাদের আবেদন বাতিল করা হয়। সেই সাথে ইটভাটার সকল ধরণের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়। তিনি জানান, আদেশ অমান্য করে কার্যক্রম চালালে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ (২০১৩ সনের ৫৯ নং আইন) এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ধারা ও এসবধারা সংশ্লিষ্ট দন্ড তুলে ধরা হয়েছে।

শিশুদের ব্যবহার করে ইট তৈরীর দৃশ্য। ছবিটি রায়ান ব্রিকফিল্ড থেকে নেয়া।

ধারা-৪
ইটভাটা যে জেলায় অবস্থিত সেই জেলার জেলা প্রশাসকের নিকট হইতে লাইসেন্স গ্রহণ ব্যতিরেকে, কোন ব্যক্তি ইটভাটায় ইট প্রস্তুত করিতে পারিবেন না।
ধারা-৪ এর বিধান লঙ্ঘন করিয়া, ইটভাটা যে জেলায় অবস্থিত সেই জেলার জেলা প্রশাসকের নিকট হইতে লাইসেন্স গ্রহণ ব্যতিরেকে, ইটভাটায় ইট প্রস্তুত করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ১ (এক) বৎসরের কারাদন্ড বা অনধিক ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দন্ডিত হইবেন।
ধারা-৫
(১) কোন ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করিবার উদ্দেশ্যে কৃষিজমি বা পাহাড় বা টিলা হইতে মাটি কাটিয়া বা সংগ্রহ করিয়া ইটের কাঁচামাল হিসাবে উহা ব্যবহার করিতে পারিবেন না।
(২) যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত, কোন ব্যক্তি ইট প্রস্তুত করিবার উদ্দেশ্যে মজা পুকুর বা খাল বা বিল বা খাঁড়ি বা দিঘি বা নদ-নদী বা হাওর-বাওর বা চরাঞ্চল বা পতিত জায়গা হইতে মাটি কাটিতে বা সংগ্রহ করিতে পারিবে না।
(৩) ইটের কাঁচামাল হিসাবে মাটির ব্যবহার হ্রাস করিবার উদ্দেশ্যে আধুনিক প্রযুক্তির ইটভাটায় কমপক্ষে ৫০ (পঞ্চাশ) শতাংশ ফাঁপা ইট প্রস্তুত করিতে হইবে।
(৪) স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক নির্মিত উপজেলা বা ইউনিয়ন বা গ্রামীণ সড়ক ব্যবহার করিয়া কোন ব্যক্তি ভারি যানবাহন দ্বারা ইট বা ইটের কাঁচামাল পরিবহন করিতে পারিবেন না।
৬। আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, কোন ব্যক্তি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসাবে কোন জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করিতে পারিবেন না।
এ ধারা লঙ্গনকারী অনধিক ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হইবেন।
ধারা-৬
কোন ব্যক্তি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসাবে কোন জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করিতে পারিবেন না।
এ ধারা লঙ্গনকারী অনধিক ৩ (তিন) বৎসরের কারাদন্ড বা অনধিক ৩ (তিন) লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।
ধারা- ৭
কোন ব্যক্তি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে নির্ধারিত মানমাত্রার অতিরিক্ত সালফার, অ্যাশ, মারকারি বা অনুরূপ উপাদান সম্বলিত কয়লা জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করিতে পারিবেন না।
এ ধারা অমান্যকারী অনধিক ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদন্ডে দন্ডে দন্ডিত হইবেন।
ধারা -৮
(১) ছাড়পত্র থাকুক বা না থাকুক, এই আইন কার্যকর হইবার পর নিম্নবর্ণিত এলাকার সীমানার অভ্যন্তরে কোন ব্যক্তি কোন ইটভাটা স্থাপন করিতে পারিবেন না, যথাঃ-
(ক) আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যেক এলাকা;
(খ) সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা সদর;
(গ) সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য, বাগান বা জলাভূমি;
(ঘ) কৃষি জমি;
(ঙ) প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা;
(চ) ডিগ্রেডেড এয়ার শেড
(২) এই আইন কার্যকর হইবার পর, নিষিদ্ধ এলাকার সীমানার অভ্যন্তরে ইটভাটা স্থাপনের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর, বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ কোন আইনের অধীন কোনরূপ অনুমতি বা ছাড়পত্র বা লাইসেন্স, যে নামেই অভিহিত হউক, প্রদান করিতে পারিবে না।
(৩) পরিবেশ অধিদপ্তর হইতে ছাড়পত্র গ্রহণকারী কোন ব্যক্তি নিুবর্ণিত দূরত্বে বা স্থানে ইটভাটা স্থাপন করিতে পারিবেন না, যথাঃ-
(ক) নিষিদ্ধ এলাকার সীমারেখা হইতে ন্যূনতম ১ (এক) কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে;
(খ) বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অনুমতি ব্যতীত, সরকারি বনাঞ্চলের সীমারেখা হইতে ২ (দুই) কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে;
(গ) কোন পাহাড় বা টিলার উপরিভাগে বা ঢালে বা তৎসংলগ্ন সমতলে কোন ইটভাটা স্থাপনের ক্ষেত্রে উক্ত পাহাড় বা টিলার পাদদেশ হইতে কমপক্ষে ১/২ (অর্ধ) কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে হতে হবে।
এ ধারা লঙ্গন করলে অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসরের কারাদন্ড বা অনধিক ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হইবেন।